শুক্রবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে!

মেজর আখতার (অব.)

খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে!

সম্প্রতি ঋণ পেতে আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। এ ব্যাপারে আইএমএফ বেশ জোর দিয়েছে। এ শর্ত মানতে গিয়ে দেশের তাবৎ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বেশ চাপে আছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মূল ব্যবসাই হলো ঋণ দেওয়া ও নেওয়া। শতভাগ ঋণ আদায় বিশ্বের কোনো দেশেই হয় না। সব ব্যবসায়ই লাভ ও লোকসান আছে। ব্যাংকের ব্যবসায়িক লাভ শনৈ শনৈ বেড়ে যায় যখন সুদাসলে সব ঋণ ব্যাংকের ভল্টে ফিরে আসে। আর লোকসান গুনতে হয় তখনই যখন সুদ আদায় হয় না। কিন্তু আসল মাইর যায় না যদি না অবৈধ কাউকে ঋণ দেওয়া হয় বা ঋণের নামে ব্যাংকের কর্মকর্তারা টাকা লোপাট করে দেন।

ঋণখেলাপি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ঋণ অনাদায় থাকতে পারে যা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লোকসান। সাধারণত ঋণ অনাদায় হয় ঋণদাতা ও গ্রহীতাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির কারণে। ঋণদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে অত্যন্ত স্পষ্ট বোঝাপড়া, আস্থা ও বিশ্বাস না থাকলে ঋণ যেমন দেওয়া হয় না এবং পাওয়াও যায় না। আধুনিক বিশ্বে ঋণ দেওয়া ও পাওয়ার জন্য কতগুলো নির্দিষ্ট নিয়ম বা প্রটোকল অনুসরণ করা হয়, যার নিশ্চয়তার মাধ্যমে ঋণের লেনদেন হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত নিয়মাবলি বা প্রটোকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে সন্তোষজনক না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো গ্রাহককে ঋণ বিতরণ করার সুযোগ নেই। কাজেই খুব সোজাসাপ্টা বলা যায়, ঋণ অনাদায়ের জন্য একমাত্র ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষই দায়ী।

কোনো গ্রাহকই ঋণ ফেরত দিতে কখনই অস্বীকার করে না। তবে হয়তো সময়ের হেরফের হয়। গ্রাহক খুব ভালো করেই জানে, যদি সে ঋণ ফেরত না দেয় তাহলে ভবিষ্যতে আর কখনও ঋণ পাবে না। ঋণ মানুষ কখনই শখ করে নেয় না। সে তার অতীব প্রয়োজন বিশেষ করে জরুরি প্রয়োজনে ঋণ নিয়ে থাকে। অন্যের কাছে ঋণ বা আগেকার ঋণ পরিশোধ করা যে কোনো মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ প্রয়োজন। তাই প্রতিটি মানুষকে তার জীবনের সেই অতীব প্রয়োজন মেটাতেই ঋণের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হয়। ফলে সে কখনো ঋণ পরিশোধ করতে অস্বীকার করে না। কিন্তু কতগুলো চরম বাস্তবতার কারণে মানুষ সময় ও শর্ত মোতাবেক ঋণ পরিশোধ করতে পারে না। কিন্তু তাকে নতুন করে সুযোগ-সুবিধা দিলে অবশ্যই সে ঋণ পরিশোধ করতে সব সময়ই এগিয়ে আসবে। ঋণ আনাদায়ের মূল কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ভ্রান্ত ঋণনীতি। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের ব্যাপারে সব সময় অনাহূত হস্তক্ষেপ করে এবং বিভিন্ন ধরনের নিয়মকানুন বেঁধে দেয় যা পরিপালন করা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মানা সম্ভব হয় না। কিন্তু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভয়ে প্রতিবাদও করতে পারে না। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনো দাতব্য চিকিৎসালয় বা এতিমখানা নয় যে, দানখয়রাতে চলবে। তারা সরকারের বেহুদা প্রতিষ্ঠানও নয় যে, জনগণের মালে ফুর্তি করে বেড়াবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান একটি নিরেট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, যাকে দিনের শেষে মুনাফা করে তার মালিকের ঘরে পুঁজি ফিরিয়ে দিতে হবে। মালিককে পুঁজি ফিরিয়ে দিতে না পারলে তার পেট ও মানসম্মান রক্ষা হবে না। মুনাফা নেই, বেতন নেই- এই সহজ নীতিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চলার কথা কিন্তু সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সব উদ্ভট নিয়মনীতি তৈরি করে, যা মেনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাপেরও ক্ষমতা নেই ব্যবসা করে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের নাকের ডগায় বড় বড় ঋণ দিয়ে অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে, যা রোধ করতে জনগণের টাকায় বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অন্যায় ও অনৈতিকভাবে তাদের মূলধন পুনর্ভরণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভ্রান্ত নীতির কারণে লাখো কোটি টাকা সবার চোখের সামনে দিয়ে লোপাট হয়ে যাচ্ছে।

আইএমএফের চাপে ১৯৯০ সালে ঋণ শ্রেণিবিন্যাসকরণ নামে ব্যাংকে যে নতুন নিয়ম চালু করা হয় তার ফলেই মূলত আজ খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। সেদিন বলা হয়েছিল, স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের ব্যাংকব্যবস্থা দীর্ঘদিন নাকি একটি নির্দেশিত ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পরিচালিত হয়েছিল। বিশেষভাবে চিহ্নিত অগ্রাধিকার খাতগুলোয় সরকার কর্তৃক নির্দেশিত সুদে ব্যাংকগুলোকে নাকি ঋণদানে বাধ্য করা হতো। ফলে এসব নির্দেশিত ঋণের বৃহদাংশ নাকি মেয়াদোত্তীর্ণ ও অনাদায়ী হয়ে পড়ে। কিন্তু ঋণগুলো পরিশোধ কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে গণ্য করার জন্য কোনো সুসমন্বিত সময়সূচি এবং সেগুলো শ্রেণিবিন্যাস করার মানসম্পন্ন পদ্ধতি ও নীতিমালা নাকি ছিল না। ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী আড়াই দশকের বেশি সময় বাংলাদেশে ঋণ শ্রেণিবিন্যাস করার বিষয়টি প্রচলিত ছিল না। তখন নাকি কোনো একটি ঋণকে শ্রেণিবিভাজিত বলে গণ্য করার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হতো। ফলে ঋণ শ্রেণিবিন্যাস করার ধারণা এ দেশে ততটা গুরুত্ব পায়নি। ফলে ব্যাংকগুলোর প্রদত্ত ঋণের অধিকাংশ অকার্যকর ও অনাদায়ী হয়ে পড়ে এবং তখন তারা নাকি ব্যাপকভাবে মূলধন ঘাটতির সম্মুখীন হয়। ফলে তখন নাকি দেশের গোটা ব্যাংকব্যবস্থা দায় পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং ভবিষ্যৎ কার্যক্রম চালানো অসম্ভব বলে তখন নাকি পরিলক্ষিত হয়। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিশন অন মানি, ব্যাংকিং অ্যান্ড ক্রেডিট ও বিশ্বব্যাংকের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার আর্থিক খাত সংস্কারের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়। এ সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে ঋণ শ্রেণিবিন্যাসকরণের একটি নতুন পদ্ধতি এবং সম্ভাব্য অনাদায়ী ও লোকসানি ঋণগুলোর ওপর ব্যাংকগুলোর অর্জিত মুনাফা থেকে সঞ্চয় সংরক্ষণের নিয়ম চালু করা হয়। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ক্ষমতায় চেপে থাকা এরশাদকে চাপে রাখতে এবং বাগে আনতে ঋণ শ্রেণিবিন্যাসকরণ পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। কিন্তু ’৯০-এর শেষে এরশাদ চলে যাওয়ার পরও পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারগুলো অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এরশাদের গৃহীত পদক্ষেপ শুধু চালু রাখেনি, বুঝে হোক আর না বুঝে হোক তাকে আরও কঠিন করেছে। আমাদের কিছু আঁতেল আছেন যারা বিদেশিদের ধ্যানধারণা খুবই পছন্দ করেন, তাতে দেশের লাভ হোক বা না হোক। যা-ই হোক, পরে আইএমএফের সুপারিশে ঋণ শ্রেণিবিন্যাসকরণ প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করার লক্ষ্যে, বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে একটি সংশোধিত নীতিমালা চালু করে। পাঁচটি বিভিন্ন পর্যায়ে ডিসেম্বর, ১৯৯৮-এর মধ্যে নতুন শ্রেণিকরণ পদ্ধতির বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়। নতুন পদ্ধতিতে শ্রেণিকরণের জন্য ঋণের মেয়াদকাল আগের তুলনায় বহুল মাত্রায় কমানো হয় এবং শ্রেণিকরণের স্তর বাড়ানো হয়। ঋণ শ্রেণিকরণের প্রক্রিয়া সহজ করার উদ্দেশ্যে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোকে নতুন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। অন্যদিকে নতুন পদ্ধতিতে প্রদত্ত ঋণকে চারটি বিভিন্ন নামে চিহ্নিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ জারি করে। নির্দেশ অনুযায়ী বিভিন্ন ঋণকে চলমান ঋণ, তলবি ঋণ, মেয়াদি ঋণ এবং স্বল্পমেয়াদি কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণ নামে অভিহিত করা হতে থাকে। সংশোধিত পদ্ধতিতে শ্রেণিবিন্যাসকরণ এবং সঞ্চয় নির্ণয়ের জন্যও নতুন নিয়ম চালু করা হয়। তদনুযায়ী প্রথমত, তিন মাস বা ততোধিক কিন্তু ছয় মাসের কম সময় পর্যন্ত কোনো ঋণ অনাদায়ী বা মেয়াদোত্তীর্ণ থাকলে ওই ঋণকে ‘নিম্নমান’, দ্বিতীয়ত, ছয় মাস বা ততোধিক কিন্তু অনধিক এক বছর অনাদায়ী হলে ‘সন্দেহজনক’ এবং তৃতীয়ত, এক বছরের বেশি সময় মেয়াদোত্তীর্ণ হলে ওই ঋণকে মন্দ বা লোকসানি শ্রেণির বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে উল্লিখিত নিম্নমান, সন্দেহজনক এবং মন্দ শ্রেণিভুক্ত ঋণের জন্য যথাক্রমে ২০%, ৫০% ও ১০০% হারে সঞ্চয় সংরক্ষণের নতুন নিয়মও চালু করা হয়। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোকে প্রথম পর্যায়ে বার্ষিক ভিত্তিতে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে যথাক্রমে ষাণাসিক ও ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ঋণগুলো শ্রেণিবিন্যাসকরণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আরও নির্দেশ দেওয়া হয়, ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে শ্রেণিবিন্যাস করার জন্য নতুন, নবায়নকৃত ও পুনঃ তফসিলকৃত ঋণকে নতুন ঋণ হিসেবে অভিহিত করা হবে এবং ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে সঞ্চয় সংরক্ষণ করতে হবে। এ নিয়ম চালুর পর থেকেই খেলাপি ঋণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ যদি কোনো ‘নিম্নমান’ ঋণের জন্য ২৫%, ‘সন্দেহজনক’ ঋণের জন্য ৫০% ও ‘মন্দ বা লোকসানি’ ঋণের জন্য ১০০% হারে সঞ্চয় সংরক্ষণ করতে হয়, তাহলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কি হাওয়ার ওপর ব্যবসা করবে- তা একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

আগেই বলেছি, ঋণ একটি চলমান প্রক্রিয়া ও অতি তরল পণ্য যা যখন যার হাতেই যায়, সে-ই তার একক ভোক্তা হয়ে যায়। তাই ঋণ কখনই স্থিত রাখা যাবে না। ঋণ সব সময় ঘূর্ণায়মান রাখতে হবে। ঋণ যত বেশি চলমান থাকবে ততই ঋণ ক্রিয়া ও উৎপাদনশীল থাকবে। ’৯০-এর দশকের শুরুতে বলা হয়েছিল, ঋণের আলাদা হিসাব রাখতে হবে এবং এর গুণগত মান সুনির্দিষ্টকরণ করে রাখতে যাতে তার প্রকৃত মূল্য নির্ধারিত থাকে। প্রতিটি পণ্যমূল্য নির্ধারিত হয় তার মান ও ব্যবহার উপযোগিতার ওপর। ঋণ যেহেতু পণ্য, তাই সব সময় তার মান ও ব্যবহার উপযোগিতা বিশ্বাসযোগ্য নির্ধারিত থাকা প্রয়োজন। তাই ১৯৯২ সালে দেশে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে একটি বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান করা হয়। ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা সিআইবি হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ বিভাগ। এ বিভাগ ব্যাংক এবং ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ/লিজ গ্রহীতাদের তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করে। সেই প্রতিষ্ঠানে সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সব ঋণের হিসাব দিতে আইন করে দেওয়া হয়। সেই থেকে খেলাপি ঋণের সব তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কিন্তু সংরক্ষণ করে ফায়দা কী হচ্ছে তা এখন ভাবনার সময় এসেছে। কারণ দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি সময় ঋণের তথ্য রাখার পরও ঋণখেলাপি তো বাড়ছেই। সেই সঙ্গে বাড়ছে উটকো ঝামেলা। কেউ হয়তো তিন বা ছয় মাস বা এক বছর ঋণ দিতে পারল না, তাই তার পক্ষে আর নতুন করে ঋণও নিতে পারে না এবং পুরনো ঋণও শোধ করতে পারে না। কোনো দৈবদুর্বিপাকে বা সরকারের কোনো নীতির কারণে হয়তো কেউ সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারল না; কিন্তু নতুন করে জামানত দিয়ে পুনরায় ঋণ ব্যবসার অবস্থার পরিবর্তন করে পুরনো ঋণ শোধ করার কোনো পথও বাংলাদেশ ব্যাংক রাখেনি।  ফলে খেলাপি ঋণ দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো কারণ শোনে না। সে শুধু টাকা চায়। ডাউন পেমেন্ট চায়। ঋণখেলাপির ঋণ শোধ করার ক্ষমতা থাকুক বা না থাকুক, তাকে ভিটেবাড়ি বিক্রি করে কিছু না কিছু ডাউন পেমেন্ট দিতেই হবে। এ যেন এক অদ্ভুত মানসিকতা! অথচ যথোপযুক্ত জামানত নিয়ে চটজলদি যদি নতুন ঋণ দেওয়া হতো, যেমনভাবে কয়েকটি ব্যাংককে বাঁচানোর জন্য সম্প্রতি ত্বরিত ঋণ দেওয়া হয়েছে, তেমন ঋণ ঋণখেলাপিদের দিলে খেলাপি ঋণ এত দিনে অনেক কমে আসত বলে অনেকেই মনে করেন।

খেলাপি ঋণ কমানোর বা আদায়ের যে পদক্ষেপ বাংলাদেশ ব্যাংক নিচ্ছে তা অচিরেই ব্যর্থ প্রচেষ্টা হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে। খেলাপি ঋণ কমানোর বা আদায় করার তেমন সুযোগ খুব একটা বেশি নেই। তবে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু পদক্ষেপ নিলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতেও পারে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় নিচে কিছু সুপারিশ করা হলো :

১. বিভিন্ন হারে সঞ্চয় সংরক্ষণের নিয়ম বাতিল করতে হবে। ২. ঋণখেলাপিদের নতুন করে উদারভাবে ঋণ দিতে হবে। ৩. বিনা ডাউন পেমেন্টে খেলাপি ঋণ অন্তত ২০ বছরের জন্য ব্লক করে পাঁচ বছরের রেয়াত দিয়ে পরবর্তী ১৫ বছরে ১৫টি বার্ষিক কিস্তিতে পরিশোধের অনুমোদন দিতে হবে। ৪. ব্যাংকের তারল্য চলমান রাখার প্রয়োজনে ব্যাংকের সামর্থ্য অনুযায়ী খেলাপি ঋণের চাপ নিরসনে বার্ষিক ১% সুদ হারে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী ঋণ দিতে হবে। ৫. ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ প্রক্রিয়া আরও সহজতর করতে হবে। খেলাপি ঋণকে শুধু নেতিবাচকভাবে দেখলে হবে না। এ ঋণের সব শুধু অপব্যবহার হয়নি, আজকের অর্থনীতির উন্নয়নের পেছনে এই খেলাপি ঋণের অনেক অবদান আছে। আজকের শিক্ষিত আধুনিক প্রজন্মের পেছনেও খেলাপি ঋণের অবদান রয়েছে। দেশে যতটুকুই শিল্পায়ন হয়েছে তার সিংহভাগ হয়েছে খেলাপি ঋণের টাকায়। দেশে যে ভোক্তাবাজার গড়ে উঠেছে তা সম্ভব হয়েছে খেলাপি ঋণের কারণে। আজ যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী উন্নত জীবনযাপন করছেন তার সংস্থান হচ্ছে খেলাপি ঋণের বদৌলতে। যুক্তরাষ্ট্র সস্তায় যে গার্মেন্ট নিয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু খেলাপি ঋণের কারণেই। আজকের সুন্দর সুন্দর আধুনিক আবাসিক এলাকায়, দৃষ্টিনন্দন বহুতল বাণিজ্যিক ভবনের তলায় তলায় খেলাপি ঋণের গর্বিত অস্তিত্ব রয়েছে। ঋণ হয়তো ব্যাংকের ভল্টে ফিরে যায়নি; কিন্তু জনগণের প্রতিটি ঘরে খেলাপি ঋণের অবস্থান আছে। তাই বিদেশি তথা আইএমএফের চোখে খেলাপি ঋণের পরিমাপ যাচাই না করে নিজের সন্তানের দিকে তাকান। গত ৫০ বছরে সাড়ে ৭ কোটি থেকে ওরা সাড়ে ১৮ কোটি হলো কীভাবে!!! তা হলেই জবাব পেয়ে যাবেন। খেলাপি ঋণ কমানোর যৌক্তিকতা কতটুকু!

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর