রবিবার, ২৬ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

সমাজভিত্তিক প্যালিয়েটিভ কেয়ার

আসিফ হাসান নবী

সমাজভিত্তিক প্যালিয়েটিভ কেয়ার

নিরাময়-অযোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বা বয়সজনিত কারণে একজন মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ভোগান্তি কমাতে যে পরিচর্যা করা হয় তাকেই বলা হয় প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা প্রশমন সেবা। একটি ভালো মৃত্যুর পূর্বশর্ত হচ্ছে যাপিত জীবনকে সুন্দর করার চেষ্টা করা। এটা না হলে প্রশান্তিময় মৃত্যুর প্রত্যাশা করা যায় না। ভালো মৃত্যুর পূর্বশর্ত হচ্ছে ভালোভাবে বাঁচা। পৃথিবীতে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ আকস্মিক মৃত্যুর শিকার হয়। বাকি ৯০ শতাংশ নানান রোগে ভুগে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়। যখন কেউ জানতে পারে, আর ছয় মাস পর তিনি মারা যাবেন, তখন হঠাৎ করেই তার মনে হয় যেসব বিষয় এতদিন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তার অধিকাংশই এখন অপ্রয়োজনীয় বা অবান্তর। এ বাস্তবতায় মৃত্যুটা যেন সহনীয় হয়, সেই সাহায্যটা এ সময় প্রয়োজন। কিন্তু সাহায্য আসবে কার কাছ থেকে? প্রথমে পরিবার এবং পরে সমাজের কাছ থেকে। এ কথা সত্য যে, মৃত্যুর মুখোমুখি সবাইকেই হতে হবে। এজন্য জানতে হবে, জীবনের শেষ দিনগুলোতে কীভাবে একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়। শুধু জীবনের অন্তিম সময়ে সেবা-শুশ্রষা দেওয়াই নয়, প্যালিয়েটিভ কেয়ার মানুষকে সামনের দিকে তাকাতে উদ্বুদ্ধ করে। এটা একটা জীবনবোধ। সমাজের সবাইকে এই স্বেচ্ছাসেবার কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত হতে হবে। জানতে হবে, জীবনের শেষ দিনগুলোতে কীভাবে একজন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, এতগুলো বছর যে পৃথিবীতে কাটালাম, আমি আসলে কী অর্জন করলাম? আনন্দ, আফসোস, প্রাপ্তি, হতাশা সবই তখন সামনে চলে আসে। জীবনটাকে তখন তিনি তির্যক নানা প্রশ্নের মধ্য দিয়ে বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন। এটাকেই আমরা বলছি ‘মৃত্যুভাবনা থেকে উৎসারিত দর্শন বা চিন্তা’। আবার মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটি কিছুদিন আগেও হয়তো ছিলেন বাড়ির কর্তা। হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করেন, এখন সিদ্ধান্তগুলো অন্যরা নিচ্ছে। তার সঙ্গে সহজে কেউ কথাও বলতে আসছে না। কাছের মানুষেরা হয়তো ভয়ে ভয়েই দূরে থাকছে, যদি মৃত্যু নিয়ে অনাকাক্সিক্ষত কোনো প্রশ্ন তিনি করে বসেন? এভাবে ধীরে ধীরে তিনি নিজের পরিবারেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আমরা কী কখনো ভেবে দেখি, সেই মানুষটির সে সময় কেমন লাগে? ঠিক এখানেই কিছুটা স্বস্তি ও মমতার স্পর্শ নিয়ে আসে প্যালিয়েটিভ কেয়ার।

বর্তমান বিশ্বে সমাজভিত্তিক প্যালিয়েটিভ সেবা দেওয়ার একটি ধারণা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দক্ষিণ ভারতের কেরালা ও হায়দরাবাদ, আফ্রিকার উগান্ডা, তানজানিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সমাজের সবাই মিলে ‘সমাজভিত্তিক প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ নামে এক নতুন মাত্রার সংযোজন করেছে। কেরালা এবং হায়দরাবাদে এই কর্মসূচি বেশ জনপ্রিয়। এই কর্মসূচিতে পরিবারের বাইরে সমাজের বিত্তশালী এবং জনপ্রতিনিধিরাও সম্পৃক্ত হচ্ছেন। সরকারেরও সমর্থন আছে। স্থানীয় আগ্রহীদের স্বল্প প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। সমাজভিত্তিক পদ্ধতিতে কোনো ব্যক্তির প্যালিয়েটিভ কেয়ার প্রয়োজন হলে তাকে দ্রুত সেই সেবার আওতায় আনা হয়। স্বাভাবিকভাবেই বাড়িতে থাকা রোগীরা পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের তত্ত্বাবধানে থাকেন। রোগীর কষ্ট কমাতে এই প্রাথমিক সহায়তা-ব্যবস্থাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং পেশাদারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর মোট মৃত্যুর মধ্যে প্রায় ৭১ শতাংশ মারা যায় ‘অসংক্রমণ রোগে’। এই রোগে আক্রান্ত মানুষের শতকরা ৭০ জন মৃত্যুর আগে তীব্র শারীরিক ব্যথা সহ্য করেন। তাদের তখন এই সেবার প্রয়োজন হয়। ২০১৬ সালে ‘আইসিডিডিআর’বি পরিচালিত এক জরিপে জানা যায়, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ৫৯ শতাংশরই হয় অসংক্রমণ রোগে। মৃত্যুর আগে এই রোগে আক্রান্তদের মধ্যে এক বিশাল সংখ্যার প্রয়োজন হয় প্যালিয়েটিভ কেয়ারের। কিন্তু বাস্তবতা হলো- এত বিপুলসংখ্যক প্যালিয়েটিভ রোগীকে সেবা দেওয়ার জনকাঠামো দেশে গড়ে ওঠেনি। অথচ খুব অল্প প্রশিক্ষণে দেশের স্বাস্থ্যকর্মী বা স্বেচ্ছাসেবক সমন্বয়ে একটি প্রশিক্ষিত ‘সেবা দেওয়ার জনসম্পদ’ তৈরি করা সম্ভব। যারা, আরোগ্যাতীত রোগীদের ব্যথাহীন মৃত্যু নিশ্চিত করা, শ্বাসকষ্টে আরাম দেওয়া, দুর্গন্ধযুক্ত ক্ষতস্থান পরিষ্কার করাসহ সাধারণ সেবা দিতে সক্ষম হবে। ‘প্যালিয়েটিভ-সেবা’ সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থার আওতায় পড়ে না। কারণ গতানুগতিক চিকিৎসা সেখানেই সম্ভব যেখানে রোগীর নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চিকিৎসকের সক্রিয় সহযোগিতা যখন নিরর্থক হয়ে পড়ে, তখনই প্যালিয়েটিভ কেয়ারের কাজ শুরু হয়! বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, প্রতি বছর দেশে নানা কারণে প্রায় ৬ লাখ মানুষের প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা প্রশমন সেবার প্রয়োজন হয়। গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় বয়সজনিত কারণে এ সেবার প্রয়োজন দিন দিন বাড়ছে। তবে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখনো প্রস্তুত নয়। আমরা একটু খোঁজ নিলেই দেখতে পাব আমাদের চারপাশের পাঁচটি পরিবারের মধ্যে অন্তত একটি পরিবারে এক বা একাধিক এই রোগী আছেন। একটি সংসারে একজন প্যালিয়েটিভ রোগী থাকলে রোগীসহ সেই পরিবারের অন্য সদস্যদের যে কী পরিমাণ ভোগান্তি হয় তা ভুক্তভোগীরাই জানে, বাংলাদেশে ডাক্তার এবং প্যারামেডিক্সের যে অনুপাত, তাতে অন্য রোগীদের সেবা দেওয়ার পাশাপাশি এই বিশাল সংখ্যক প্যালিয়েটিভ রোগীর সেবা দেওয়ার মতো প্রশিক্ষিত জনবল অপ্রতুল।

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো- দেশে শহরকেন্দ্রিক সীমিত পর্যায়ে প্যালিয়েটিভ সেবা চালু থাকলেও প্রান্তিক পর্যায়, যেখানে বিশাল জনগোষ্ঠীর বাস তারা এ বিষয়ে অবহিত নন বা এ বিষয়ে সেসব এলাকায় কোনো কর্মসূচিও নেই। যদিও সরকারের একটি সিদ্ধান্ত আছে যে, বিভাগীয় পর্যায়ের হাসপাতালসমূহ এবং ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালগুলোতে প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিট চালু করা হবে। আশার কথা হচ্ছে, আমাদের দেশেও কেরালা মডেল অনুসরণ করে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি বস্তিতে বেসরকারি পর্যায়ে কিছু সেবা দেওয়া হচ্ছে। দেশে প্যালিয়েটিভ কেয়ার তখনই সফলতা পাবে, যখন এটি বাড়ি বাড়ি পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। এজন্য দরকার সমন্বয়ভিত্তিক সামাজিক সচেতনতা এবং কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ।

লেখক : গবেষক

সর্বশেষ খবর