বর্তমান বিশ্বের মুসলমানরা চারটি বড় মাজহাবের অনুসরণ করছেন। এ ছাড়া ছোট ও মাঝারি আরও অনেক মাজহাব মুসলিম বিশ্বে ছিল, এখনো আছে। মাজহাব অনেকটা ইনস্টিটিউশনের মতো। কোরআন-সুন্নাহর জটিল বিষয়গুলো গবেষণা করে অনেক সম্ভাব্য মত থেকে একটি মত বেছে নেওয়ার কাজটি করে গেছেন মাজহাবের ইমামগণ। সময়ের প্রয়োজনে একেক স্থানে একেক মাজহাব প্রসিদ্ধি পায়। মাজহাবের প্রধান চারজন ইমামের মধ্যে ইমাম আজম বা বড় ইমাম বলা হয় হানাফি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-কে। অন্য ইমামদের চেয়ে ইমাম আবু হানিফার বিশেষত্ব হলো তিনি সরাসরি সাহাবিদের সান্নিধ্য পেয়েছেন। ফলে ইসলাম ও কোরআন বোঝার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন এটা বলাই বাহুল্য।
ইসলামী গবেষকদের মতে, যারা রসুল (সা.)-এর সাহচর্য পেয়েছেন, তারা সাহাবি। আর যারা সাহাবিদের সাহচর্য পেয়েছেন তাদের বলা হয় তাবেয়ি। খতিব বাগদাদি (রহ.) বলেন, ‘তাবেয়ি বলা হয় যিনি সাহাবিদের সাহচর্য পেয়েছেন।’ সাহচর্য সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন আরেক ইসলামিক স্কলার ইমাম ইবনে সালাহ। তিনি বলেন, ‘সাহচর্য মানে হলো গভীরভাবে কোনো সাহাবির সঙ্গ পাওয়া। কোনো কোনো ইমামের মতে, সাহাবির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে কিংবা তার থেকে কোনো হাদিস বর্ণনা করেছেন এমন ব্যক্তিও তাবেয়ির মধ্যে গণ্য হবেন।’ ইমাম হাকেম অবশ্য আরও সহজ করে বলেছেন, ‘কোনো সাহাবির সাক্ষাৎ পাওয়াই তাবেয়ি হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’
চার মাজহাবের ইমামের মধ্যে কেবল ইমাম আবু হানিফাই সাহাবির সাহচর্য পেয়েছেন। এ সম্পর্কে হাফেজে হাদিস মুহাম্মদ ইবনে সাদ (রহ.) বলেন, ‘ওয়াসিত নামক এলাকার কাজি ছিলেন সাইফ ইবনে জাবের (রহ.)। তিনি বলেন, আমি ইমাম আবু হানিফাকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘রসুলের (সা.) সাহাবি হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) কুফায় এসেছেন। আমি তাকে অনেকবার দেখেছি। তিনি লাল রঙের খেজাব লাগিয়েছিলেন।’ (তাবাকাতুল কুবরা, চতুর্থ খন্ড, ১৩০ পৃষ্ঠা।) ইমাম দারা কুতনি (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহর নবীর সাহাবি আনাসের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন ইমাম আবু হানিফা (রহ.)। (তাবয়িজুস সহিফা, ১৩১ পৃষ্ঠা।) এ ছাড়াও খতিব বাগদাদি তারিখে বাগদাদে, ইমাম জাহাবি তাজকিরাতুল হুফফাজে, হাফেজ ইবনে কাসির আল বিদায়া ওয়ান নিহায়ায়, হাফেজ জাইনুদ্দিন ইরাকি মুকাদ্দিমায়ে ইবনে সালাহ গ্রন্থের শরাহ তাকয়িদু ওয়াল ঈদজাহ গ্রন্থে, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালি তাহজিবুত তাহজিব গ্রন্থে এবং ইমাম সাখাবি (রহ.) ফাতহুল মুগিছে আবু হানিফার (রহ.) তাবেয়ি হওয়ার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন।
ইমামে আজম (রহ.) শুধু যে সাহাবির সাক্ষাৎ পেয়েছেন তা-ই নয়, তিনি বেশ কয়েকজন সাহাবি থেকে সরাসরি হাদিস বর্ণনাও করেছেন। ইমাম খাওয়ারিজমি বলেছেন, ‘ইমাম আবু হানিফার একটি বিশেষ মর্যাদা হলো তিনি সরাসরি সাহাবি থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। মাজহাবের ইমামদের মধ্যে আর কোনো ইমামের এমন সৌভাগ্য হয়নি। ইমাম আবু হানিফা সাহাবিদের থেকে হাদিস বর্ণনার বিষয়ে সব গবেষকই একমত। তবে কতজন সাহাবি থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন এ নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায়।’ (আবু হানিফা ওয়া আসহাবুহুল মুহাদ্দিসুন, ১০ পৃষ্ঠা।)
ইমাম আবু হানিফার প্রধান ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) কিতাবুল আছারে ইমাম আবু হানিফা থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আবু হানিফা (রহ.) হজরত আবদুল্লাহ বিন আবি হাবিব (রা.) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি আবু দারদাকে বলতে শুনেছি, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দৃঢ়তার সঙ্গে এ কথার সাক্ষ্য দেবে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং আমি মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল -তাঁর জন্য জান্নাত ওয়াজি।’
প্রখ্যাত হাদিস সমালোচক ও জীবনীপ্রণেতা ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) হজরত আবদুল্লাহ বিন আবি হাবিব (রা.) সম্পর্কে বলেন, এ মহান সাহাবি হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় উপস্থিত ছিলেন। ইমাম বুখারি ও ইবনে হিব্বানের মতো মুহাদ্দিসগণ তাকে সাহাবি বলে নিশ্চিত করেছেন।
ইমাম আবু হানিফার জীবনীতে তার মর্যাদা সম্পর্কে ইমাম জাহাবি (রহ.) বলেন, ‘তিনি হলেন ইমাম, উম্মতের ফকিহ, ইরাকের আল্লামা ইমাম আবু হানিফা (রহ.)। তিনি হাদিস শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন এবং এজন্য সফর করেন। এ ছাড়া ফিকহ এবং বিশুদ্ধ কিয়াসের ক্ষেত্রে তিনি অন্য সবার চেয়ে ওপরে। ফিকহের ময়দানে তার খেদমত থেকে সবাই উপকৃত হয়েছেন।’ (সিয়ারু আলা মিন নুবালা, পঞ্চম খন্ড, ২৩৬ পৃষ্ঠা।)
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর
www.selimazadi.com