বুধবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

অমানবিক আমলাতন্ত্র ও আমার দুঃখবোধ

হোসেন আবদুল মান্নান

কিছুদিন যাবৎ ভাবছি, নিজের চাকরি জীবনের দুঃখবোধ নিয়ে একটা গদ্য লেখা হলে কেমন হবে? চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অব্যক্ত-বেদনা বহন করে চলা মানুষের জীবনের জন্য ভয়ানক বার্তা নিয়ে আসতে পারে। দুরারোগ্য ব্যাধির উৎসমুখে নাকি বসবাস করে দুশ্চিন্তা। কাজেই আপন হৃদয়ালয়কে হালকা করার মানসে প্রকাশটা জরুরি হয়ে ওঠেছে। এমনিতেই চাকরির স্মৃতি রোমন্থন করতে অবসরপ্রাপ্তদের জুড়ি নেই। এ নিয়ে অসংখ্য বই পুস্তক, কাহিনি-গাথা রচিত হয়েছে। ভবিষ্যতেও এসব লেখালেখি অব্যাহত থাকবে। এতে আমার নয়, আশাকরি কারও ন্যূনতম দ্বিমত বা সংশয় নেই। এ ধরনের লেখাজোকা যে সবসময় পাটিগণিতের মতোন জীবনের সঙ্গে শতভাগ মিলে যাবে তাও নয়। কারণ, উত্তমপুরুষে লেখা এর কাহিনিকার কখনো শতভাগ নৈর্ব্যক্তিক থাকতে পারেন না। বরং বর্ণনায় আমিত্ব প্রবলভাবে প্রকাশিত হয়। এমন বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতার কথা জেনে এবং বুঝেই লেখাটি শুরু করতে চাই।

২. ২০২০ সালের জুন মাসে আমার স্ত্রী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তখন সারা পৃথিবীই একসঙ্গে শিহরিত ও আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের বড় বড় শহরগুলোতে লক-ডাউন, ঘরে থাকুন, হাঁচি-কাশির বিষয়ে সর্ব্বোচ্চ সতর্কতা মেনে চলছিল। তখনও গোটা দেশে করোনায় এক হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেনি। তবে এ অজানা ভাইরাস সম্পর্কে জনমনে ভয়ানক উৎকন্ঠা ও ভীতি ছিল। মানুষ নিকট আত্মীয়, এমনকি জন্মদাতা মা বাবাকে পর্যন্ত হাসপাতালে দেখতে যায়নি। চরম নিঃসঙ্গতা এবং নজিরবিহীন অসহায়ত্ব নিয়ে দেশের অসংখ্য কীর্তিমান চিরবিদায় নেন। সে সময়ে মৃত্যুপথযাত্রীদের করুণ ও মানবেতর দৃশ্য যারা অবলোকন করেছিল, জীবদ্দশায় কেউ তা ভুলে থাকতে পারবে না।

৩. মনে আছে, মাত্র কিছুদিন আগে সরকার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশব্যাপী কভিড-১৯ এবং সরকারি ত্রাণ ও খাদ্য সরবরাহ মনিটর করার নিমিত্ত ৬৪ জেলায় ৬৪ জন সচিবকে দায়িত্ব দেয়। আমিও যথারীতি নিজ জেলার দায়িত্ব প্রাপ্ত হলাম। কভিড-১৯ ভাইরাস দ্রুত সময়ে ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তখন কয়েকবার ঢাকা থেকে সুদূর কিশোরগঞ্জে যাতায়াত করি। জেলা প্রশাসন, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জন ও গণ্যমান্য সিভিল সোসাইটিসহ সভা-সেমিনার করে গোটা জেলার জন্য পূর্ব সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করি। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ বিষয়ে গণসংযোগ বৃদ্ধির নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করি। অতি অল্প সময়ের মধ্যে কিশোরগঞ্জের জন্য করোনা শনাক্তকরণ যন্ত্র (RTPCR Lab) স্থাপনের উদ্যোগ নিই। নিজ জেলা হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি স্বয়ং খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। তখন একাধিক সময় আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি। তিনিও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন। তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি। ২০২০ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহে এই ল্যাব চালু করার নিমিত্ত কিশোরগঞ্জ যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। আমি স্ত্রী ও দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যাই। তারাও অনেকদিন গৃহবন্দী থেকে একটু সূর্যালোকে অবগাহন করতে মুখিয়ে ছিল। এদের গ্রামের বাড়িতে রেখে আমি জেলার শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ল্যাবটি চালু করি।

৪. কিশোরগঞ্জে থাকা অবস্থায় আমার স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব হওয়ার সরকারি আদেশ হয়। আমি কাজ শেষ করে স্ত্রী এবং সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে রেখে ঢাকায় ফিরে আসি। তারা সপ্তাহখানেকের মতো সেখানে বেড়ায়। আমি মাঝে মাঝে ফোনে খোঁজ রাখছিলাম। একটা জনগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হওয়ার আনন্দে আমার স্ত্রী জেবুও ভাসছিল। তার স্বপ্ন ছিল, আমি এমন একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাই। তখন তার চারপাশে শত শত সুহৃদ শুভাকাক্সক্ষীর ভিড় লেগে যায়। আমাকে বলে, এখন তদ্বিরবাজদের ধাক্কা সামলাতে পারবা তো?

আমি বলেছিলাম, দেশের এমন দুঃসময়ে কেউ যেন আমাকে বিব্রত না করে। সবাইকে সতর্ক করে দিয়। আর শোন, আমার ওপর একান্ত আস্থা রেখেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি জীবনের বিনিময়ে হলেও তা রক্ষা করে যাব। দুদিন পর রাতে কথা বলছিলাম, জেবু তোমার কণ্ঠস্বর অন্য রকম লাগছে যে, তুমি কি অসুস্থ?

সে বলল, না, তেমন কিছু নয়। সামান্য জ্বর জ্বর লাগছে। কাশিও আছে। আমার ভিতরটা হঠাৎ কেঁপে উঠল।

আচ্ছা, আগামীকাল করোনা টেস্ট করিয়ে নাও তো। ও বলল, দু-তিন দিন পরেই তো চলে আসব। তুমি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যোগদান কর। আমি চলে আসছি। চিন্তা করার কিছু নেই। আশাকরি ঠিক হয়ে যাবে। আমার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়ে আসছিল। আমি যেন দুঃস্বপ্নের ঘোরে পড়ে যাই। কি জানি কি হয়।

৫. এদিকে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি মহোদয় বললেন, আপনার পূর্বসূরি (predecessor) যেহেতু সিনিয়র তাকে কিছু বলবেন না। তিনি যখন দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন তখনই হবে। আমি যথারীতি অপেক্ষা করছি। দিন শেষে জেবুর সঙ্গে কথা বলছি। তার শারীরিক অবস্থা ভালো নেই, তবু সে বলছে, এখানে চিকিৎসা নিচ্ছি। আমাদের ডাক্তার ছেলেই দেখাশোনা করছে। আমি কিছুটা নির্ভার হলেও একেবারে নিরুদ্বিগ্ন হতে পারিনি। আমার চিন্তা শুধু করোনা ভাইরাস। জেবু অবশ্যই আক্রান্ত হয়ে গেছে। আমার অনুরোধে তারা সবাই ঢাকায় ফিরে আসে। তার শরীর যেন চলছে না। বাসায় এসেই বলল, কেউ আমার কাছে এসো না। আগে টেস্ট করিয়ে দেখি। পরদিন সকালে বাসা থেকে তার ও বাচ্চাদের করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করি। সন্ধ্যায় জানা গেল, কেবল জেবু পজিটিভ। বাকিরা নেগেটিভ। আমি দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে বলি।

সে বলল, তুমি যোগদান কর, আমি দেখে যেতে চাই।

বললাম, আমাকে আরও দুদিন পরে জয়েন করতে হবে।

সে বলল, বাসায় তো চিকিৎসা হচ্ছে, তুমি জয়েন করলে হাসপাতালেও তারা আমাকে বেশি গুরুত্ব দিবে। আট দিন অপেক্ষা করে অবশেষে আমি যোগদান করলাম। সন্ধ্যার পর সচিবালয় থেকে ফিরে এসে একটু দূরত্বে থেকে তাকে সবকিছু বলি। তার চোখ হাসছিল। প্রশান্তির প্রচ্ছন্ন আলো জ্বলে উঠেছিল তার শ্বাসকষ্টের মুখাবয়ব জুড়ে। এবার সে হাসপাতালে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

নামাজ পড়তে চাচ্ছে। তবে বাচ্চারা হাসপাতালে নিয়ে যাবে। আমাকে এখনই সিএমএসডিতে একটা জরুরি সভায় যোগ দিতে হবে। সেদিন আমি এবং জেবু এক সঙ্গেই বাসা থেকে বের হই। কিন্তু একজন হাসপাতালে অন্যজন করোনা ভাইরাস মোকাবিলা করার জরুরি মিটিংয়ে। তখন দেশব্যাপী মানুষের বিক্ষোভ, প্রতিবাদ চলছিল, স্বাস্থ্যসেবা এবং মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে সর্বত্র সোচ্চার। প্রেস ক্লাবে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। সবাই শিগগিরই একটা পরিবর্তন চাচ্ছিল। প্রশ্ন জাগে, তাহলে এ বিলম্বের হেতু কী? আমাকে কেন আগে যোগদান করতে দেওয়া হলো না?

৬. জেবু হাসপাতালে যাওয়ার পরদিন দুপুরে স্ক্যান রিপোর্ট পাওয়া যায়। তার লাংয়ের ইনফেকশন ৭১%। ডাক্তার বললেন, দু-চার দিন আগে এলে হয়তো এতটা ছড়াত না। তাকে দ্রুত সিএমএইচে স্থানান্তর করা হলো। তৎকালীন সেনাপ্রধানের বদান্যতার কথা ভুলে যাব না। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তাকে বাঁচানো গেল না। আহা! কী কষ্ট আর যন্ত্রণার পর পঞ্চম দিনে সে বিদায় নিল। ভোর রাতেই ঢাকা ত্যাগ করি। তার লাশ গ্রামের বাড়িতে দাফন করে বিকালে ঢাকায় ফিরে আসি। বাসায় আসার আগেই বাচ্চাদের নিয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করি। করোনা টেস্ট করিয়ে নিই। সৃষ্টিকর্তার কী অদ্ভুত বিচার! এবার আমি ছাড়া বাচ্চারা সবাই আক্রান্ত হলো। এদের হাসপাতালে রেখে বাসায় ঢুকি। চারদিকটা হাহাকার করছে। ঘরের ভিতরের শূন্যতা আমাকে ভয়াবহভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছিল। প্রাণহীন ঘরে আমি চিৎকার করে কাঁদছিলাম। হে আল্লাহ! আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও সন্তানদের রক্ষা কর। আমি আর বাঁচতে চাই না। একটু পরই জানতে পারি, অফিস থেকে একজন কর্মচারী এসে নিচে অপেক্ষা করছে। দুটো জরুরি নথিতে নাকি স্বাক্ষর প্রয়োজন। আমি হতভম্ব, বিস্মিত হয়ে যাই। আমি কি আজকেই নথিতে স্বাক্ষর করতে পারি! অবশ্য অনেকক্ষণ পরে সেই নথিতে কলম স্পর্শ করে দিই। ভাবছিলাম, এর নামই জীবন। আর মৃত্যু মানে অফুরন্ত অবসর।

৭. সবকিছু ভুলে গিয়ে প্রায় ১০ মাস স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের দায়িত্ব পালন করি। সে সময়ে করোনার টিকা (vaccine) আমদানি, এশিয়া-ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা, মাঠ পর্যায়ে সশরীরে উপস্থিত হয়ে টিকা কার্যক্রম অবহিতকরণ, বাংলাদেশে টিকা তৈরির সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করা, সাধারণ মানুষের ভুল ভাঙানোর লক্ষ্যে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিজের শরীরে প্রথম টিকা নিই। অবৈধ ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতালের অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করি। দুর্নীতির বিষবৃক্ষের শাখা ধরে সামান্য ঝাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করি মাত্র।

জানতাম একে উপড়ে ফেলা সহজ নয়। করোনাকাল হলেও দূরত্ব বজায় রেখে তখন অনেকই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। শত চেষ্টা করেও আমি সফল হয়নি। আমাকে তারা সবসময়ই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দফতর অবধি পৌঁছাতে নিরুৎসাহ করেছেন। তবু দাফতরিক কাজ নিয়ে দিনরাত ছোটাছুটি করছিলাম। কখনো রাজশাহী কখনো চট্টগ্রামে গিয়ে সভা, সেমিনার করার সময় একদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মহোদয় বলেছিলেন, ‘তুমি কেন এত দৌড়াদৌড়ি করছ? তোমার স্ত্রী গেছে, তুমিও যেতে চাও নাকি?’ একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসেবে তিনি যথার্থই বলেছিলেন। মাত্র কয়েকদিন বাদেই আমি আক্রান্ত হই এবং বাচ্চাদের চাপে রাতেই একটা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাই। তবে পরদিনই শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে স্থানান্তরিত হই। আমার অবস্থা যতটা খারাপ তার ১০ ভাগও আমার ডাক্তার ছেলে আমাকে বুঝতে দেয়নি। অথচ গোপনে আমার জন্য ICU প্রস্তুত করা হয়েছে। হাসপাতাল থেকে সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাস্তবে আমার লাং ইনফেকশনের হার ৪৫%। আমাকে ১৫% বলা হয়েছে। বাচ্চাদের চেহারায় দিগ্বিদিকশূন্যতার ছাপ দেখছিলাম। তাদের দুশ্চিন্তা-বিদীর্ণ মুখ আমাকে বিচলিত করে তোলে। আমার শরীরে একাধিক ইনজেকশন চলমান। সে সময় আকস্মিক একটা ফোন বেজে ওঠে। চেয়ে দেখি, সহকর্মী ও বন্ধু জনপ্রশাসন সচিবের কল। কেমন আছো, জিজ্ঞেস করেই দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ‘তোমার বদলি হয়েছে। সরি, আমার কিছু করার ছিল না।’ আমি বললাম, বন্ধু দোয়া কোরো, আমি আমার সন্তানদের সঙ্গে থেকে কিছুদিন বাঁচতে চাই।

হাসপাতালের বেডে দিব্যি শুয়ে আমি, ওপরের দিকে অপলক চেয়ে আছি। ইনজেকশনের টিউব থেকে ধীরগতিতে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়ছে। বিড়বিড় করছি আমি। মুখে কোনো ভাষা নেই। সন্তানরাই বা কী ভাবছে? বাবা কী অনেক বড় অপরাধ করেছে? মনে পড়ছিল, এর আগেও আমার এমন একটা অনাকাক্সিক্ষত বদলি হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন কমিশনার, চট্টগ্রাম বিভাগ। জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রায় আসন্ন। হঠাৎ করে এবং অনেক অপেক্ষমাণকে চমকে দিয়ে জনৈক কর্তাব্যক্তি বদলি-পদায়ন-পদোন্নতি বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে যান। প্রথম মিশন হিসেবে তিনি হাতে নেন আমার বদলি। আমার বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ-অনুযোগের বিষয় খুবই গর্হিত। আমি তাঁর সম্পর্কে চট্টগ্রাম থেকে সর্বদাই কুৎসা প্রচার করে থাকি। তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে আমি নাকি বরাবরই কার্পণ্য করে থাকি ইত্যাদি। তবে একই কর্মস্থলে আমি একসময় তাঁর উত্তরসূরি (Successor) ছিলাম। কাজেই তাঁর অপরিসীম ক্ষমতার বলে আমাকে চট্টগ্রামেরই জ্বালানি বিভাগের অধীন একটি অধস্তন পদে পদায়নের ব্যবস্থা করে বসেন। বলাবাহুল্য, ১৮২৯ সালে সৃষ্ট বিভাগীয় কমিশনার পদ থেকে ইতঃপূর্বে কেউ এমন পদের পদাধিকারী হয়েছেন বলে কারও জানা নেই। যাক সেদিনও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মানবিক হস্তক্ষেপে আদেশটি তাৎক্ষণিকভাবে জারি হতে পারেনি। আমি সসম্মানে পদে বহাল থেকে যাই।

৮. এক মুহূর্তের ব্যবধানে আমার শরীরটা ঘেমে উঠেছিল। বাচ্চারা শুনে আমাকে সান্ত্বনা দিতে আসে। বাবা, কিছু হবে না, মন খারাপ কোরো না, আগে বাঁচতে হবে ইত্যাদি। ঘণ্টাখানেক যেতেই একই প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির ব্যক্তিগত নম্বর থেকে আরেকটি কল চোখে পড়ে। এবার তিনি বললেন, ‘আপনার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিচ্ছি। আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে। যাক বদলি তো হতেই পারে। আমাদের চাকরিটা এমনই। এই আছি এই নাই। নতুন সচিব আজই দায়িত্ব নিয়ে নেবে। জানেন তো এখন দেশের অবস্থা। সচিব ছাড়া চলবে না।’

আমি বললাম, জি স্যার।

কী আশ্চর্য অনুশাসন! একই কর্তাব্যক্তি একই করোনাকালে চার্জ নিতে আমাকে আট দিন অপেক্ষা করতে বললেন। এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছি। এবার এই আমিই সময় পেলাম মাত্র ঘণ্টাতিনের মতো। কী বিচিত্র বিচার-বিবেচনা আমাদের অভিভাবকতুল্য নীতিনির্ধারকদের! সেদিন আমাকে হাসপাতালের বেডে রেখে স্রেফ একটা বানোয়াট নাটক সাজিয়ে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। সিভিল সার্ভিসের সুদীর্ঘকালে এটাকে নজিরবিহীন বলা যায়। নিকট অতীতে এমন নিষ্ঠুরতা অন্য কারও ক্ষেত্রে হয়েছে বলে কেউ জানে না। এখানে উল্লেখ করা সংগত যে, আমার এমন বদলির খবর পরদিন একটা অনলাইন পত্রিকা প্রকাশ করে। তারা লিখে, ‘একটা অমানবিক বদলি’! পরে শুনেছিলাম, বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকন্যা জানতেন না। আমার অসুস্থতার যথাযথ তথ্য নাকি তাঁকে দেওয়া হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে আমার সারা জীবনের লালিত শ্রদ্ধা এবং ধারণা এমনই। আমাদের মানবিক এবং অসাধারণ সংবেদনশীল প্রধানমন্ত্রীর হাতে এমনটা কখনো হতে পারে না। বরং এটা হতে পারে শুধু আমাদের কিছুসংখ্যক হঠাৎ পাদপ্রদীপের আলোয় আসা অসামাজিক, অমানবিক ও অপরিণামদর্শী আমলার হাতে।

লেখক : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক

সর্বশেষ খবর