আল্লাহর ওলিগণ কাউকে ধমক দিলে খুশি থাকা উচিত এবং এ খেয়াল করা উচিত যে, তিনি আমার কল্যাণের জন্য আমাকে ধমক দিয়েছেন। যে যাকে বেশি ধমক দেয় সে তাকে তত বেশি ভালোবাসে, মহব্বত করে। পীর সাহেব কিংবা ওস্তাদ জানেন যে, একে ধমক দিলে সে পালাবে না বরং এসলাহ হবে। আর যে ছাত্রকে বা মুরিদকে ধমক দিলে পলায়ন করে তাকে তারা ধমক দেন না। এগুলো যার বুঝে আসে সে কোনো দিন বেয়াদবি করে না, অসন্তুষ্ট হয় না। হজরত রসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঝেমধ্যে সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে রাগ করতেন, অথচ তাঁরা নবীকে কখনো ভুল বুঝতেন না। একটি ঘটনা মনে পড়ল। ঘটনাটি হলো, এ দেশের একজন পীর সাহেব, যার নাম বললে সবাই তাকে চিনবেন। হাজার হাজার মুরিদ আছে তার। একদা আমি তাদের এক সভায় গিয়েছিলাম, সব মুরিদের সামনেই কোনো এক কারণে ওই পীর সাহেবকে খুব জোরে ধমক দিলাম। সেই পীর সাহেব এখন মাঝেমধ্যে যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় আসেন, তিনি তার এক বয়ানে বলেছেন যে, আমি হুজুরের প্রতি পাগল হয়েছি সেদিন থেকে যেদিন তিনি আমাকে আমার মুরিদদের সামনে ধমক দিয়েছেন। আমি যে পীর সাহেবের কথা বলছি তিনি হলেন হাজি শরীয়তুল্লাহর বংশধর পীর মাওলানা আবদুল্লাহ হাসান। তিনি বলেন, আমার ভুলের এসলাহ করার কিংবা আমাকে কোনো কিছু বলার সাহস আমার এলাকার কারও নেই। কিন্তু তিনি আমাকে যখন আমার সব মুরিদের সামনে ধমক দিয়েছেন তখন বুঝলাম যে, এতদিন আমার ভুল ধরার কেউ ছিল না, আজ তিনি আমার ভুল ধরে আমার দম্ভ ও অহংকারের দেয়াল হেলিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং তিনি আমার কল্যাণকামীই হবেন। আমার এ ভুলটি তো আজকের নয়, ১০ বছর আগের ভুল, তিনি শুধু আমার ভুল ধরেননি ধমকও দিয়েছেন। মনে হয় তিনি আমাকে আম্ভরিক মহব্বতও করেন। এরপর সেই পীর সাহেব আমার কাছে বায়আতও হন।
একদা হজরত ওমর (রা.) নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোনো এক বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। প্রশ্নটি অবস্থার অনুকূলে না হওয়ায় হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, প্রশ্ন কর! তোমার মন যত চায় তত কর! যত প্রশ্ন করবে সবগুলোর উত্তর দেব। ওমর ফারুক (রা.) দাঁড়ানো ছিলেন। তিনি ভয়ে পড়ে গেলেন এবং বললেন, ‘ইয়া রসুলুল্লাহ! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনি যে আল্লাহর কথা বলেন তাঁকে ছাড়া কাউকে আল্লাহ মানি না, আপনি যে ইসলামের কথা বলেন, সেই ইসলাম ছাড়া আর কিছু মানি না এবং আপনাকে রসুল মানি। মাফ করে দিন!’ এগুলো বলে নবীর সামনে শুয়ে পড়লেন। হাদিস শরিফে (বারাকা) শব্দ এসেছে। বারাকা বলা হয় হাত-পা ছেড়ে দিয়ে উট যেভাবে পড়ে যায় সেভাবে পড়াকে। হজরত ওমর (রা.) কথা ও কাজে তথা উভয়ভাবে ক্ষমা চেয়েছেন। ফলে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুশি হয়ে ক্ষমা করে দিলেন।
আমাদের শায়খ হজরত মাওলানা আবরারুল হক (রহ.) দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। বেশ কয়েকটি বিষয়ে তাঁর দুর্বলতা ছিল। আল্লাহতায়ালার শুকরিয়া যে, সেগুলো আমি বুঝতে সক্ষম হয়েছিলাম। তাঁকে দমিয়ে রাখবে কিংবা নরম করবে এমন মানুষ দুনিয়াতে আল্লাহপাক পয়দা করেননি, তবে আমি চিন্তা-ভাবনা করে তালাশ করে তাকে নরম করার কাজগুলো চিহ্নিত করেছি।
যেমন- (১) ভুল হয়ে যাওয়ার পর আমি বলতাম ‘হজরত গলতী হো গায়ি মাআফি মাংগতা হো’ (হজরত ভুল হয়ে গেছে ক্ষমা চাই।) এতে তিনি খুশি হয়ে যেতেন। তিনি রাগ করলেই আমি ক্ষমা চাইতাম। একদা হারাম শরিফে কোনো এক ভুলের কারণে রাগ হয়ে গেলেন, আমি বললাম ‘হজরত গলতি হো গায়ি-মাআফি মাংগতা হো।’ তখন তিনি বললেন, তুমি সব সময়ই বল, গলতি হো গায়ি। এভাবে সব সময়ই দেখেছি ভুল হয়ে যাওয়ার পর ক্ষমা চাইলে নরম হয়ে যেতেন।
(২) গরিবের প্রতি তিনি খুবই দুর্বল ছিলেন। যদি বলা হতো, হজরত! একজন গরিব লোক এসেছেন আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য তাহলে তিনি বলতেন, তাকে আসতে দাও। (৩) অসুস্থদের প্রতিও বড় দুর্বল ছিলেন। একবার সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেব হজরতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কোনো কাজ হলো না। তিনি সাক্ষাতের অনুমতি দিলেন না। অবশেষে আমি আমার কৌশল অবলম্বন করলাম। বললাম হজরত! আমাদের প্রেসিডেন্ট সাহেব খুব অসুস্থ মানুষ, তিনি আপনার কাছে দোয়ার জন্য আসতে চান। তখন হজরত বললেন, হ্যাঁ, তাকে জলদি নিয়ে আস। (৪) দাওয়াতুল হকের প্রতিও বড় দুর্বল ছিলেন। যদি বলা হতো, হজরত! অমুক জায়গায় যাওয়া লাগবে। তিনি বলতেন, সময় নেই কিংবা অন্য কারণ দর্শিয়ে না করে দিতেন। আর যদি বলা হতো, হজরত! দাওয়াতুল হকের কাজের উপযুক্ত জায়গা। তাহলে বলতেন, আচ্ছা চল, সেখানে আগে চল। আমি এ চারটি পয়েন্ট খুব ভালোভাবে মুখস্থ করে রেখেছিলাম। যখন কোনো সমস্যায় পড়তাম তখন এগুলো ব্যবহার করতাম। স্বভাবের ভিন্নতা এখন আপনারা যদি মনে করেন যে, হুজুর! আপনারও এ চারটি কমজুরি আছে, তাহলে আপনাদের ধারণা ভুল হবে। কারণ একেকজনের তবিয়ত ও স্বভাব একেক রকমের হয়। তাই এ কথা ভাববেন না যে, আমার কাছে মাফ চাইলেই আমি মাফ করে দেব, কিংবা গরিবের কথা বললেই দেখা করব। আমি আমার নিয়ম ও স্বভাব মতো চলি। যারা আমার সঙ্গে চলে, তাদের প্রথমে আমার স্বভাব সম্বন্ধে ভালোরূপে অবগত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ