বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রাপ্তিগুলো যেরকম উল্লেখযোগ্য, এর ভিতরকার হুমকিগুলোও একই মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ। গত ১৫ বছরে উন্নয়ন হয়েছে বিস্তর, যা ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রচার করতে পারেননি। অন্যদিকে বিরোধী রাজনীতিকরা এই অর্জনগুলোকে অতি অবমূল্যায়ন করতে গিয়ে নিজেদের দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়েছেন। উন্নয়ন মানে বড় বড় ব্রিজ আর মেট্রো নয়। ওটা উন্নয়নের পথ। উন্নয়ন মানে এ থেকে উৎপাদনশীলতা বাড়া ও দীর্ঘমেয়াদে জাতিকে স্বাবলম্বী করা। পদ্মা সেতু বা মেট্রোরেল শুধুই যাতায়াতের স্বস্তিদায়ক অবকাঠামো নয়- এরা জাতির কর্মক্ষমতার মহৌষধ- নানামুখী বিনিয়োগের উপায়, নিয়োগের নতুন দরজা খুলে দেওয়ার উপায় এবং দৈত্যাকৃতি সমস্যা তথা বেকারত্বের প্রশমনকারী। বালিকার জন্য শিক্ষাবৃত্তি শুধু পরিবারে টাকার সংযোজন নয়, এটি একটি জাতিকে বদলানোর হাতিয়ার। এটি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যবান প্রজন্মের গ্যারান্টি।
গত দেড় দশকে অর্থনীতির খাতওয়ারি পরিবর্তন ঘটে গেছে। এখন কৃষি জিডিপির শতকরা ১৫ ভাগ, শিল্প ৩০ ভাগ ও বাকি ৫৫ ভাগ দখল করেছে সেবা খাত। দেশ উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেবা খাতের দখল বাড়বে- এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু এই খাত থেকে গড়ে শতকরা ৬ ভাগের বেশি প্রবৃদ্ধি আসে না। কৃষি খাতে শতকরা ৩ ভাগ প্রবৃদ্ধি হলেই সে এক প্রশংসামূলক খবর। সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি দেওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন খাতের নাম শিল্প। সেখানে ১০ ভাগের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। এতে জিডিপির জন্য বার্ষিক শতকরা ৬.৭৫ ভাগ প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা। কিন্তু ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ৫.৬ ভাগ প্রবৃদ্ধি অনুমান করেছে। দেশকে ২০৫০ সালের আগে উন্নত দেশের কাতারে নেওয়ার জন্য প্রবৃদ্ধি হতে হবে প্রায় দ্বিসংখ্যক- যা কোনোভাবেই বর্তমান সামাজিক সংস্কৃতিতে সম্ভব নয়। দ্রুত সম্পদ বৃদ্ধির রাজনৈতিক সংস্কৃতি দিন দিন আরও পোক্ত হয়ে যাচ্ছে- যা মেনে নিলে প্রাতিষ্ঠানিক উৎকর্ষ বা নিষ্ঠা দিন দিন বিপন্ন হতে বাধ্য। দুর্নীতিকেই সামাজিক প্রথা বলে মনে হবে। তাতে সেবা ও শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি আরও কমে আসবে, বেকারত্ব বাড়বে, মাদক ও সামাজিক বিকৃতি চলমান উৎপাদন প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করবে। উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন হবে সুদূরপরাহত।
চীন একটানা ৩৩ বছর গড়ে যে ‘ডাবল-ডিজিট’ প্রবৃদ্ধি এনেছিল তার মূল ইঞ্জিন ছিল শিল্প খাত। এটি উন্নত হলে সেবা খাতও তরতরিয়ে বাড়ে। উন্নত মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার দেশে উৎপাদিত হলে সেবা খাতেও প্রকৌশল বিদ্যার চাহিদা বাড়ে। বাড়ে প্রশিক্ষণের চাহিদা। তখন শিক্ষিত যুবকরা শুধু সরকারি চাকরির প্রত্যাশায় জীবন প্রণিপাত করবে না। ডাক্তার বা প্রকৌশলী ছাত্ররা শেষতক পুলিশ হওয়ার জন্য আবেদন করবে না। আবার শিল্পকে শক্ত অবস্থানে নিতে হলে অর্থ খাতকে একটি আধুনিক, স্বচ্ছ ও সুশাসন সংবলিত জায়গায় নিতে হবে। এ খাতের বিচার-আচার প্রচলিত আদালতে রাখলে চলবে না। মানুষ সভ্য হলে জমি নিয়ে লাঠালাঠি ও মোকদ্দমা কমে আসে।
কিন্তু অর্থ খাতে মামলা-মোকদ্দমা বাড়ে। এটি উন্নত দেশের বেলায়ও সত্যি। তাই নতুন সরকারের প্রথম বছরের কাজ হবে আইনগত সংস্কার ও অর্থ খাতের জন্য আলাদা বিচার কাঠামো নির্মাণ। অনেক বেশি দক্ষ ও শিক্ষিত জনবল এখানে যুক্ত করে বিচারিক দ্রুতি নিশ্চিত করলে দেশের ‘ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর’ তরতরিয়ে ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ হবে। অতি প্রবীণকে উপদেষ্টা বানিয়ে সর্বত্র নবীন বা মাঝবয়সী নেতৃত্ব নিশ্চিত না করলে অর্থনীতি গতিশীলতা পাবে না। নতুন ধ্যান-ধারণা সৃষ্টি হবে না। অবকাঠামোর প্রতিবন্ধকতা অনেকটাই কেটে গেছে। এখন প্রাতিষ্ঠানিক আমলাতন্ত্র ও বিচারিক গিট্টু বা ‘বটলনেক’ যেন প্রবৃদ্ধিকে পেছনে টেনে না ধরে- তা নিশ্চিত করার কাজটিই হওয়া উচিত নতুন সরকারের প্রথম পদক্ষেপ।
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক