প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রের সঙ্গে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানসহ সরকারের প্রভাবশালী আমলাদের জড়িত থাকা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের সাবেক এক গাড়ি চালকের কোটি কোটি টাকার সম্পদের উৎস খুঁজতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বিসিএস পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় দুর্নীতির সঙ্গে চেয়ারম্যানের একজন গাড়ি চালকের সম্পৃক্ততা চেয়ারম্যানের দিকেও সন্দেহের তীর থাকা অস্বাভাবিক নয়। গত ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার আগে পিএসসির উপ-পরিচালক আবু জাফর ও জাহাঙ্গির আলম ২ কোটি টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার যে অভিযোগ উঠেছে, তার দায় পিএসসি এড়াতে পারে না।
দশকের পর দশক ধরে সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, অসাধুতা, জালিয়াতি চললেও এ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কোনো বিচলন দেখা যায়নি। কোটার বাইরে সাধারণ মেধাবীদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের যেটুকু সুযোগ অবশিষ্ট আছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক পক্ষপাতের মধ্য দিয়ে তাও রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ধারায় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে মেধাবীদের স্থান দেওয়ার পথ রুদ্ধ করে সংরক্ষিত কোটা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে যাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই দুর্নীতিবাজ, অসৎ এবং অযোগ্য হিসেবে এখন প্রমাণিত হচ্ছে। পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক ড্রাইভারসহ ইতোমধ্যে যে ১৭ জনকে আটক করা হয়েছে, তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়াও একইভাবে হয় দুর্নীতির মাধ্যমে কিংবা প্রশ্নপত্র ফাঁসের লেনদেনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল কি না, তা এখন খতিয়ে দেখা জরুরি। এদের নিয়োগের পেছনে কারা সেটাও খুঁজে বের করা প্রয়োজন। শুধু এদের গ্রেপ্তার করে এদের পেছনের কুশীলবরা পার পেয়ে যাবে, তা হতে পারে না। বিসিএস বা সরকারি কর্মকমিশনের দায়িত্ব ও লক্ষ্য হচ্ছে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া। দেখা যাচ্ছে, এখানেই বড় ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে। ইতোমধ্যে কমিশনের দুর্নীতির মাধ্যমে যারা নিয়োগ পেয়েছে, তাদের অনেকেরই দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকা অস্বাভাবিক নয়। সরকারি কর্মকমিশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও শিক্ষক নিয়োগ পর্যন্ত সর্বত্র অনিয়ম-দুর্নীতি, দলবাজি ও স্বজনপ্রীতির মাশুল দিতে হচ্ছে পুরো জাতিকে। নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাসহ পাঁচজন। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির এবং পিএসসির কর্মচারী ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাময়িক বরখাস্ত করেছে পিএসসি। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। ১০ জুলাই পিএসসি থেকে দুদকের সচিব বরাবর এ চিঠি পাঠানো হয়।
পিএসসির প্রশাসন শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব জামিলা শবনম স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অবৈধ উপায়ে সংগ্রহ, পরীক্ষার পূর্বে প্রশ্নপত্র প্রকাশ এবং বিতরণ করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী হিসেবে অপরাধ সংঘটনে জড়িত থাকার অভিযোগে সরকারি কর্ম কমিশনের পাঁচজনসহ অন্যান্যদের আসামি করে পল্টন থানায় মামলা হয়েছে। তাদের নিজ নামে ও তাদের পরিবারের সদস্যের নামে অসাধু উপায়ে অর্জিত ও তাদের জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দখলে রয়েছেন বা মালিকানা অর্জন করেছেন মর্মে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। বলা বাহুল্য, কোটা প্রথা ও দুর্নীতির মাধ্যমে যারা প্রশাসনে রয়েছে, তাদের বেশির ভাগই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা। কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতির খবরকে পর্যবেক্ষকরা ‘টিপস অব আইসবার্গ’ বা হিমশৈলীর চূড়া হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এদের বাইরেও আরও অনেক দুর্নীতিবাজ রয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া অযোগ্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে দক্ষ প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র গড়ে তোলা সম্ভব নয়। দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অফিস-আদালতে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে অনেকে বেপরোয়া দুর্নীতি, লুটপাট ও দেশের স্বার্থবিরোধী অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে হাসপাতালের পর্দা, আবাসিক ভবনের বালিশ ক্রয়ে অবিশ্বাস্য দুর্নীতি এদের মধ্য থেকেই হয়েছে।
দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা এভাবেই রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অপূরণীয় ক্ষতি করে চলেছে। প্রশাসনে এখন শুদ্ধি অভিযান জোরদার করা প্রয়োজন। বিসিএসে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রকৃত মেধাবীরা যাতে সুযোগ পায়, এজন্য পিএসসিকে ঢেলে সাজাতে হবে। সৎ, দক্ষ, মেধাবীদের এখানে নিয়োগ দিতে হবে। পুরো প্রতিষ্ঠানটিকে স্বচ্ছ করতে হবে। নিয়োগ বাণিজ্য, প্রশ্নফাঁস ও স্বজনপ্রীতির পথ চিরতরে বন্ধ করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ধরনের কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ