শত্রুর মুখোমুখি মুসলমানরা। জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে জিহাদের ময়দানে নবী বাহিনী। বাঁচলে গাজী মরলে শহীদ-এ মন্ত্র জপতে জপতে একেকজন মুজাহিদ ঝাঁপিয়ে পড়ছেন জালেমের বুকে। দীর্ঘ লড়াই শেষে নিপীড়িত মানুষকে জুলুম থেকে মুক্ত করার সংগ্রামে বিজয় এসেছে মুসলমানদের পক্ষে। আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করতে করতে মুসলমান বাহিনী ফিরে যাচ্ছে নিজেদের তাঁবুতে। এমন সময় দয়াল নবীজি (সা.) ডেকে বললেন, ‘হে আল্লাহর সৈনিকরা! জীবনের মায়া ত্যাগ করে তোমরা যে জিহাদ করেছে, নবুয়াতি ভাষায় সেটা হলো জিহাদে আসগর বা ছোট জিহাদ। তোমাদের অভিনন্দন তোমরা ছোট জিহাদ শেষে এখন বড় জিহাদে পা রেখেছো।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওগো দয়াল নবীজি! বড় জিহাদ কী? আমরা তো জানতাম জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করাই বড় জিহাদ।’ নবীজি (সা.) মিষ্টি হেসে বললেন, ‘যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করার চেয়ে কঠিন জিহাদ হলো নিজের নফসের সঙ্গে লড়াই করা। হ্যাঁ! এটাই বড় জিহাদ।’ (তাখরিজ এহইয়া, হাদিস নম্বর ২৪৫১)
জুলুমের অবসানের জন্য মানুষ যে যুদ্ধ করে, জীবন বিলিয়ে দেয়, অর্থসম্পদ অকাতরে ব্যয় করে; এগুলো সবই ছোট জিহাদ। যদিও বুলেটের সামনে নির্দ্বিধায় বুক পেতে দেওয়া প্রচণ্ড সাহসের কাজ, তবু আল্লাহর রসুলের ভাষায় এটা ছোট জিহাদ। মানুষকে জুলুম থেকে মুক্ত করার জন্য যারা হাসিমুখে জীবন বিলিয়ে দেয় তারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু লাখো প্রাণের বিনিময়েও যদি ওই জাতি পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সভ্য-ভদ্র-মার্জিত হতে না পারে, চুরি-দুর্নীতি-বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়তে না পারে; তাহলে শহীদদের জীবন দেওয়া কখনোই সার্থক হয়ে উঠে না। সভ্য-ভদ্র-মার্জিত জাতি গড়া যেমন সহজ কাজ নয়, তেমনি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ তৈরি করাও ছেলের হাতের মোয়া নয়। এজন্য প্রতিটি মানুষকে সচেতনতার সঙ্গে ইমানের পেছনে মেহনত করতে হয়। লোভ-হিংসা-পরচর্চা থেকে বেঁচে থাকার কঠিন জিহাদে তাকে নামতে হয়। আর এসব এক সপ্তাহ বা এক মাসে অর্জন হয় না। দীর্ঘ চর্চার পর একটি জাতি কোরআনে আঁকা সভ্য জাতিতে পরিণত হতে পারে।
বলছিলাম, নফসের সঙ্গে লড়াই করাই জিহাদে আকবর। নফস নিয়ন্ত্রণ করে পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী হতে পারলেই প্রকৃত স্বাধীনতার সুখ ভোগ করা যায়। ছোটবেলায় পড়েছিলাম বাবুই পাখি আর চড়ুইয়ের কবিতা। বাবুই পাখি নিজের কাঁচা ঘরে থাকে। ঝড়ের দিন বাসা ভেঙে পড়ে যায়। সাপ এসে বাচ্চা নিয়ে যায়। কত কষ্ট। অন্যদিকে চড়ুই পাখি মানুষের বাড়ির দেয়ালে বাসা করে থাকে। ঝড়বৃষ্টি যাই আসুক তার কোনো কষ্ট নেই। এক দিন চড়ুই পাখি বাবুই পাখিকে টিটকারী দিয়ে এসব কথা বলছিল। কবিতায় বাবুই পাখি ছিল স্বাধীন আত্মার প্রতীক। সে চড়ুই পাখির অনেক যুক্তির প্রতিবাদে শুধু একটি কথাই বলেছিল- কাঁচা হলেও সেটা আমার নিজের বাসা, আর তোমারটা যতই নিরাপদ হোক সেটা অন্যের বাসা। স্বাধীন মানুষ কখনো অন্যের ওপর আশা করে বাসা বাঁধে না। সে সব সময় তার শ্রম-মেধা-দক্ষতার ওপর ভরসা করে নির্ভয়ে বাঁচে। কারও চাটুকারিতা করা, গোলামির শেকল গলায় পরার চিন্তাও সে করে না। একটা জাতির বেশির ভাগ মানুষ যখন বাবুই পাখির মতো নির্লোভ, পরিশ্রমী ও সংগ্রামমুখর জীবন হাসিমুখে বরণ করে নেবে, তখনই জাতি বড় হবে।
নির্লোভ জাতি গড়ার জন্য বাবুই পাখির মতো সাহসী মানুষ প্রয়োজন। দুই ধরনের মানুষ বিপ্লব সফল করে। একশ্রেণি বুলেটের সামনে হাসিমুখে বুক পেতে দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনে। আরেক শ্রেণি অর্থবিত্তের লোভ মুছে ফেলে বিজয় সার্থক করে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে বুলেটের সামনে অসংখ্যবার মানুষ বুক পেতে দিয়ে বিজয় এনেছে, কিন্তু পুরো জাতি লোভমুক্ত হতে পারেনি বলে প্রকৃত স্বাধীনতার সুখ আমরা ভোগ করতে আজও পারিনি। ফলে যখনই কোনো আন্দোলন সফল হয়ে বিজয় এসেছে, এর পরপরই লুটতরাজ ও দুর্নীতি আরও বেড়ে গেছে। মানুষের ভাগ্য বদলানোর স্লোগান দিয়ে বদলেছে একশ্রেণি শোষকের ভাগ্য। আসলে রসুলের (সা.) শেখানো ছোট জিহাদ আর বড় জিহাদের কথা ভুলে যাওয়ার কারণেই বারবার আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আল্লাহতায়ালা আমাদের সহায় হোন। সঠিক পথে তিনি আমাদের চলার তৌফিক দিন। আমিন।
লেখক : চেয়ারম্যান বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি পীর সাহেব, আউলিয়ানগর
www.selimazadi.com