ঈশ্বর যদি বিশ্বাসীদের হয়ে থাকেন তাহলে এ সপ্তাহে তিনি আমেরিকান হয়ে গেছেন। মুখের ওপর দিয়ে যে বুলেট চলে যাওয়ার সময় একটু ঘষা দিয়ে এক কানের কিছু রক্ত বের করে, সংহার করে না, ব্যাপারটি যে দৈব হস্তক্ষেপের ফল এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে? ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর পেনসিলভানিয়ায় হত্যার চেষ্টা ঘটে যাওয়ার পর এরকম কথকতা রিপাবলিকান মতবাদ হয়ে উঠেছে। রিপাবলিকান কনভেনশনে বক্তৃতাকালে একজন পাস্তর (খ্রিস্টান পুরোহিত) বলেন, ‘আমি এটিকে সৌভাগ্য মনে করি না... আমি মনে করি ব্যাপারটা ঈশ্বরের দেওয়া সুরক্ষা। ট্রাম্প এটাই বিশ্বাস করেন।’
রয়টার্সের রিপোর্ট বলছে, ২০২২ সালের এক জরিপে পাওয়া গেছে যে ৭৭ শতাংশ আমেরিকান গড (ঈশ্বর)-এ বিশ্বাস করেন। পক্ষান্তরে মাত্র ৩৯ শতাংশ ব্রিটিশ বিশ্বাস করেন যে গড আছেন। এমন বিশ্বাসের রাজনৈতিক পরিণতি আছে।
জো বাইডেনের প্রচারের জন্য আরও খারাপ পরিসংখ্যান ছিল : ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান উভয় দল মিলিয়ে ৮০ শতাংশ মনে করেন যে, আমেরিকা ‘ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে’ এবং ৮৪ শতাংশ চরমপন্থির হাতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছে। এটি সহজেই রাজনৈতিক যুক্তির রূপ নিয়েছে। পুরুষ এবং নারী এই মহান জাতিকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন একমাত্র গড। সদাশয় গড সেজন্য (ট্রাম্পকে রক্ষার মাধ্যমে) একটি বার্তা পাঠিয়েছেন।
অনেকেরই বিশ্বাস গড হচ্ছেন মানবিক বিষয়গুলোর অভিভাবক। আমেরিকার বাইরের বেশির ভাগ অ-খ্রিস্টান বিশ্বও ওরকমই বিশ্বাস করে, এতে করে আকস্মিক ঘটনা অলৌকিক ঘটনা হয়ে ওঠে। গড ট্রাম্পকে বাঁচিয়েছেন যাতে ট্রাম্প আমেরিকাকে বাঁচাতে পারেন।
গড ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কি বদলে দিলেন? তিনি বলছেন যে, তিনি একজন নতুন মানুষ এবং আমাদের উচিত তাঁকে বিশ্বাস করা। যখন মৃত্যু তাঁর পাশ দিয়ে চলে গেল, যখন অহংকেন্দ্রিক বিষয়গুলো তুচ্ছ এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল তখন তা ভবিষ্যৎকে অনন্য স্বচ্ছতায় আলোকিত করতে পারে। ট্রাম্প প্রথম যখন মিলকওয়াকিতে রিপাবলিকান কনভেনশনে উপস্থিত হন তখন তাঁকে গম্ভীর দেখায়; এ অবস্থাটি যদি তাঁর পরিবর্তন না হয়, তবে কী? তাঁর আচরণে কোনো নাটকীয়তা ছিল না। সুবিধাবঞ্চিত-গ্রামীণ-শ্বেতাঙ্গ-অভিমুখী পার্টিজান রাজনীতিকে পুঁজি করে মাঠে নামা প্রার্থী ট্রাম্প ঐক্য গড়ার ওপর জোর দিয়ে বক্তৃতা করলেন। কনভেনশনের মঞ্চে তখন আমেরিকান সংখ্যালঘুরা প্রাধান্য পেয়েছিল।
ভাষ্যকাররা গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন করেননি, অন্তত করেছেন বলে আমার জানা নেই। সেই হত্যাচেষ্টার আগে ট্রাম্প কি জেডি ভ্যান্সকে তাঁর রানিংমেট মানে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মনোনীত করতেন? ট্রাম্পের অতীত অপমানের স্মৃতি তো দীর্ঘ। তাঁর প্রতিশোধের ইচ্ছা ছিল গভীর। ভ্যান্স, ২০১৬ সালে ‘কখনো ট্রাম্প নয়’ প্রচারাভিযানে শামিল ছিলেন। একবার ট্রাম্পের নীতিগুলোকে ‘গণমানুষের আফিম’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ভ্যান্সের স্ত্রী ঊষা চিলুকুরি ভারতীয় বংশো™ূ¢ত। তাদের সন্তানরা তাই যে কোনো হামবড়া মনোভাব সম্পন্নদের চেয়ে সাংস্কৃতিকভাবে উদার আমেরিকার অংশ। যদি ভ্যান্স তার অতীত মন্তব্যগুলো থেকে সরে এসে থাকেন, তবে ট্রাম্পও সরে এসেছেন। দ্বিতীয় রূপান্তরটি হলো প্রকৃত আশ্চর্য। বিশ্বের অন্যান্য দেশ, যারা ওয়াশিংটনে ক্ষমতার কোনো পরিবর্তনে প্রভাবিত হতে পারে না, ইতোমধ্যেই একটি সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তিত। ৩৯ বছর বয়সি ভ্যান্স কি ট্রাম্প প্রশাসনের ‘প্রকৃত’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো বিশ্ব সংকটে এগিয়ে আসবেন এবং তাঁর কৃতীর জন্য ট্রাম্প প্রতিক্রিয়াগুলো পরীক্ষা করে আলোচনার জায়গা খুঁজে পাবেন? আমরা ইতোমধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ন্যাটোর ভবিষ্যতে ট্রাম্পের প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। এটি কোনো কাকতালীয় নয় যে, ইউক্রেনের নেতা জেলেনস্কি নভেম্বরের মধ্যে, যখন মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল জানা যাবে, আসন্ন আলোচনার গুণাবলি দেখতে শুরু করেছেন। ক্ষমতাসীন হলে ট্রাম্প তিন মাসের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াতে বাধ্য করবেন (জার্মানির ক্ষেত্রে এটি দ্বিগুণ করতে)। ট্রাম্প তাঁর খাজাঞ্চিখানার টাকাকড়ি আমেরিকানদের কল্যাণে ব্যয় করবেন। বার্তাটি কোনো বিকৃতি ছাড়াই চাউর হয়েছে। বেইজিং অবশ্যই শুনেছে যে, ভ্যান্সের দৃষ্টিতে আমেরিকার জন্য আসল বিপদ হলো চীন। তাইওয়ানের জন্য খারাপ খবর হলো যে, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে হবে। আঙ্কেল স্যাম ডোনাল্ডের ওই খরচা বহন করার দিন শেষ।
ট্রান্স আটলান্টিক একটি জোট, যা প্রাথমিক সমস্যায় ভুগছে তা হলো ‘বিশেষ সম্পর্ক’ ব্রিটেনের সঙ্গে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার হয়তো ইতোমধ্যেই ডেভিড ল্যামিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনোনীত করার সিদ্ধান্তের জন্য অনুতাপ করছেন। ২০১৮ সালে ট্রাম্পের ব্রিটেন সফরের প্রাক্কালে ‘নিও-নাজি সহানুভূতিশীল সমাজবিরোধী’, ‘টোপিতে এক স্বৈরাচার’ এবং ‘আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার জন্য একটি গভীর হুমকি’ হিসেবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন ল্যামি। খুব অস্পষ্ট নয়। ট্রাম্প একবার অভিযোগ করেছিলেন যে, তাঁকে খুব খারাপভাবে আপ্যায়ন করা হয়েছে। তখন ল্যামি টুইট করেছিলেন আততায়ীর হাতে চার মার্কিন প্রেসিডেন্টকে প্রাণ দিতে হয়েছে বরফকুচি হয়ে। গড কি ট্রাম্পকে এতটাই বদলে দিয়েছেন যে তিনি আমেরিকান এবং ব্রিটিশ উভয়কে উদারতা দেখাবেন?
আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতি গড রচনা করবেন না। কিন্তু এটি ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করবে, এমনকি পরোক্ষভাবে হলেও। গণতন্ত্রে বক্তৃতায় বাগাড়ম্বর থেকে নেওয়া শব্দ দিয়ে শিরোনাম পয়দাকরণ সাধারণ ব্যাপার হলেও, ভ্যান্স হয়তো ভেবেছিলেন তিনি সেই কায়দায় শিরোনাম হবেন। তাই তিনি প্রশ্ন তোলেন- ব্রিটেন কি পারমাণবিক অস্ত্রধারী প্রথম ইসলামী দেশ হবে?
স্টারমারের মন্ত্রিসভার অর্ধেক এবং ৪০ শতাংশ সংসদ সদস্য তাদের শপথ গ্রহণ করেছেন রাজার নামে। কারণ তারা গডে বিশ্বাস করেন না অথচ তারা সেই দেশের এমপি যে দেশের আদর্শ বাক্য হলো ‘গড সেভ দ্য কিং’! যখন ব্রিটিশরা উভয় সৃষ্টিকর্তা এবং রাজায় বিশ্বাস করতেন তখন এটি ঠিক ছিল। আজ, তারা কোনো কিছুর প্রতি বিশ্বাস করেন না, রাজতন্ত্রের প্রতি বিরাগসূচক কথাবার্তায় তারা ধর্মত্যাগের কষ্টের চেয়ে বেশি কষ্ট পান।
অজ্ঞতা লেবার পার্টির কোনো অসুখ বা গুণ নয়। অজ্ঞতা বিস্তৃত আছে ব্রিটেনের খ্রিস্টধর্মের সব অংশে। রবিবার বিকালে গির্জায় গেলে দেখা যায়, সেখানে ধর্মগীতির পরিবর্তে যেন ডিস্কোর চলছে প্রস্তুতি। শেষ কবে কোন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী প্রার্থনার জন্য গির্জায় গিয়েছিলেন? উল্টো, ঋষি সুনাক তার পারিবারিক দেবতাদের ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে (প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে) স্থাপন করেছিলেন। কিয়ার স্টারমার একজন ঘোষিত নাস্তিক, তার স্ত্রী ইহুদি। প্রধানমন্ত্রী প্রতি শুক্রবার তার পরিবারের সঙ্গে সাবাথ পালন করেন। সংখ্যালঘু ধর্মগুলো ব্রিটেনে জীবিত এবং ভালো আছে। ইসলাম, হিন্দু ধর্ম, শিখ ধর্ম, ইহুদি ধর্ম। মসজিদ, মন্দির, গুরদোয়ার এবং সিনাগগে প্রার্থনা করা হয়। এটি এখন বা কখনো ব্রিটেনকে ইসলামিক করবে না। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতিতে প্রাণবন্ত সংখ্যালঘুদের গতিশীল উত্থান লক্ষ্য করেছে।
গডের অস্তিত্বের জন্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই। তবে রাজতন্ত্রের প্রয়োজন। একটি প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে : ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা যারা সৃষ্টিকর্তাকে কাল্পনিক বলে বাতিল করেন তারা কেন বিশ্বাস করেন যে রাজতন্ত্র বাস্তব? ব্রিটিশ রাজকীয়রা আর কিছুই নয় একটি পোশাক পার্টি নাট্যাভিনয়ের চরিত্র যা সাধারণ জীবনে নিস্তেজ সংগ্রামে কিছু রং যোগ করে। তাদের অসাধারণ নাট্যকলা, সব সঠিক ব্যাকরণ এবং অহংভোল বক্তব্যে রচিত। তারা নিখুঁত উচ্চ শ্রেণির সোপ অপেরা রাজা এবং রানিকে দিয়ে অভিনয় করানো হয়। কোনো রাজা কি কখনো ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য নির্বাচনে জিততে পারেন? তাহলে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কেন কেতাদুরস্ত স্যুট পরা একজন মানুষের (রাজা) সামনে মাথা নত করেন?
ব্রিটিশ রাজতন্ত্র হয়তো একটি মহান সেবা করা থেকে এখনো বঞ্চিত রয়েছে, তা হলো দৈব সেবা।
রাজা, গডকে রক্ষা কর!
লেখক : ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী