শনিবার, ২৫ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

নেদারল্যান্ডসে ভবিষ্যতের খামার

শাইখ সিরাজ

নেদারল্যান্ডসে ভবিষ্যতের খামার

এক প্রাকৃতিক দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন নেদারল্যান্ডসের নাগরিক পিটার ভ্যান উইংগারডেন ও মিনকে ভ্যান উইংগারডেন দম্পতি। তারা ২০১২ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে বিজনেস ট্রিপে গিয়েছিলেন। সেখানে হারিকেন স্যান্ডির মুখোমুখি হন। হারিকেন স্যান্ডি ম্যানহাটনকে প্লাবিত করে। সেখানকার বাসিন্দাদের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দীর্ঘ সময় কাটাতে হয়। ঝড়ের কারণে যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় শহরের খাদ্যপণ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার খাদ্য সরবরাহকারী ট্রাক তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে সেখানকার বাসিন্দাদের অনাহারে কাটাতে হয়েছিল দীর্ঘ সময়। এসব দেখে পিটার ভাবলেন শহরের মাঝেই যদি খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা থাকত, তবে এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো না।

নেদারল্যান্ডসে ফিরে পিটার ও মিনকে ভাবলেন জলবায়ুর পরিবর্তন হেতু এমন দুর্যোগ অহরহ ঘটতে থাকবে। এর জন্য প্রয়োজন পূর্ব প্রস্তুতি। সেই ভাবনা থেকে নেদারল্যান্ডসের রটার্ডাম সমুদ্রবন্দরে গড়ে তুললেন ভাসমান এক খামার। বছর দুই আগে এপ্রিলে নেদারল্যান্ডস গিয়েছিলাম ডেল্টা প্ল্যানবিষয়ক কার্যক্রম দেখতে। সে সময় পিটার ও মিনকে দম্পতির সেই ভাসমান খামার দেখে আসার সুযোগ হয়। রটার্ডাম সমুদ্রবন্দরে ক্যানেলের এক পাশে পানিতে ভাসছে তিন তলা এক গরুর খামার। ভাসমান খামারটির পরিকল্পনা করেছেন পিটার ভ্যান উইংগারডেন। তবে খামারটি পরিচালনা করেছেন তার সঙ্গী মিনকে ভ্যান উইঙ্গারডেন। শহর থেকে দূরে থাকায় পিটারের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়নি। কথা হয়েছে মিনকে ভ্যান উইঙ্গারডেনের সঙ্গে। ভীষণ আন্তরিক মিনকে ভ্যান উইঙ্গারডেন তাদের কার্যক্রম বিষয়ে আমাদের সবিস্তারে ব্যাখ্যা করলেন। তিনি প্রজেক্টরে তাদের প্রজেক্ট সম্পর্কে একটা প্রেজেন্টেশন দিলেন। বললেন, ‘দেখুন আমরা একটা বিচিত্র সময়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। সবকিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে। ঠিক আগের মতো থাকছে না কিছু। না আবহাওয়া, জলবায়ু কিংবা শহর। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল না মেলাতে পারলে আমরা টিকতে পারব না। গবেষণা বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ব জনসংখ্যা ৯.৮ বিলিয়নে বৃদ্ধি পাবে এবং মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭০ জনেরই বসবাস হবে শহরে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শহরগুলোকেও খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে হবে।’

ভাসমান খামারটির দিকে যেতে যেতে মিনকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ভাসমান খামারটি নদীর পানিতে ভাসছে। তীরে খামারের অফিস আর বিক্রয় কেন্দ্র। বিশাল এলাকাজুড়ে গবাদি পশুর বিচরণ ক্ষেত্র। পরিবর্তিত জলবায়ুর ভবিষ্যতের কৃষি নিয়ে বলছিলেন মিনকে ভ্যান উইংগারডেন, ‘যে কোনো পরিস্থিতির জন্যই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। সত্যিকার অর্থেই আমরা জানি না ভবিষ্যতে কী হবে? জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। বিবর্তনের সময়টাতে অভিযোজন করতে না পারলে হয়তো হারিয়ে যেতে হবে। তাই আগামীর কথা চিন্তা-ভাবনা করে এখনই প্রস্তুত হবে। শহরকে খাদ্য উৎপাদনের কেন্দ্র থেকে দূরে রাখলে চলবে না। ফার্মিংয়ের এই ট্রানজেশনকে একসঙ্গে আমরা বলতে চাচ্ছি ট্রান্সফারমেশন।’

২০১৯ সালের ১৩ মে ৩২টি গরু নিয়ে বিশ্বের প্রথম ভাসমান ফার্মটির যাত্রা শুরু। এটি মূলত ডেইরি ফার্ম। এখন এখানে গাভি আছে ৪০টির মতো। মিনকের কাছে প্রশ্ন ছিল- কেন তারা ভাসমান ফার্মের কথা ভাবলেন। তিনি বললেন, ‘দেখুন কৃষি জমির পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে। শহর বাড়ছে। আজ যেখানে বিশাল ভবন তৈরি হচ্ছে, সেটা হয়তো ছিল কৃষি জমি। এটা সত্য যে, মানুষের বসবাসের জায়গার কথা ভাবতে হবে, পাশাপাশি ভাবতে হবে সতেজ নিরাপদ খাদ্যের কথাও। কৃষি জমির বিকল্প ব্যবহার এবং নগরের মানুষদের সতেজ খাদ্য সরবরাহের কথা চিন্তা করেই আমাদের এই উদ্যোগ। আরও একটি বিষয় আমরা স্পষ্ট করতে চেয়েছি, সেটা হলো নগরের মানুষদের সচেতন করা, তোমরা দেখ কোথা থেকে তোমাদের খাদ্য আসে। আবার যে সব দেশ পানিবেষ্টিত, বিশেষ করে সিঙ্গাপুরের মতো দেশ, তারা তাদের খাদ্যের শতকরা ৯০ ভাগই আমদানি করে। তারা চাইলেও ভাসমান খামার গড়ে সতেজ খাদ্য উৎপাদন করতে পারে।’

বুঝতে পারলাম তাদের মূল লক্ষ্যটা কী। ভবিষ্যৎ কৃষি বাণিজ্যের একটা খাত তারা উদ্ভাবন করে নিয়েছেন। ভাসমান খামারটির অবকাঠামো মূলত স্টিলের তৈরি। উপরের অংশটি অবশ্য শাদা প্লাস্টিক কাগজে ছাওয়া। ভাসমান বলে পানি বাড়লে পানির সঙ্গে খামারটি উপরে আসে, আবার পানি কমলে নিচে নেমে যায়। ফ্লোটিং ফার্মের তিনটি অংশ। প্রথম অংশে অর্থাৎ নিচে রয়েছে রিসার্স সেন্টার। মাঝখানে প্রসেসিং ফ্লোর আর একদম ওপরে রয়েছে গরু। মিনকের কাছে জানতে চাইলাম, এই ভাসমান খামারের যে নির্মাণ কাঠামো, আপনার কি মনে হয় না এটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ?

তিনি বললেন, ‘এখন এটাকে ব্যয়সাপেক্ষ মনে হলেও আপনি যদি সময়সাপেক্ষে এর উৎপাদন হার হিসাব করেন অবাক হবেন। সবচেয়ে বড় কথা যেখানে আপনি কৃষি খামার গড়ার মতো জায়গা পাচ্ছেন না সেখানে এমন কি এই পদ্ধতি আপনাকে আশান্বিত করবে সতেজ নিরাপদ খাদ্যের জোগানে।’ অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এই খামারটির একটি বড় বৈশিষ্ট্য। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজটিও এখানে চলছে রোবটের সাহায্যে। এমনকি মিল্কিং পার্লারটিও রোবোটিক। পুরো খামারটিতে তারা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার রেখেছেন। মিল্কিং রোবট এবং ম্যানুউর রোবট ওপরের অংশে কাজ করে। রোবটই সব নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রতিটি গাভির কলারে চিপ রয়েছে। গাভিগুলো যখন অনুভব করে দুধ দেওয়ার সময় হয়েছে তখন রোবট সংকেত পেয়ে যায় এবং রোবটই দুধ দোহানোর কাজটি করে থাকে। মনে পড়ে গেল ২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডসের ডো মার্কে গরুর খামারে গিয়ে অবাক হয়েছিলাম। আধুনিক প্রযুক্তির বিস্ময়কর ব্যবহার খামারটিকে দিয়েছিল অন্যরূপ। ইন্টারনেট অব থিংস বা আইওটি কৃষিতে যে বৈপ্লবিক রূপান্তর আনছে যেন তারই প্রমাণ। একে বলা হয় স্মার্ট প্রযুক্তি। বছর তিনেক আগে আমাদের দেশেও স্মার্ট গরুর খামার গড়ে তুলতে এগিয়ে এসেছিলেন শিল্প উদ্যোক্তারা। তার ধারাবাহিক যাত্রা এখনো চলমান।

যাই হোক, ভাসমান খামারটির বর্জ্য বা পানি যাই বলি না কেন প্রতিটি উপকরণেরই পুনঃব্যবহার চলছে। সাসটেইনেবল এবং সার্কুলার ফার্মিংয়ের এক উদাহরণ এই ফ্লোটিং ফার্ম। সবকিছুই একটা সার্কেলে আবির্ভূত হচ্ছে। গরুর খাবারের জন্য তারা সংগ্রহ করছে শহরের মানুষের ফেলে দেওয়া খাবার, ফুটবল মাঠের ঘাস। শহরের সুপারশপ থেকে শুরু করে বাড়ি ঘরের ফেলে দেওয়া জৈব বর্জ্যই এই খামারের গরুগুলোর প্রধান খাবার। রুটি, সবজি, আলু শহরের দোকানগুলো যে খাবার মেয়াদোত্তীর্ণ বলে ফেলে দিচ্ছে, সেগুলোই এখানে রূপান্তরিত হচ্ছে গরুর পুষ্টিকর খাবার হিসাবে। এতে খাদ্য উপকরণের সর্বোচ্চ ব্যবহার যেমন নিশ্চিত করা সম্ভব যাচ্ছে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও এটি রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। খামার থেকে উৎপাদিত দুধ শহরের মানুষকে দিচ্ছে। গরুর গোবর থেকে সার তৈরি করছে শাকসবজি ফলানোর জন্য। ঠিক এমনটাই হবে ভবিষ্যতের কৃষির ধরন। ভাসমান খামারের পাশেই বড় এলাকাজুড়ে অসংখ্য সোলারপ্যানেল। সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুতেই মিটছে খামারের বিদ্যুৎ চাহিদা। খামারের ছাদের গঠনটি এমন যে সেখান থেকে বৃষ্টির পানি তারা ধারণ করে রাখে। মিনকে বলছিলেন, তারা বিশ্বাস করেন ভালো দুধ উৎপাদনের জন্য গরুকে যেমন পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে, তেমনি এদের রাখতে হবে স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবেশে। তার ভাষায়, ‘গরুকে আমরা সবসময়ই বদ্ধ অবস্থায় রাখি না। প্রাণির স্বাস্থ্যকর পরিবেশ খুব জরুরি। সকালে খাবার শেষে গরুগুলো আপনা-আপনি মাঠে চলে আসে। আবার বিকালে নিজের ইচ্ছায় ওপরে উঠে যায়। এখানে তাদের পর্যাপ্ত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কোনো কিছুতেই প্রাণীর ওপর জোর খাটানো হয় না।’

খামারের কোনো কিছুই যেন ফেলনা নয়। গরুর গোবর ও মূত্র থেকে তৈরি করা হচ্ছে জৈবসার। পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করা এ খামারটি তিন বছরে সফল একটি উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। নগর কৃষির উদাহরণ হিসেবে বিশ্ববাসীর নজরে চলে এসেছে ইতোমধ্যে। বাড়ছে এখানে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা। আর তাই উদ্যোক্তারা পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন আরও বড় পরিসরে। তাদের উৎপাদিত সারকে ব্যবহার করার জন্যই খুব শিগগিরই ভাসমান সবজির প্লট করবে বলে জানালেন মিনকে। তার পাশেই হবে মুরগির। সবই হবে ভাসমান। শুধু রর্টাডামেই নয়। অদূর ভবিষ্যতে অন্য শহরেও তারা ছড়িয়ে পড়তে চান।

খামারে উৎপাদিত দুধ এলাকার মানুষদের চাহিদার একটা অংশ পূরণ করে। আবার দুধ থেকে তৈরি হয় দই, মাখন, চিজ প্রভৃতি। এসব উৎপাদিত পণ্য অনলাইনে বিক্রি হয়। আবার খামারের একপাশে রয়েছে বিক্রয় কেন্দ্র। খামার ব্যবস্থাপনার উল্লেখযোগ্য দিকটি হচ্ছে সার্কুলার ইকোনমি। পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রশ্নে সারা বিশ্বই এখন সার্কুলার ইকোনমির দিকে ঝুঁকছে। ফ্লোটিং ফার্মের খামার ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে, উৎপাদন, বিপণন এমনকি বর্জ ব্যবস্থাপনা সবকিছুই পরিবেশবান্ধব এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য।

ফ্লোটিং ফার্মের মতো ব্যয়বহুল ভাসমান খামার ব্যবস্থাপনার জন্য আমাদের সাধারণ খামারিরা হয়তো এখনো প্রস্তুত নন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ আবহাওয়ার আভাস আমরা ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছি। অসময়ে বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা রকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিনিয়তই। উন্নত বিশ্ব আগামীর কৃষিকে নিয়ে যেভাবে ভাবছে, ভবিষ্যতে টিকে থাকার প্রশ্নে সে ভাবনাকেই হয়তো আমাদের অনুসরণ করতে হতে পারে। আমাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় এনে আগামীর খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে। সে ক্ষেত্রে ফ্লোটিং ফার্মের মতো উদ্যোগগুলো হতে পারে চিন্তার উৎস, ভবিষ্যৎ ভাবনার অনুপ্রেরণা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর