শনিবার, ২৫ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

সবচেয়ে অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত

আল্লামা মাহ্মূদুল হাসান

মানুষের আত্মার খোরাক হিসেবে অনেক ইবাদত রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত হচ্ছে নামাজ। এই ইবাদতের সর্বাধিক বড় ফায়দা হচ্ছে, নামাজ নাজাতের জন্য গ্যারান্টি দেয়। হাদিসের দ্বারা বোঝা যায় যে, নামাজের হিসাব প্রথম গ্রহণ করা হবে। যদি বান্দা নামাজের ব্যাপারে দোষী সাব্যস্ত না হয়, তা হলে সে নাজাত পেয়ে যাবে। আল্লাহপাক তাকে ক্ষমা করে দেবেন বলে আশা করা যায়। এখানে প্রশ্ন হয় যে, একজন মানুষ নামাজ পড়ে, অথচ এরপরও গুনাহে লিপ্ত থাকে, তাহলে সে কীভাবে মুক্তি লাভ করবে? এর বিভিন্ন উত্তরের মধ্যে একটি উত্তর আপনাদের সামনে পেশ করছি। আল্লাহপাক ইরশাদ করেন- ‘তুমি তোমার প্রত্যাদিষ্ট কিতাব আবৃত্তি কর এবং সালাত কায়েম কর। সালাত বিরত রাখে অশ্লীল ও মন্দকার্য থেকে।’ এখান থেকে বোঝা যায় যে, নামাজ মানুষকে জাহেরি-বাতেনি তথা প্রকাশ্য-গোপনীয়, অন্তরের, দেহের, ব্যক্তিজীবনের, সামাজিক জীবনের এক কথায় সব ধরনের গুনাহ থেকে মুক্ত রাখে। সুতরাং নামাজি ব্যক্তি গুনাহমুক্ত বিধায় তার অন্য হিসেবের প্রয়োজন হবে না।

প্রশ্ন হয় যে, আমরা নামাজি ব্যক্তিকে যেমন নামাজ পড়তে দেখি তেমনি তাকে গুনাহে লিপ্ত হতেও তো দেখি? এর উত্তর হচ্ছে, নামাজ সহিহ এবং কবুল হওয়ার জন্য শর্ত-শরায়েত রয়েছে। যেমন ইখলাস এবং সুন্নত মুতাবিক নামাজ, নামাজের পূর্বে সুন্নত মুতাবিক আজান, ইকামত; রেডিও-টেলিভিশনের আজান নয়, বরং বেলাল হাবশী, আবু মাহজুরা, উম্মে মাকতুম, সাআদ কুরাজী, আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদের আজানের মতো আজান। অর্থাৎ রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো আজান, যা কিতাবে উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়াও সুন্নত মুতাবিক অজু ইত্যাদি। এসব শর্ত ঠিক রেখে নামাজ আদায় করলে সে নামাজ গুনাহ মুক্তির উপায় হবেই। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-হালাল খাদ্যে সৃষ্ট দেহ নিয়ে বাইতুল্লাহকে কেবলা করে যে ব্যক্তি সঠিক সুন্নত তরিকায় নামাজ পালন করবে আল্লাহ এবং তাঁর রসুল ওই নামাজি ব্যক্তির অভিভাবক হয়ে যান। দুনিয়ার জন্য ও আখেরাতের জন্যও। বোঝা গেল যে, নামাজ মানুষের রুহের খোরাক, দুনিয়া আখেরাতের নিরাপত্তার গ্যারান্টি এবং নাজাত ও হেদায়েতের উপায়। অনেকে বলে থাকে যে, যারা নামাজ আদায় করে না আমরা দেখি তারা খুব শান্তিতে ও সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছে। তারা বিপদমুক্ত, রোগব্যাধিমুক্ত। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। অপরপক্ষে যারা নামাজি এবং ন্যায়পরায়ণ- তারা সর্বপ্রকার বালা-মুসিবত ও রোগব্যাধিতে আক্রান্ত এবং ব্যবসা-বাণিজ্যেও ক্ষতিগ্রস্ত। সুতরাং উপরোক্ত উপকারিতার বাস্তবতা কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর প্রকৃতভাবে বুঝে আসবে যেদিন মৃত্যু হবে। বরং মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেই যখন ‘সাকরাতুল মাওত’ শুরু হবে এবং অদৃশ সবকিছু দৃশ্যমান হয়ে উঠবে, তখন সবকিছুই বুঝে আসবে। আগে যারা ইমান পরিপক্ব করেনি তখনকার বিশ্বাস এবং ইমান কোনো কাজে আসবে না। এ প্রসঙ্গে ইমাম আবু হানিফার (রহ.) একটি ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে। তিনি ছিলেন জ্ঞানের সুপ্রশস্ত ও গভীর সাগর। এ ঘটনাও তার বুদ্ধির গভীরতা এবং তীক্ষèতার প্রমাণ বহন করে। কোনো এক ব্যক্তি তাকে প্রশ্ন করেছিল যে, জান্নাতে কারা যাবে? তিনি বললেন, মুমিনগণ জান্নাতে যাবে। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, জাহান্নামে কারা যাবে? তিনি বললেন, যারা মুমিন। অর্থাৎ যারা জাহান্নামে যাবে তারা সবাই মুমিন হবে। এ উত্তর শুনে লোকটি হতভম্ব হয়ে ইমাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকল, ইমাম সাহেব বললেন, তুমি আমার কথা বুঝতে পারনি তাই হতভম্ব হয়ে গেছ। শোন, মৃত্যুর সময় আখেরাতের অদৃশ্য সবকিছু দৃশ্যময় হয়ে যায়। মৃতের সম্মুখে জান্নাত-জাহান্নাম সবকিছু ভেসে ওঠে। সে ওইদিক তাকিয়ে আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে ইমান আনয়ন করে। এই ইমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু এ সময় ইমান গ্রহণযোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনেও এরূপ বর্ণনা রয়েছে। সুতরাং বোঝা গেল যে, কাফির মুশরিকরা মৃত্যুর সময় ইমান এনে মুমিন হয়ে মৃত্যুবরণ করে এবং জাহান্নামি হয়। এ কথাই ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তাঁর বক্তব্যে বলেছেন।

মৃত্যুর প্রাক্কালে কাফিরের জবান বন্ধ হয়ে যায়। যদি বন্ধ না হতো তাহলে তাদের ওই সময় কালেমা প্রকাশ্যে পাঠ করতে শোনা যেত। তখন চোখের দৃষ্টি আখেরাতের বস্তুর দিকে নিবদ্ধ থাকে। এ কারণে মৃত্যু পথযাত্রীর কাছে গিয়ে তার দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, সে যেন কোন দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি প্রখর হলেও জবান একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। তাই মনে মনে ইমান আনে, কিন্তু এ সময়ের ইমান যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি জবানের প্রকাশ ছাড়া মনে মনে ইমান আনাও যথেষ্ট নয়। যে ব্যক্তি মৃত্যুর সময় মনে মনে ইমান আনে কিন্তু জবানে প্রকাশ করতে পারে না, তার এরূপ ইমান গ্রহণযোগ্য নয়। এর বাস্তব দৃষ্টান্ত হচ্ছে ফেরাউন। সে যখন সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছিল, নাকে-মুখে পানি প্রবেশ করার পর যখন আখেরাতের অদৃশ্য বস্তু তার সামনে দৃশ্য হয়ে উঠল, তখন তার ভুলের অবসান ঘটল। তখন সে স্বীয় ইমানের কথা ঘোষণা দেয়। আল্লাহপাক ওই বিখ্যাত জালিম কাফিরের মৃত্যুকে বিশ্ব মানবতার জন্য পরম শিক্ষণীয় ঘটনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছা করেন। বিধায় অসাধারণভাবে তার জবান খুলে দেন। আর ফেরাউনের মুখ থেকে এই আওয়াজ ফুটে ওঠে- সে বলল, আমি বিশ্বাস করলাম বনি ইসরাইল যে খোদার প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু যেহেতু ইমান গ্রহণের সময় শেষ। তাই আল্লাহপাক তার ইমানকে গ্রহণ না করে ইরশাদ করেন, ‘এখন ইমান আনছো?’ তাই যখন মৃত্যু আসবে, নামাজ উপকারী কি না, নামাজ তরকের শাস্তি কেমন হবে, তা সঠিকভাবেই বুঝে আসবে।

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর