শেষ পর্যন্ত ঢাকা মেট্রোপলিট্রন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের লোহার গারদ অপসারণ করা হলো। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এ এক ঐতিহাসিক সাফল্য। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে গারদের ব্যবস্থা, পরাধীন দেশের মানুষের পশুর মর্যাদাও ছিল না। চিড়িয়াখানায় লোহার গারদে হিংস্র পশুদের রাখা হয়। সভ্যসমাজে কীভাবে বিচারালয়ে এমন ব্যবস্থা এতকাল চলে এসেছে বুঝে উঠতে পারিনি। যাদের কোর্ট-কাচারিতে যাতায়াত নেই তাদের বুঝতে অসুবিধা হবে। যাদের যাতায়াত আছে তাদেরও সমস্যা হতে পারে। কোর্ট এলাকায় অভিযুক্তদের রাখার ঘর আছে। সেটাকেও গারদ বলা হয়। সেটা আরও সুন্দর আরও ভালো হওয়া উচিত। কিন্তু আরেকটা গারদ বিচারকরা যেখানে বসে বিচার করেন সেই কোর্টের মধ্যেও লোহার শিক দিয়ে ঘেরা। আমি মূলত সেটার কথা বলছি। একেবারে বিচারকের সামনে বাঁ-দিকে ১০-১৫ জনের দাঁড়িয়ে থাকার মতো একটা খোঁপ থাকে। পাশেই আইনজীবীরা বসেন, অন্য লোকজন বসেন। জিনিসটা দেখতে যেমন বিসাদৃশ্য, তেমনি একেবারেই অমানবিক।
শাহবাগে যখন গণজাগরণ শুরু হয় তখন ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে রাজাকার বলে তার বিচার দাবি করেছিলাম। রংপুরের আশিকুর রহমান, ফরিদপুরের তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিয়াই মোশাররফ হোসেনকে রাজাকার বলে বিচার চেয়েছিলাম। তার জন্য মানহানি মামলা করেছিলেন ভদ্রলোকেরা। রাজাকারকে রাজাকার বললে রাজাকারের মানহানি হয়। কিন্তু স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা যোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার কোনো মানহানি হয় না। মহীউদ্দীন খান আলমগীর তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যার জেলে যাওয়ার কথা, জেলে থাকার কথা তিনি হলেন মন্ত্রী। নেত্রী শেখ হাসিনার আমলে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা তুলনাহীন। পৃথিবীর আর কোথাও এমন ঘটনা ঘটেনি। কত শতবার বলেছি, দেশ কারও বাপ-দাদার সম্পত্তি না, দেশ সাধারণ জনগণের সম্পদ। জনগণকে সম্মান করা, গুরুত্ব দেওয়া সেবকের কাজ। জনগণকে তাচ্ছিল্য করা নয়, কিন্তু তাই করা হয়েছে এবং সব সময় সেজন্য আমাদের বিরোধীদের কাছ থেকে শেখ হাসিনা অনেক অনেক বাহবা পেয়েছেন। সে সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে একজন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে আমার বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করেছিল। খুব সম্ভবত ৫০১ ধারায়, যা জামিনযোগ্য অভিযোগ। আমি গিয়েছিলাম কোর্টে। কোর্ট আমাকে লোহার গারদে ভরেছিল। গারদে দাঁড়িয়েছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। আইনজীবীরা আপত্তি করেছিলেন, শোরগোল করেছিলেন। একজন প্রবীণ আইনজীবী বারবার বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি, বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীকে দেখেছি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কাদের সিদ্দিকীর মাথা হিমালয় পর্বতের চেয়ে অনেক উঁচু। একপর্যায়ে বিচারক আমাকে বাইরে আইনজীবীদের পাশে বসতে দিয়েছিলেন। মহীউদ্দীন খান আলমগীর শেষ দিন পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর হিসেবে যে কাজ করেছেন তার জন্য গেজেট নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি ময়মনসিংহ জেলার ভারপ্রাপ্ত ডিসি ছিলেন। রাজাকার, আল-বদর, শান্তি কমিটি পরিচালনা করে পাকিস্তান সরকারের প্রশংসা পেয়েছেন। সেই একই রকম টাঙ্গাইলের ডিসি রংপুরের আশিকুর রহমান। তিনিও একসময় শেখ হাসিনার মন্ত্রী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইলের সব টাকা লুট করে আনা আশিকুর রহমান আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। সবই হাসিনার কেরামতি। শত-সহস্রবার বলার চেষ্টা করেছি, অধ্যাপক ইউনূস একজন বিদগ্ধ ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তাকে বুকে জড়িয়ে বলতেন, আমার ইউনূস দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। তাকে মাথায় তুলে রাখতেন। তাকে সম্মানের সঙ্গে সারা পৃথিবীতে ছুটে বেড়াতে সাহায্য করতেন। আমার ধারণা, ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পাওয়ার পর স্বস্তিতে এক মুহূর্তও থাকতে পারেননি। যে কারণে তার সমাজকে দেওয়ার, দেশকে দেওয়ার, সারা বিশ্ব মানবতাকে দেওয়ার সুযোগ হয়নি। অশান্তিতেই কেটেছে সময়। শেষের দিকে সকাল-বিকাল কোর্টের বারান্দায় ছোটাছুটিতে তার সমস্ত মেধা-মনন ধ্বংস হয়েছে, যা মানব কল্যাণে কাজে লাগাতে পারতেন। এর জবাব কে দেবে? যাকে দুই-চার দিন আগেও ৬৬৬ কোটি টাকা জরিমানা করা হলো, কর্মচারীদের ঠকিয়েছেন, ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন কত-শত অভিযোগ। এক বা দুই দিন পর তা সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অতিরিক্ত কিছুই ভালো না। আইন তার নিজস্ব গতিতে চললে কারও এমন ভয়াবহ পতন হয় না। অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না, বেশি কিছু করলে আল্লাহ পছন্দ করেন না। সেটাই হয়েছে অতিসম্প্রতি। ভাবতে কেমন লাগে আমাদের প্রধান বিচারপতি আন্দোলনের মুখে বিদেশি দূতাবাসে আশ্রয় নেন। আরেকজন প্রধান বিচারপতি দুর্নীতির দায়ে দেশ ছাড়েন। আমরা কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেব? আমাদের সব আশ্রয় কীভাবে যেন ধীরে ধীরে ধ্বংস হতে চলেছে। পাকিস্তান আমলে বিচার বিভাগ এত কলুষিত ছিল না। যেমনটা এখন হয়েছে।
১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২-এ শ্রদ্ধা নিবেদন এবং বাদ-আসর পবিত্র মিলাদ শরিফ আদায় করতে চেয়েছিলাম। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু জাদুঘর পুড়ে ছারখার করে ফেললে দেখতে গিয়েছিলাম। জীবনে অত বেদনাহত হয়েছি কি না বলতে পারব না। ধ্বংসযজ্ঞ দেখে বলেছিলাম, এর আগে আমার মৃত্যু হলেও ভালো হতো। সঙ্গে এও বলেছিলাম, বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনা এক নয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা জড়িত, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জড়িত। তাই বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনাকে এক নিত্তিতে মাপতে গেলে ভুল হবে। আওয়ামী লীগ সরকার ভুল করেছে, অন্যায় করেছে, আওয়ামী লীগ করেনি। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত এলে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করলে, অন্যায় করা হবে এবং বাংলার মানুষ সে অন্যায় কখনো মেনে নেবে না। এরপর প্রত্যেক দিন ৩২-এর বাড়িতে গেছি। ছাত্রছাত্রীরা বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করেছে, নিজেও করেছি, বাচ্চাদের পরিষ্কার করতে দেখেছি, তাদের খাবার দিয়েছি। সে এক অসাধারণ বাতাবরণ। হঠাৎই কে বা কারা ১৫ আগস্ট পালন এবং ৩২-এর বাড়ি দখলের ঘোষণা দেয়। বিষয়টা একেবারে অবান্তর। অন্যদিকে আমাদের ভাগিনা সকালে এক কথা বিকালে আরেক কথা বলে প্রকৃত আওয়ামী লীগারদের আরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ৩২-এর বাড়ি দখলের ঘোষণা শুনে সারা দেশে এক সাজ সাজ রব পড়ে যায়। আন্দোলনকারীরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং তারা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মাঝখান থেকে উত্তেজনা সৃষ্টি করে নিরীহ বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের ক্ষতিগ্রস্ত ও অপমান অপদস্ত করা হয়েছে। আমি গিয়েছিলাম সকাল ৭টায়। ৩২-এর একেবারে দুই বাড়ি আগে থাকতে কাঁটাতার দিয়ে রাস্তা বন্ধ করা হয়েছিল। কয়েকজন সালাম দিয়ে বলেছিল, আপনি চলে যান, রাস্তা বন্ধ। যারা চলে যান বলেছিল তাদের খুবই সংযত, অমায়িক মনে হয়েছে। ৩০ সেকেন্ডও হবে না, কেউ ঢিল ছুড়ে, কেউ লাঠি দিয়ে গাড়িতে আঘাত হেনে ভেঙে ফেলে। আমার হাতে কাচের গুঁড়া লেগে বেশ কিছু জায়গায় কেটে যায়। বিস্ময়ের ব্যাপার, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ১৬ আগস্ট মাকড়াইয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের গুলি আমার ডান হাতের যে জায়গায় লেগেছিল ঠিক সেখান থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। এত বছর পর আল্লাহ ঠিক ওই জায়গা থেকেই কেন রক্ত ঝরতে দিলেন সে পরম সৃষ্টিকর্তাই জানেন। আমি এসবই আল্লাহর ইচ্ছে হিসেবে মেনে নিয়েছি। মুহূর্তে খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক মানুষ যোগাযোগ করে। আমি তাদের শান্ত থাকতে অনুরোধ করি। কেউ কেউ বলে এটা জামায়াতে ইসলামীর কাজ। তারাই আপনার গাড়ি ভেঙেছে, আক্রমণ করেছে। বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হলে তার প্রতিবাদে অনেক বছর নির্বাসনে কাটিয়েছি। তারপরও দেশে ফিরেছি আজ ৩৪ বছর। ৩৪ বছর জামায়াতের অনেকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। অনেক সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। শিবিরের কত নেতা-কর্মীকে দেখেছি, আত্মীয়-স্বজনের পরিচয়ে দুই-চারজন যে বাড়িতে আসে নাই, কথা হয় নাই, তাও নয়। রাস্তাঘাটে অনেক সময় দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। চরমোনাইর ইসলামী আন্দোলনের অনেক সভা-সমাবেশে গেছি। ইসলামী আন্দোলনের এক নেতা ঢাকা সিটির সভাপতি হেমায়েত উদ্দিন ’৬৯-এ আমাদের সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি করতেন। বড় ভালো মানুষ ছিলেন। তার কারণে ইসলাম পছন্দ অনেকের সঙ্গেই আমার মেলামেশা ওঠাবসা। ইসলাম পছন্দ কেউ আমার গাড়িতে আঘাত করতে পারে এটা বিশ্বাস করি না, আঘাত করলেও বিশ্বাস করব না। অনেকে আবার বলছিলেন, আপনি যেহেতু তারেক রহমানের সমালোচনা করেন এটা অবশ্যই বিএনপির কাজ। আমার তেমনটা মনে হয় না। বিএনপির শত শত হাজার হাজার নেতা-কর্মী আমাকে তাদের গুরুজন হিসেবে ভাবে এবং সম্মান করে। তাহলে কে করেছে? গাড়িটা যখন ভেঙেছে ঘটনা যখন ঘটেছে কেউ না কেউ অবশ্যই করেছে। তারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেউ না। যে কোনো কল্যাণকর আন্দোলনকে যারা বিপথে নিয়ে যেতে চায় সেরকম গুন্ডা-বদমাইশের অভাব কখনো হয় না, তেমনই কেউ করেছে। আর আমাদের দেশে শত বছর আগের চীনের নেশাখোরদের চাইতেও অনেক বেশি নেশায় বুঁদ যুবসমাজ পাওয়া যায়। তাই এটা কারও ওপর অযথাই দোষ চাপানো কোনো কাজের কথা নয়। একটা কেন, আরও একটা গাড়ি ভাঙলে যদি দেশের কল্যাণ হয় আন্দোলন সফলকাম হয়, তাহলে সানন্দে আমি রাজি হব। আমি বলেছি, কোনো জায়গায় কেউ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গেলে তাকে বাধা দেওয়া মানবিক নয়, কাউকে বেঁধে রাখা সেটা মস্তবড় অপরাধ। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে বা বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া যাদের অপমান অপদস্ত করা হয়েছে, বেঁধে রাখা হয়েছে এর অবশ্যই সুষ্ঠু বিচার হতে হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা যা বলেছে আমি তাদের সাধুবাদ জানাই। এরকম ব্যাপক আন্দোলনে ছোটখাটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতেই পারে। এতে আমার মতো একজন বয়সি মানুষ যদি মরেও যাই, তাতেও যদি দেশের কল্যাণ হয়, মানুষের কল্যাণ হয়, সেখানে আমার কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। এ কদিনের কর্মকান্ডে কেন যেন মাঝে মাঝে মনে হয় গত ২৫ বছর আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আমার গাড়ি ভাঙল, সভা-সমাবেশ নষ্ট করল, জেলে পুরল। তারপরও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিজয়ী ছাত্র-যুবক-জনতার কাছে অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগই থেকে গেলাম। বোঝাতে ব্যর্থ হলাম, শেখ হাসিনা আর বঙ্গবন্ধু এক না, হাসিনার সরকার আর আওয়ামী লীগ এক না। আমি বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করেছি। জীবনে কোনো দিন হাসিনা লীগ করি নাই। খুব তাড়াতাড়ি দেশের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে না পারলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব খর্ব হবে। সময় থাকতে সবাইকে সতর্ক হতে অনুরোধ জানাচ্ছি। তবে এটা বলব, আওয়ামী লীগের কারও ৩২-এর বাড়ি দখলের মতো বীরগিরি দেখানো উচিত না, তেমনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেরও লাগাম টেনে ধরা উচিত।
‘অধ্যাপক ইউনূস কত দেশে যান; কিন্তু তার কোট-প্যান্ট-টাই দরকার হয় না। তার পোশাক একটা নতুন ব্র্যান্ড হয়ে গেছে। এ জন্য তাকে সম্মানের চোখে দেখি। ছেলেবেলা থেকে মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখে দেখে বড় হয়েছি। হুজুর মওলানা ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধুকে দেখতাম, যে কোনো কর্মীর প্রশংসা করতে পারলে খুশি হতেন। কাউকে পেলে তার চৌদ্দগুষ্টি পেছন থেকে প্রশংসা করতে শুরু করতেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন, লতিফের ভাই, দারুণ সংগ্রামী। ওর বাবা কত জেল-জুলুম সহ্য করেছে, ওর দাদা কংগ্রেসের রাজনীতি করতেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে মুসলিম লিগ করে পাকিস্তান এনেছেন আরও কত কী। হুজুর মওলানা ভাসানী তো আমাকে কাদরী বলেই খালাস। বাবার নাম জানতেন কি না জানি না। তাঁর কাছে আমি ছিলাম আলাউদ্দিন সিদ্দিকীর নাতি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যখন সুগন্ধ্যায় বসতেন একদিন পি এন হাক্সারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। হাক্সার বলেছিলেন, টাইগারকে আমি চিনি। ওর সঙ্গে আগেও কয়েকবার দেখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে হু আর বুমেদিন, আনোয়ার সাদ’ত, ইদি আমিন, ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সেসব কথা মনে হলে এখনো শিহরণ জাগে। এক দিন অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করতে গিয়ে দেখলাম। দেখলাম তিনিও অকৃপণভাবে অন্যকে তুলে ধরতে, কৃতজ্ঞতা জানাতে পারেন। আমরা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর আঘাত আসার পর থেকেই আমাদের সমর্থন জানিয়ে আসছিলেন। তার কথাবার্তা তার লেখনী বিপদের মুহূর্তে আমাদের সাহস জুগিয়েছে। আজ তার দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নেতৃবৃন্দদের এই সাক্ষাতে আমরা অনেক সাহস পেয়েছি এবং অনুপ্রাণিত হয়েছি। আমি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা ও সবাইকে এই সুযোগে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে এই প্রথম তিনি অকপটে উচ্চারণ করেন, নিরপেক্ষ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনোমতেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতির আকাক্সক্ষা। কারও খামখেয়ালির দায়ভার সমগ্র জাতি বইতে পারে না। কেউ দেশটাকে ধ্বংস করলে আমরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করব না। আমাদের অর্জন অনেক। সে অর্জন কোনোমতেই নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। তিনি রাজনৈতিক দল গঠন করবেন কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, না, তিনি কোনো রাজনৈতিক দল করবেন না। জাতীয় সমঝোতার প্রশ্নে তিনি কোনো ভূমিকা রাখবেন কি না এমন প্রশ্নে খেদ ব্যক্ত করে বলেন, আমার সেই সুযোগ কোথায়? কতজনই তো কত চেষ্টা করছে কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে কই?
সাংবাদিকদের আমি আমাদের কথা বলতে গিয়ে বলেছি, আমরা এবং দেশবাসী যেমন গ্রামীণ ব্যাংককে খন্ড খন্ড করার সরকারি ষড়যন্ত্র বরদাস্ত করব না, ঠিক তেমনি তিনি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর যে কোনো নির্যাতন-নিপীড়ন এবং জুলুমের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার থাকবেন, অভিভাবকের ভূমিকা পালন করবেন। আমরা অধ্যাপক ইউনূসকে দেশ ও জাতির পাহারাদার হিসেবে হিমাদ্রির মতো অটল-অবিচল দেখতে চাই। তিনি তা না করলে দেশবাসী তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। নিশ্চয়ই অধ্যাপক ইউনূস রাজনৈতিক দল না করতে পারেন। এত দল থাকতে দেশবাসী তার কাছে আরেকটি দল খুব একটা প্রত্যাশাও করে না। কিন্তু তিনি দিবসে নিশিথে প্রতি মুহূর্তে দেশের কল্যাণে বিশুদ্ধ রাজনীতি করবেন এবং যা ইতোমধ্যে করে চলেছেন। আগামীতেও তার দেশের জন্য যা করা প্রয়োজন তা তিনি করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। দেখাই যাক আগামী দিন কেমন হয়।’ লেখাটা ছিল সেই ২০১৩ সালের ২৫ আগস্টের।
১৫ দিনও হয়নি অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন ব্রি. (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। একজন যথার্থ সৎ সাহসী-যোগ্য মানুষ। তিনি যে কথাগুলো বলেছেন একটা কথাও অসত্য নয়। তবে সময়োপযোগী নয়। অন্তর্বর্তী সরকার তাকে হজম করতে পারলে আইনশৃঙ্খলার আরও দ্রুত উন্নতি হতো। এখন যাকে দায়িত্ব দিয়েছেন তাকে ব্যক্তিগতভাবে জানি না, চিনি না। তিনি হয়তো আরও ভালো হতে পারেন। কিন্তু সবার আগে দরকার দেশে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। এর আগে কখনো দেশে আইনশৃঙ্খলা এতটা ভেঙে পড়েনি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইনের বাইরে কখনো এতটা বেপরোয়া ছিল না। তাই ভাঙা নাজুক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনুপ্রাণিত করতে উৎসাহিত করতে সাহসী শক্তিশালী মানুষের প্রয়োজন। সরকার যত তাড়াতাড়ি দেশে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে পারবে ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল। তবে একটা জিনিস মনে হয় প্রতিবেশী দেশের থেকে অতিরঞ্জিত করা হচ্ছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর, তাদের উপাসনালয়ের ওপর এই বিশৃঙ্খল অবস্থাতেও তেমন কোনো গুরুতর আঘাত আসেনি। এটা খুবই সত্য যে, তারা এই গুমোট হাওয়ায় অবশ্যই অস্বস্তিতে মারাত্মক দুশ্চিন্তা এবং শঙ্কায় আছে।
তবে এটাও অভাবনীয় সত্য যে, এই প্রথম আমাদের মাদরাসার ছেলেরা হিন্দুদের উপাসনালয়, মন্দির, বাড়ি, দোকানপাট দলবেঁধে পাহারা দিয়েছে। তাই এটা বলাই যায়, আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতার কোনো জায়গা নেই। আমাদের দেশে একজন মসজিদের ইমামও অসাম্প্রদায়িক। ধর্ম পালন আর সাম্প্রদায়িক হওয়া এক কথা নয়। আমরা যে কেউ নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্ম পালন করি। কিন্তু সাম্প্রদায়িক নই। আমরা সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক, যার যার ধর্ম তার তার। আমার ধর্ম সব সময় বলে অন্যের ধর্মে বাধা সৃষ্টি না করতে। আমরা সদা সর্বদা তাই করার চেষ্টা করি। তার মাঝে কিছু দুষ্ট লোক কখনো সখনো অঘটন ঘটায়। তবে সেটাই সত্য নয়।
লেখক : রাজনীতিক
www.ksjleague.com