১. ২০০৮ সালে একজন সাংবাদিক আমাকে প্রশ্ন করলেন- আপনি কি এখনো সংস্কারপন্থি? উত্তরে বলেছিলাম, আমি সংস্কার ছিলাম, আছি এবং থাকব। আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছিলাম যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, তিনি দলীয় প্রধান হবেন না। বলেছিলাম, একই ব্যক্তি যদি সরকার প্রধান ও দলীয় প্রধান হন তাহলে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে। বলেছিলাম, ক্ষমতা কুক্ষিগত নয়, ক্ষমতার সর্বোচ্চ বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য। বলেছিলাম, অসৎ, নীতিহীন, ধান্দাবাজ ব্যক্তি যারা রাজনীতির মুখোশ পরে আছে তাদের বিতাড়িত করা। সাংবিধানিক সংস্থাকে জোরদার করা, স্বাধীন করা। চেয়েছিলাম বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, তা হয়নি। বরং আমাদের বিশেষ করে আমাকে সংস্কারপন্থি ট্যাগ লাগিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
২. দীর্ঘ ১৬ বছর পর যৌবন জলতরঙ্গে গর্জিত তুফানে কর্তৃত্ববাদী শাসকের অবসান হয়েছে ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে। কর্তৃত্ববাদী শাসনে গণতন্ত্র থাকে না, জবাবদিহি থাকে না, স্বচ্ছতা থাকে না এবং জনগণের মালিকানা থাকে না। আন্দোলনকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন রাষ্ট্র সংস্কারে প্রত্যয়ে উদ্দীপ্ত। তাদের সে লক্ষ্য অর্জনের পথ মসৃণ নয়। সংস্কার এক দিনে হয় না, হবে না। তবে সংস্কারের নীতিগত ও বিধিবদ্ধ রূপরেখা তাদের জাতির সামনে উপস্থিত করা জরুরি। জাতির সামনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের এসব বিষয়ে একটি রোডম্যাপ উপস্থাপন করা প্রয়োজন। জনমত নিয়ে সেই সংস্কারগুলো সংবিধান, আইন-বিধিবিধানে অলঙ্ঘনীয় লক্ষ্য হিসেবে গ্রথিত করতে হবে।
৩. যারা নীতি, সততা আর নির্মল সেবার আদর্শে, ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে, জনকল্যাণে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে রাজনীতির অঙ্গনে এসেছিলেন, তাদের অনেকের মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক চালচিত্র নিয়ে প্রচন্ড হতাশা বিদ্যমান। আদর্শ যেখানে প্রতিনিয়ত দলিত, নীতি প্রতিমূহূর্তে বিসর্জিত, কল্যাণ ও সততা যেখানে মুমূর্ষ, প্রতারণা আর প্রবঞ্চনা রাজনীতিবিদ হওয়ার মাপকাঠি, গলাবাজি যেখানে প্রবল, মিথ্যাচার যেখানে সব শুভ ও শুভ্রতা ঢেকে ফেলেছে, পেশি ও কালো টাকা যেখানে রাজনীতিবিদ হওয়ার মাপকাঠি, মিথ্যাচার যেখানে জীবনসঙ্গী, সে অবস্থায় সৎ, নীতিবান, দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের জায়গা কোথায়? অথচ দল ও রাজনীতিবিদ ব্যতীত দেশ চলে না।
৪. তারপরও কথা থেকে যায়। অনেকে রাজনীতি করলেও সবাই রাজনীতিবিদ নন। হতে পারেন না। আদর্শ দ্বারা পরিচালিত ব্যক্তিই রাজনৈতিক পরিমন্ডলে শুদ্ধতা অর্জন করেন। কর্তৃত্ববাদী শাসনে তারাই আজ রাজনীতিবিদ যারা কালো টাকার মালিক কিংবা ঋণখেলাপি। রাতারাতি রাজনীতিবিদ সাজেন। লক্ষ্য, দুর্বৃত্তায়ন এবং ক্ষমতা দখল। আজ রাজনীতিতে পরিদৃষ্ট কালো টাকার মালিক, চোরাকারবারি, সন্ত্রাসীদের গডফাদার, অসৎ আমলা, অসাধু ব্যবসায়ী, কালোবাজারি, রাজকোষের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া দুর্বৃত্তদের প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বিলুপ্ত জাতীয় সংসদে শাসক দলের শতকরা ৬৮ ভাগ শোষক বণিক; রাষ্ট্রক্ষমতা যাদের দখলে ছিল। আর্থিক খাত ধ্বংস করা হয়েছে। ব্যাংক দখল করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ করেছে, ৫০ হাজার কোটি টাকা এস আলমের পকেটে গেছে। নিয়মনীতি না মেনে বেক্সিমকো তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে আরও ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো ঋণ নিয়েছে। অর্থ পাচার হয়েছে ৬ লাখ কোটি টাকা। ঋণখেলাপি ৯২ হাজার কোটি টাকা। আইনের মারপ্যাঁচে খেলাপি হয়েও ঋণ ফেরত না দেওয়া, খুনি সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রভুপিতা, ব্রিজ, মহাসড়ক, টার্মিনালে টোল তোলা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হাট-ঘাট জবরদস্তিমূলক ইজারা নেওয়া ইত্যাকার ঘৃণ্য কর্মকান্ডে লিপ্ত এসব রাজনীতিবিদদের মূল লক্ষ্য। এরা কি রাজনীতিবিদ, নাকি রাজনৈতিক-সামাজিক দুর্বৃত্তায়নের গডফাদার? জনজীবন বিপর্যস্ত। সামাজিক অবক্ষয় চরম পর্যায়ে চলে গেছে।
৫. মানুষ রাজনৈতিক জীব, মহতী এরিস্টটলের কথা আজও সত্য। রাজনৈতিক জীব হলেও সবাই সরাসরি রাজনীতি করেন বা করবেন এমনটি নয়। তারপরও যারা প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি করেন, রাজনীতির নীতি আদর্শের বৃত্তে নিজেকে আবদ্ধ করে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করেন, নিজেকে সুস্থধারায় বিকশিত করেন, সাংগঠনিক কাঠামোর ভিতরে থেকে কর্মকান্ডে শরিক থাকেন, জনপ্রতিনিধি বা রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করেন তাদের নিয়ে কথা হবে। আলোচনা-সমালোচনা হবে এটা স্বাভাবিক। রাজনীতিবিদ কেন, কোনো মানুষই, কেবল গুণের ধারক নন। ভালোমন্দ মিলিয়েই মানুষ। কিন্তু রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে মানুষ এমন করে ভাবতে চায় না। নিজের মধ্যে যা নেই সে দুর্লভ গুণাবলি তার মধ্যে খুঁজে পেতে চায়। তার মধ্যে সততা চায়, সাহস চায়, শক্তি চায়, চায় ন্যায়নীতি। ভাবতে চায় সে হবে ত্যাগী, আদর্শবান, পরোপকারী, সজ্জন। দুর্নীতি, চুরি, মিথ্যাচার, আত্মপ্রতারণা বা প্রবঞ্চনা তাকে স্পর্শ করবে না। নির্লোভ। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে জনকল্যাণে সে থাকবে সম্পূর্ণ নিবেদিত। আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক। দেশপ্রেমিকের সংজ্ঞায় তাকে পেতে হবে হান্ড্রেডে হান্ড্রেড। রাজনীতিবিদদের মধ্যে ইত্যাকার মূল্যবোধের দৃশ্যমানতা তাকে আর ১০ জন থেকে পৃথক করে তোলে। স্বাতন্ত্র্যে, বৈশিষ্ট্যে, সে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়, দশের মধ্যে একক এবং একজন। মানুষ ভক্তি করে। শ্রদ্ধা করে। আপদে-বিপদের আশ্রয়। শুদ্ধ মানুষের রাজনীতিতে আসার বাতাবরণ সৃষ্টি করতে হবে।
৬. বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর থেকে আমরা দোষারোপের রাজনীতি চালু করেছি। কাউকে দোষারোপ করে অনাগত কালের কাছ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না। এই গ্লানি থেকে, জাতিগত অমর্যাদাকর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে মুক্তিযুদ্ধের জন্ম-প্রত্যয়ে ফিরে যেতে হবে। বিশ্বাসে, কর্মে ও আদর্শে পুনরায় প্রমাণ করার সময় এসেছে আমরা সাম্য, সামাজিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ফিরে যেতে হবে আমাদের শিকড় সন্ধানে-বাঙালির শাশ্বত উৎসমুখে। মানবতার পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরা ও শোষণমুক্তি আমাদের অঙ্গীকার। বিদেশি খবরদারি থামিয়ে দিয়ে আত্মনির্ভরশীল, আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে আমাদের দাঁড়াতে হবে। এর বিকল্প কিছু নেই। আমাদের দেশ, সর্বধর্মের, সর্বসাধারণের দেশ, প্রজাতন্ত্রের দেশ। মুক্তিযুদ্ধে রক্তের অক্ষরে যা চির উজ্জ্বল, চির অমলিন।
৭. মহৎ আদর্শ ও দর্শনের মৃত্যু নেই। বাংলাদেশ ‘নেশন স্টেট’। ঐতিহাসিকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর স্থপতি- এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই। ‘বাংলাদেশ’ নামটিও তাঁর দেওয়া। তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে রক্ষণ করা জাতির দায়িত্ব। তিনি বাতিঘর। তাঁকে ব্যবহার করে যারা লুটপাট, দুর্বৃত্তায়ন, সন্ত্রাসী ও মানুষ হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। তাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে ট্যাগ করলে ইতিহাস তা মেনে নেবে না।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ১৯৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী