সোমবার, ১ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

পুলসিরাতে নৌকার মাঝিরা

আলম রায়হান

পুলসিরাতে নৌকার মাঝিরা

নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্ট-এ ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশিত খবর ‘স্থানীয়ভাবে গুঞ্জন রয়েছে- সাদিক আবদুল্লাহ ভোটে ফিরতে না পারলে তার সমর্থকদের রিপনের হয়ে কাজ করার নির্দেশ দেবেন। শেষ পর্যন্ত রিপনকে নিয়ে ঝুঁকি নেবেন সাদিক। আবার সাদিক ভোটে ফিরতে পারলে একেবারেই জয় অনিশ্চিত হয়ে পড়বে জাহিদ ফারুকের।  ফলে নৌকার প্রতিপক্ষ এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী।’ এ প্রতিবেদনে বরিশাল সদর আসনের কথা বলা হয়েছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে ‘নৌকার প্রতিপক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থী’- এ কেবল বরিশাল নয়, সারা দেশেরই বাস্তবতা। ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রধান খবরের শিরোনাম, ‘দলীয় স্বতন্ত্ররাই নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী’। এ ধারায় ফরিদপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সাংবাদিক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান দোলন। শুধু তাই নয়, ফরিদপুরে অন্য এক আসনে ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী সফল ব্যবসায়ী এ কে আজাদ বলেছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা একজোট হয়ে বিরোধী দল গঠন করবে। এ নিশ্চয়ই বাতকেবাত কথা নয়। আবার দৈববাণী মনে করারও জোরালো কারণ নেই। তবে নিশ্চিতভাবে এটি নৌকার প্রার্থীদের জন্য এক ধরনের অশনিসংকেত। সব মিলিয়ে কঠিন বিপদে আছেন নৌকার অনেক মাঝি। তাদের জন্য এবার কেবল নির্বাচন নয়, যেন পুলসিরাত পার হওয়ার পরীক্ষা। যারা জনসম্পৃক্ত তারা সহজেই পার হয়ে যাবেন। আর যারা পুরো মেয়াদে জনগণ হতে দূরে থেকে নৌকা বগলদাবা করে একদিনের ভোটের ভরসায় ছিলেন, তাদের জিভ এর মধ্যেই আধখানা বেরিয়ে যাওয়ার দশা হয়েছে।

উল্লেখ্য, এবারের নির্বাচনে ২৮ দল অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে ২৬ দলের নির্বাচনি পরিসংখ্যানে সম্মিলিতভাবে প্রাপ্ত ভোটের হার ১ শতাংশের নিচে। অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনে মূলত ভোট আছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির। এর মধ্যে জাতীয় পার্টির অবস্থা বেশ নাজুক। মাজা ভাঙা। গত নির্বাচনে এ দলের ১৩৩ জন প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। আর এ গো-হারাদের মধ্যে অন্তত ৫৩ জন এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। এদের কপালে এবারের নির্বাচনে কী যে আছে তা ভবিতব্যই জানে। এমনকি দলের শীর্ষ নেতা হিজড়ার সঙ্গে হেরে বসেন কি না সেটাই এক বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। তার স্ত্রী ঢাকার আসনে পাস করবেন- এমন ভরসাও দেখেন না অনেকেই। আর হেনতেন নামের দলগুলো নিয়ে আলোচনা না করাই বেহেতের। ফলে এবার ভোটযুদ্ধ মূলত হবে নৌকার প্রার্থী এবং আওয়ামী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে। আর বুক ফুলিয়ে নির্বাচনি মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর হচ্ছে- ‘আচরণবিধি বেশি ভাঙছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা’ এবং ‘আ. লীগের ৮৭ শতাংশ প্রার্থী কোটিপতি।’ পত্রিকায় ২২ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রধান খবর- ‘নির্বাচনে সংঘাত করলে রেহাই নেই : প্রধানমন্ত্রী।’ একই দিন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রধান দ্বিতীয় খবরের শিরোনাম হচ্ছে- ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ওপর হামলা বেশি।’ এ থেকে নিশ্চয়ই ভোটের মাঠের অবস্থা বেশ অনুধাবন করা যায়।

এদিকে ভোট গ্রহণের নির্ধারিত দিনটি সফলভাবে অতিক্রম করা নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা কিন্তু এখনো আছে। কারণ এক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াত জোট কোনো প্লেয়ার নয়, মূল প্লেয়ার রয়েছে অন্ধকারে। যার ছায়া অনেকের কাছে স্পষ্ট। ফলে নানান আশঙ্কার মধ্য দিয়েই এগোচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরপরও অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, পর্দার অন্তরালে কঠিন খেলা চললেও সরকার গঠন করবেন শেখ হাসিনাই, তা মেয়াদ যাই হোক। এদিকে সংসদে বিরোধী দল কারা সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। এ নিয়ে ২৬ ডিসেম্বর ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ইইউ প্রতিনিধি দল সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে জানতে চেয়েছে, বিরোধী দল কারা হবে? এ প্রশ্ন রামের জন্মের আগে রামায়ণ রচনার মতো শোনালেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যথার্থই বলেছেন, ‘নির্বাচনের ফলাফলই বলে দেবে।’ এটি মনে করার কোনো কারণে নেই, ইইউ প্রতিনিধি দল বোকার মতো প্রশ্ন করেছে। এ প্রশ্ন আসলে একরকম ফাঁদে ফেলার প্রয়াস। এসব খেলাধুলার বিপরীতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের অনেক মৌলিক সংযোজন আছে। যা কেবল পর্যবেক্ষক মহল নয়, অনুধাবন করছেন আমজনতাও। যা ২০১৪ ও ২০১৮ সাল থেকে এবারের নির্বাচন একেবারে আলাদা। বিগত দুটি নির্বাচনে কুমির ও শিয়ালের যৌথ কৃষিকাজের শিশুতোষ গল্পের বাস্তবে প্রতিফলনের নিদারুণ শিকার হয়েছে বিএনপি। এ গল্পকে ভিত্তি ধরে দৈনিক কালের কণ্ঠে ২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি প্রকাশিত আমার কলামের শিরোনাম ছিল- ‘গল্পের বোকা কুমির এবং বিএনপি।’ এর বেশ পরে প্রথম আলোতে প্রকাশিত মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলামের কলামের শিরোনাম ছিল- ‘বিএনপির নির্বাচন এবং শিয়াল-কুমিরের গল্প।’

আলোচ্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। যে নির্বাচনে সবকিছু ছাড়িয়ে এখন অধিক আলোচনায় নৌকার মাঝিরা। যে নৌকার যাত্রা বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে এবং এ নৌকায় চড়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এদিকে ২৫ ডিসেম্বর রংপুরে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, নৌকা নুহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের। সবাই জানেন এই কিস্তিতে চড়ে কেবল মানুষ নয়, প্রাণিকুলও রক্ষা পেয়েছিল। এদিকে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, শহীদের রক্ত এবং নৌকা অনেকটা সমার্থক। অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংতার মাধ্যমে বাংলাদেশে নৌকাকে প্রতিহত করার অপধারার সূচনা হয়েছিল। সেই ধারা কাটিয়ে ১৯৯৬ সালে কোনোরকম নৌকায় ভর করে বাংলাদেশকে সঠিক ধারায় স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। কিন্তু ২০০১ সালে আবার ছন্দপতন। এরপর অনেক টানাপোড়েন এবং অন্ধকার কাটিয়ে সাত বছরের মাথায় ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের ভোটে আবার ফিরে আসে নৌকা। বেশ দাপটে। এরপর ২০০৯ সাল থেকে টানা চলছে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে উসিলা করে বাংলার আকাশে আবার ঘনীভূত হয় কালো মেঘ। নগ্নভাবে সামনে চলে এসেছে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ। ‘হেনতেন সাতসতেরো’ কথা বলে নির্বাচনকে প্রধান ইস্যু করা হয়েছে। বিষয়টি হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকটাই নির্বাচনের ‘কুমারিত্ব’ রক্ষার মতো বিষয়। এদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের খুচরা মিত্ররা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় মাটি কামড়ে আছে। ফলে ভোটের বিষয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। প্রতিপক্ষ নিশ্চিত ছিল, সরকার ২০১৪ অথবা ২০১৮ সালের পথে আবার পা বাড়াবে। ফলে ভোটের দিন মানুষ ঘরের বাইরে বের হবে না। হয়তো গাইবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে সেই গান, ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’ এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজনীতিতে অনন্য এক কৌশলী পথে হাঁটলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিলেন। এর সঙ্গে রাজনৈতিক মিত্রদের জন্য ছিটেফোঁটা কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার পর নিজ দলের প্রার্থীদের জন্য নৌকা বরাদ্দ দেন। আর দলের সবার জন্য প্রার্থী হওয়ার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যেখানে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে প্রার্থী হলে সোজা বহিষ্কার, সেখানে এবার সংসদ নির্বাচনে দলীয় নেতাদের নৌকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ অবারিত করে বলা হচ্ছে- ‘এটি গণতান্ত্রিক অধিকার।’ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এটি পরপর দুবার গল্পের বোকা কুমিরের পরিণতি ভোগকারী রাজনীতির মাঠে শিশু খেলোয়াড় বিএনপির জন্য বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো একটি মোক্ষম কৌশল। এদিকে এ কৌশলের চক্কর বাঘা বাঘা পর্যবেক্ষকরাও প্রথমে যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারেননি। এ কৌশলের গভীরতা যখন খানিকটা পরিষ্কার হয়েছে ততক্ষণে মৃদুলয়ে নির্বাচনি ভেলা অনেকখানি এগিয়ে গেছে। এখনো নানান আশঙ্কা থাকলেও এ নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি নিয়ে এখন আর তেমন চিন্তা করছেন না সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু চিন্তা করছেন নৌকার মাঝি হিসেবে খ্যাত আওয়ামী লীগ মনোনীতদের অনেকেই। এদের মধ্যে অনেক নৌকার মাঝি আবার অতিরিক্ত মাথা গরম করে ফেলেছেন। পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, বড় দলের মার্কা পেলে ‘কলাগাছ পাস’ এ ধারা থেকে এবারের নির্বাচন অনেক দূরে রয়েছে। এতে খুশি ভোটাররা, অখুশি মার্কাধারীরা। আর অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় আছেন অনেক নৌকার মাঝি। কারণ এদের অনেকেরই নিশ্চিত ধারণা ছিল, নৌকা মার্কা বাগিয়ে নিতে পারলেই কেল্লাফতে! এদিকে সবারই জানা, মনোনয়ন প্রশ্নে বড় দলগুলোর অভ্যন্তরে টংকার লেনদেন ওপেন সিক্রেট। এ বিষয়ে টাকা যেন কাঁঠাল পাতার মতো তুচ্ছ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার কামিনীদেরও হয়তো জামিনী পার করতে হয়। কারণ অনেক ধাপ পেরিয়ে মূল দরবারে পৌঁছতে হয় কারও কারও। এবারও কামিনী-কাঞ্চনের প্রভাব ছিল না তা জোর দিয়ে বলার উপায় নেই।

প্রধান দলের মনোনয়ন পেলে কলাগাছও পাস- এ ধারায় মনোনয়নবাণিজ্যের সূচনা এবং বিকাশ ঘটেছে বহু আগে। এটি দ্রুত বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কারণে এবার দলীয় মার্কায় ‘কলাগাছ’ পাস করার সুযোগ আর থাকল না। বরং পাস-ফেলের বিষয়টি ভোটারদের বিবেচনায় প্রার্র্থীদের আমলনামার ওপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে নৌকাও যা, ঈগলও তা। আর ট্রাকচাপায় মারা না পড়লেও ঈগলের ছোবল তো থেকেই যাচ্ছে। কারণ নৌকা যেমন আওয়ামী লীগ, তেমনই সিংহভাগ ক্ষেত্রে ঈগল ও অন্যান্য স্বতন্ত্র প্রার্থীও আওয়ামী লীগ। ফলে বিগত দিনে মন্ত্রী-এমপি হিসেবে কী করেছেন এ প্রশ্ন জোরেশোরে বিবেচনায় নিচ্ছেন আমজনতা। এটিই এখন প্রধান আলোচ্য বিষয় সাধারণ মানুষের কাছে। ভোটের মাঠেও এ জবাব দিতে হচ্ছে অনেক নৌকার মাঝিকে। জনতার এসব প্রশ্নে বিব্রত অনেকেই। এদের মধ্যে শীর্ষে আছেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল, ত্রাণমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান এবং পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল জাহিদ ফারুক শামীমসহ অনেকেই।  এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীর ভিডিও তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে। এদিকে এক মন্ত্রী তো ঘাড় মটকে দেওয়ার হুংকার দিয়ে বসেছেন। আরও অনেক হুংকারের খবর প্রকাশ হচ্ছে গণমাধ্যমে। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো এ ধরনের খবরে সয়লাব।

স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধান সংশোধন করে সংসদে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। অনেকেই বলছেন, সেই ধারণাই এবারের নির্বাচনে এদিক-ওদিক করে সীমিত পর্যায়ে কপিপেস্ট করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এবারের নির্বাচনি মডেল সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে।  যা রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নের ধারা থেকে খানিকটা হলেও ফিরিয়ে আনবে। যার পথ ধরে আসতে পারে বহুল প্রত্যাশিত সুশাসন। দেখা যাক কী হয়!

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর