সোমবার, ১ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

স্বাগত ২০২৪ : কথা নয় কাজ চাই

আফরোজা পারভীন

স্বাগত ২০২৪ : কথা নয় কাজ চাই

আজ ১ জানুয়ারি ২০২৪। শুভ নববর্ষ। পুরনোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাব আমরা। নতুন বছরে হবে নির্বাচন। চারদিকে তারই সাজসজ্জা। কে আসবে নতুন সরকারে আমরা জানি না। তবে আশা করছি, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ থাকবে। সংযোজন হবে নতুন নতুন উন্নয়ন পরিকল্পনা। শুধু উপরিকাঠামোর উন্নয়ন নয়, উন্নীত হবে মানবিক কাঠামোও। মানুষের নিরাপত্তা, ভালোবাসা, আবেগের জায়গাগুলোকে সজীব করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেবে নতুন সরকার। নেবে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ।  দেশে উন্নয়ন হয়েছে, হচ্ছে কোনো সন্দেহ নেই। নিজ উদ্যোগে নিজ অর্থে পদ্মা সেতু বানানো কোনো কথার কথা নয়। সেটাও আমরা নির্মাণ করে দেখিয়েছি বিশ্ববাসীকে। কিন্তু আজ আমি বলব, একটু ভিন্নরকম মানবিক চাহিদার কথা।

‘জিরো টলারেন্স’ শব্দটি সবার শোনা। বর্তমান সরকারের পর পর তিন মেয়াদে বারবার শুনেছি আমরা কথাটা। এর একটা চমৎকার বাংলা করা হয়েছে ‘শূন্য সহিষ নীতি’। কথাটা সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সরকারের কর্মকর্তারা বলে থাকেন। নির্বাচনের আগে বারবার শোনা যায় নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মুখে। শব্দটির সহজ বাংলা করলে দাঁড়ায়, কোনো অবস্থাতেই সহ্য করা বা ছাড় দেওয়া হবে না। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, খুন জখম রাহাজানি, আইনশৃঙ্খলার ক্রমাবনতি বা সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রসঙ্গে কথাটি প্রায়শ উচ্চারিত হয়। যখন জোরেশোরে উচ্চারিত হয় জনগণ খানিকটা আশ্বস্ত হয়। ভাবে, সরকার সজাগ আছে যখন তখন বড় রকমের কোনো অঘটন হয়তো ঘটবে না। ধরা পড়ার ভয়ে অপরাধীরা সমঝে চলবে। ধরা পড়লে ভয়ানক সাজা পাবে এই চিন্তায় অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে।

জঙ্গি, সন্ত্রাসবাদ ও সহিংসতা, চরমপন্থা মোকাবিলায় বাংলাদেশের নীতি ‘জিরো টলারেন্স’। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যাতে দেশে ঘাঁটি গাড়তে না পারে, এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ। নানারকম আইন প্রণয়ন হয়েছে। বাংলাদেশের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সব সময়ই সন্ত্রাস ও মৌলবাদের বিপক্ষে। এসব কথাও প্রায়শ উচ্চারিত হয়। আর এর ব্যত্যয়ে বাংলাদেশ ‘জিরো টলারেন্স’ সেটাও আমরা অহরহ শুনি।

কিন্তু বাস্তব চিত্র অতটা সন্তোষজনক নয়। সরকার জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দেন। সংবাদপত্রের বড় কলামজুড়ে সে খবর বের হয়। টেলিভিশনের স্ক্রলে প্রচারিত হতে থাকে। অপরাধী কখনো কখনো গ্রেফতার হয়। আবার জামিনও পায়। দেশত্যাগও করে। ঠিক তখনই কোথাও না কোথাও অপরাধ সংঘটিত হতে থাকে। সে অপরাধের ছবি খবরসহ বের হয়, দুই-চার দিন তার আপডেট পায় মানুষ, উদ্বিগ্ন হয়, বিচার চায়, টকশোর টেবিল তোলপাড় হয়। বড় সড় ঘটনা হলে সভা- সমাবেশ, মানববন্ধনও হয় কখনো-সখনো। যেমন অতীতে অরিত্রির আত্মহত্যার ঘটনা, অদূর অতীতে তনু হত্যার ঘটনা আর সাম্প্রতিক আবরার হত্যাকান্ড। এরপরই নতুন আর একটি ঘটনা এসে আগের ঘটনাটিকে বিস্মৃতির গহনে ঠেলে দেয়। যেন ঘটনাটি ঘটেইনি কোনো দিন। যেমন নীহার বানু, শারমিন, ছালেহা হত্যার কথা আমরা ভুলে গেছি। সাগর-রুনি, বিশ্বজিৎ, ত্বকী, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, তনু, মিতু, রিসা, আফসানা, খাদেজার নাম ভুলতে বসেছি। যেন এমন কোনো নাম কোনো দিন ছিলই না। কোনো ঘটনাই কখনো ঘটেনি। মিতু আর তনুর ঘটনা দুটি খুব মনে পড়ে। স্কুলবাসে বাচ্চা তুলে দিতে এসে খুন হলেন মিতু। দেশজুড়ে কত তোলপাড়, কত কিছু। তারপর কয়েকটা দিন যেতে না যেতে মিতুকে সবাই ভুলে গেল। তনুকে নিয়ে কত আন্দোলন, কত বিক্ষোভ, সভা-সমাবেশ, বিচার চাওয়া এবং না পাওয়া। এসব ঘটল জিরো টলারেন্সের মধ্যেই।

২০১৩ সালে ঘটে যায় শ-খানেক জঙ্গি হামলা। অভিজিৎ, দীপন, রাজীব হায়দার, নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়, অনন্ত বিজয় দাস, ওয়াশিকুর রহমান বাবুর হত্যা এখন আমরা ভুলতে বসেছি। মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ হলো শিশু, এমপি সাহেব মাতাল অবস্থায় গুলি চালালেন সাত বছরের শিশুর পায়ে, এমপিপুত্র জ্যামের জ্বালায় অস্থির হয়ে গুলি চালালেন রিকশাচালকের গায়ে। আরেক এমপি আত্মীয়স্বজনসহ প্রথম হলেন ইয়াবা, মানব পাচার আর মাদকের ব্যবসায়। হাতে গোনা কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অনেকে সগর্বে জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন, সাজার রায়ও হয়েছে তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে। সবই ঘটছে জিরো টলারেন্সের মধ্যে। বর্তমান সরকারের আমলে সম্রাট, পাপিয়াকান্ডে তোলপাড় হয়েছে দেশ। হোলি আর্টিজানে সন্ত্রাস গোটা বিশ্ব কাঁপিয়ে দিয়েছে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলি আমরা। নাসিরনগর আর গোবিন্দগঞ্জে ১৫টি মন্দির ভাঙল, শ-খানেক হিন্দুবাড়িতে আগুন দেওয়া হলো। নাসিরনগরের ঘটনায় উৎসাহিত হয়ে প্রতিমা ভাঙচুর হলো ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা, বরিশালের বানারীপাড়া আর নেত্রকোনার কলমাকান্দাসহ আরও বেশ কয়েকটি স্থানে। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামুতে, ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়ায়, ২০১৪ সালের ২৮ এপ্রিল কুমিল্লার হোমনায় এবং ৫ জানুয়ারি যশোরের অভয়নগরের মালোপাড়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নৃশংস হামলা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। কুমিল্লায় মন্দিরে হনুমানের পায়ের কাছে কোরআন শরিফ রাখা, বিভিন্ন স্থানে প্রতিমা ভাঙা সাম্প্রতিক ঘটনা। শুধু হিন্দু মুসলিম নয়, সাঁওতালরা উচ্ছেদ হয়েছে। জীবন আর সহায় সম্বল হারিয়েছে, নিজ জমিতে বোনা ফসল কেটে নিয়ে গেল দেশিবর্গিরা। অনুসন্ধানে যাই-ই পাওয়া যাক না কেন, মামলা দেওয়া হলো দুর্বল সাঁওতালদের নামে।

মনে হতে পারে, এ তো অনেক আগের ঘটনা, এখন কেন বলছি! বলছি এ কারণে যে, চলছে ধারাবাহিকতা।

জিরো টলারেন্স আসলে কী? কাদের স্বার্থরক্ষায়? এর ভিকটিম কারা? জিরো টলারেন্স কী সাধারণ মানুষের জন্য, যাদের কোনো দল নেই, বল নেই, করার কিছু নেই বা যারা ভিন্ন মতের, স্বভাবতই নাজুক অবস্থানের, তাদের জন্য? প্রশ্নগুলোর উত্তর যাই হোক না কেন, দেশের সার্বিক মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিন্তু আশাব্যঞ্জক নয়। যা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, দেশে নিরাপদ বলয়ে বাস করা মানুষের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। তাই মানুষ ক্রমাগত দেশ ছাড়ছে।

ঘুষ, দুর্নীতি, রাহাজানি, নিরাপত্তাহীনতা লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়েছে। প্রতিটি অফিসে সিটিজেন চার্টার আছে, অভিযোগ বক্স খোলা হয়েছে, সিসিক্যামেরা আছে, শুদ্ধাচার আর নৈতিকতার প্রশিক্ষণ হচ্ছে। সরকারের প্রচেষ্টার অন্ত নেই। তারপরও টাকা পাচার হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে লুটতরাজ। বিদেশে গড়ে উঠছে লুটের টাকায় পল্লী। রাস্তাঘাটে মোবাইল, টাকা-পয়সা, গহনা ছিনতাই হচ্ছে। বাস, উবার, ট্যাক্সি কোনো যানবাহনেই নিরাপদ নন নারী। দুর্ঘটনা বেড়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। যানজট আর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কথা আর নাই বা বললাম।

দ্রব্যমূল্য বেড়েছে লাগামহীনভাবে। কখনো দাম বেড়ে আকাশ ছোঁয় পিঁয়াজ কখনো ডিম। বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। মধ্যস্বত্বভোগী আর সিন্ডিকেট গ্রাস করছে সবই। কর্মাব্যক্তিরা বলছেন, সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না।

প্রয়োজন কার্যকর মোটিভেশনাল কর্মসূচি। অবকাঠামোর উন্নয়ন আর পয়সা থাকলেই যদি দেশ উন্নত হতো, তাহলে সৌদি আরবই হতো বিশ্বের সেরা উন্নত মানবিক দেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারে এসব মানায় না। আমরা জানি তিনি নিজে অসম্ভব রকম সৎ একজন মানুষ। মানুষের মঙ্গল চিন্তাই তাঁর আরাধ্য। নিজের জন্য তিনি কখনোই কিছু চাননি। মৃত্যুভীতি তাঁর নেই। পুরো পরিবার হারিয়েছেন তিনি। দেশের জনগণই তাঁর পরিবার। তিনি দেশের উন্নয়নের জন্য অষ্টপ্রহর দৌড়াচ্ছেন। তারপরও দেশে এসব অপরাধ ঘটছে।

এ কথা ঠিক, আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে দেশের অবস্থা এখন অনেক উন্নত। না খেয়ে রাস্তায় পড়ে মরার মতো অবস্থা নেই দেশে। বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে বিভিন্নভাবে। দেশ এখন আর শুধু চাকরির ওপর নির্ভরশীল নয়। দেশ এখন ডিজিটাল। অনেক কাজ সহজ হয়ে গেছে। অফিসে অফিসে দৌড়ে ফাইলের পেছনে ছোটার ঝক্কি অনেকটাই কমে গেছে। দেশ এখন উন্নয়নশীল। পদ্মা, যমুনা, মধুমতী, কালনা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, অজস্র রাস্তা ফ্লাইওভারে দেশ ছেয়ে গেছে। জঙ্গিবাদ আগের তুলনায় কমেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছেছে স্বাস্থ্যসেবা। নারীরা এগিয়ে এসেছেন। কর্মক্ষেত্রে এখন নারীর সরব পদচারণ। সব হচ্ছে কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে আমরা সংকুচিত। এখনো প্রাণ খুলে একখানা গহনা পরার বা রাস্তায় রিকশায় বসে মোবাইলে কথা বলার মতো স্বস্তিকর পরিবেশ দেশে হয়নি। দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয়নি। দেশটাকে স্বপ্নের দেশ বানানো যায়নি।

একটা গোটা দেশ, একটা বিশাল প্রশাসন যন্ত্র কোনো একক মানুষের পক্ষে চালানো সম্ভব নয়। চারপাশে যে মানুষগুলো আছে তাদেরও সৎ আর দায়িত্বশীল হতে হয়, হতে হয় দেশপ্রেমিক।  নিজে যদি কেউ দুর্নীতি না করে, দুর্নীতি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা অঙ্গীকার করে, তাকে কেন্দ্র করে কোনো দুর্নীতি আবর্তিত হয় না। এভাবে আস্তে আস্তে দুর্নীতিমুক্ত হয় দেশ। কমে যায় অপরাধপ্রবণতা। আমরা বিদেশে যেতে চাই না, দেশেই শান্তিতে থাকতে চাই!

নতুন বছরে প্রার্থনা, অপরাধমুক্ত হোক দেশ। ঝরে পড়ুক আগাছা, দুর্নীতিবাজ আর বেইমান। স্বাগত ২০২৪!

 

লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক, সাবেক যুগ্মসচিব

সর্বশেষ খবর