নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নতুন অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠান থ্রি-জিরো-ক্লাব বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে-‘শূন্য দারিদ্র্য’, ‘শূন্য বেকারত্ব’ এবং ‘শূন্য কার্বন’ নির্গমনের সমন্বয়ে একটি ‘তিন শূন্যে’র নতুন পৃথিবী গড়ার প্রত্যয় যেখানে কেউ চাকরির পেছনে ঘুরবে না- আবার কেউ বেকারও থাকবে না, ধনী ও দরিদ্রের অর্থসম্পদ ও প্রাচুর্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না, আর সম্পদ ও আধুনিক যন্ত্র ব্যবহারে মানুষ এতটাই মনোযোগী ও সুশৃঙ্খল হবে যে বাতাসে কার্বনের পরিমাণ থাকবে শূন্য- থ্রি-জিরো-ক্লাব ১২ থেকে ৩৫ বছর বয়সের মধ্যে সমমনা, সমবয়সি পাঁচজনের একটি সংগঠিত ক্লাব যেখানে সদস্যরা তাঁদের সৃষ্টিশীলতা ব্যবহার করে সমসাময়িক বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে একটি ‘তিন শূন্য’র পৃথিবী গড়তে সচেষ্ট। বর্তমানে ৫৪টি দেশে কমপক্ষে ৩৫০০টি থ্রি-জিরো-ক্লাব আছে, এর সঙ্গে যুক্ত আছে প্রায় ১৬ হাজার তরুণ-যুবক। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও কীভাবে এই থ্রি-জিরো-ক্লাবগুলোর একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা যায়, কীভাবে কম বয়সি ছেলেমেয়েদের এই ক্লাবের লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে পরিচিত করা যায় এবং তাদের সৃষ্টিশীলতাকে কীভাবে ক্লাবের লক্ষ্য অর্জনে চালিত করা যায় তা নিয়ে প্রতিনিয়ত চলছে আলোচনা, সভা ও সেমিনার। গত ২৯ জুন ২০২৪, ম্যানিলার এশিয়া প্যাসিফিক কলেজে ইউনূস সেন্টার এবং থ্রি জিরো গ্লোবাল সেন্টারের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় এক একাডেমিয়া কনভেনশন। যেখানে ৫৬টি দেশের ৪ হাজারেরও বেশি ক্লাবের অন্তর্ভুক্তিতে থ্রি-জিরো ক্লাবের কার্যক্রম নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয় এবং সম্মেলনে ‘তিন শূন্য’র একটি নতুন গ্রিন পৃথিবী তৈরির দিকনির্দেশনা প্রদান করেন নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. ইউনূসসহ অন্যান্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। এর আগেও ২০২১ সালে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরমে ১১তম সামাজিক ব্যবসা দিবসে পৃথিবীর ১১০টি দেশের ২ হাজার ৩০ জন ব্যবসায়ী, ১৬২ জন আন্তর্জাতিক শিল্প উদ্যোক্তা, ৩৪টি দেশের ৯২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামাজিক ব্যবসার ক্যারিকুলাম, একাডেমিক কোর্সের পরিকল্পনা ও গবেষণা নিয়ে আলোচনা করেন।
বিশ্বব্যাপী এ ধরনের আরও অনেক অলাভজনক সামাজিক নেটওয়ার্ক আছে, যেমন- (১) ফোর এইচ : (হেড- Head, Heart - হৃৎপিণ্ড, Hand - হাত এবং Health - স্বাস্থ্য)- এটি একটি যুব উন্নয়ন নেটওয়ার্কিং যা হাতে-কলমে শেখার মাধ্যমে জীবন দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো হয়। (২) বয় স্কাউটস অব আমেরিকা : যা তরুণ ছেলেদের নেতৃত্বের দক্ষতা বিকাশে এবং বাইরের জগতের বিভিন্ন বিষয়ে জানতে সাহায্য করে। (৩) গার্ল স্কাউটস অব ইউএসএ : যা তরুণ মেয়েদের নেতৃত্বের দক্ষতা বিকাশে এবং বাইরের জগতের বিভিন্ন বিষয়ে জানতে সাহায্য করে। (৪) ইয়ুথ ইউনাইটেড : যা সামাজিক এবং পরিবেশগত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য একসঙ্গে কাজ করার নেটওয়ার্ক। (৫) বয়েজ অ্যান্ড গার্লস ক্লাব অব আমেরিকা : একটি যুব উন্নয়ন নেটওয়ার্কিং যা তরুণদের জন্য স্কুল-পরবর্তী এবং গ্রীষ্মকালীন প্রোগ্রাম সরবরাহ করে। ২০১৮ সালে ১৬ বছরের সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গের নেতৃত্বে পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখানে স্কুল শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে এক দিন (শুক্রবার) ক্লাস বাদ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে বৈশ্বিক নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ রিপোর্ট অনুসারে সারা বিশ্বে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি ১.২ বিলিয়ন যুবক রয়েছে, যা বিশ্ব জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগই তরুণ এবং যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। সংখ্যার হিসাবে তরুণ জনগোষ্ঠী এখন ৪ কোটি ৫৯ লাখ। বিপুল এই জনসংখ্যার বিপরীতে কর্মসংস্থান খুবই অপ্রতুল। তাই চাকরির পেছনে ঘুরে সময় নষ্ট না করে কীভাবে উদ্যোক্তা হওয়া যায় (যত ছোট হোক না কেন) সেদিকে মনোনিবেশ করা উচিত। প্রফেসর ইউনূসের মতে, ‘চাকরি হলো দাসত্ব, বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে হতে হবে উদ্যোক্তা’। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তরুণ সমাজ কীভাবে উদ্যোক্তা হবে? সেই পরিবেশ কে তৈরি করে দেবে? প্রকৃত মেধাবীরা তথাকথিত লেজুড় ভিত্তিক রাজনীতি আর করতে চায় না। চায় না অযথা মিছিল-মিটিং করে জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করতে। কল্যাণকর কিছু করতে পারলেই যেন তারা তৃপ্তি পায়। তাই তাদের মেধা ও মননকে কাজে লাগানোর জন্য মানব কল্যাণমুখী ক্লাব বা সংগঠনের দিকে ধাবিত করতে হবে। সেজন্য দরকার রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রফেসর ইউনূসের মতো অভিভাবকের আশীর্বাদ। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানকে দেশের ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’, ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে অভিহিত করেছেন আমজনতা। অধিকার আদায়ে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছাত্রদের এমন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সমস্ত দেশবাসীকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করেছে। দেশবাসীর কাছে এ কথা এখন পরিষ্কার, তারুণ্যের উদ্দামতা সাগর পাড়ি দেওয়ার মতো দুঃসাহস যেমন রাখে, ঠিক তেমনি এ বয়সে হিমালয় পর্বত জয় করার মতো দুঃসাহস রাখে। তারুণ্যে উচ্ছ্বাস কখনো কখনো সময়ের সঙ্গে বা নির্দিষ্ট কোনো বয়সসীমায় বেঁধে রাখা যায় না। অসম্ভবকে সম্ভব করতে ঝুঁকি নিতে পারার বয়স তারুণ্য। তাদের দৃষ্টি শুধুই সম্মুখে, পেছনে নয়। তাই জাতির প্রয়োজনে কখনো কখনো শুধু তরুণরাই হয়ে ওঠে জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেটা ঘটল এবার জুলাইয়ে। তাদের জীবন এখানে দীপ্তকণ্ঠে গেয়ে উঠল-‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্যম, মোরা ঝরনার মতো চঞ্চল, মোরা বিধাতার মতো নির্ভয়, মোরা প্রকৃতির মতো সচ্ছল।’ তাই প্রফেসর ইউনূস তরুণদের এই সচ্ছলতার মধ্যেই দেখতে পাচ্ছেন ‘তিন শূন্যে’র নতুন পৃথিবী। তরুণ শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ম্যানেজ করেছে, এখনো আছে পুলিশের পাশাপাশি। সড়কের মাঝপথে হাঁটা অভ্যস্ত পথচারীকে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পার হতে দেখা গেছে তরুণদের সহায়তায়। হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল এবং নির্দিষ্ট লেন ছাড়া একটি গাড়িকেও যেতে দেওয়া হয়নি। ভুয়া লাইসেন্স, অবৈধ কাগজপত্র, টাকার বস্তা, আরও কত কিছুই না আটক করেছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। এখন তাদের দেখা যাচ্ছে বাজারের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে। তাদের উপস্থিতির কারণে রাস্তাঘাটে ও ফুটপাতের দোকানগুলোতে কোনো চাঁদাবাজি হতে দেখেনি কেউ। তাহলে ভূমি রেজিস্ট্রি ও আর্থিক অফিস এবং সরকারি অন্যান্য দপ্তরে ছাত্র প্রতিনিধি থাকলে ঘুষবাণিজ্য বন্ধ হবে এবং সেবা কাজে গতি বাড়বে এমনটি ধারণা ভুক্তভোগীদের। এ লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে ১৫-২০ ঘণ্টার কাজ রোস্টারিংয়ের ভিত্তিতে দেওয়া যেতে পারে এবং তারা একেক দিন একেক অফিসে এই দায়িত্বটি পালন করবে যাতে অফিসের স্থায়ী স্টাফরা কোনো ক্রমেই তা আগে জানতে না পারে। এতে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার খরচের জোগান হবে এবং পিতা-মাতার কষ্ট লাঘব হবে। উন্নত বিশ্বে শিক্ষার্থীরা এভাবেই ছাত্রাবস্থায় কাজ করে থাকে। তাই দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার এবং প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অর্থ অপচয় রোধ এবং সরকারি সম্পদ ও সেবার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার কিছুটা দায়িত্ব এ প্রজন্মকেই হয়তো নিতে হবে। একইভাবে অতিরিক্ত যান্ত্রিকীকরণ, শিল্পায়ন ও পরিবহন ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট দূষণীয় কার্বন কীভাবে শূন্যে আনা যায় এবং সর্বোপরি, সমস্ত অধিকার ও পরিষেবায় ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সব বৈষম্যদূরীকরণে তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগাতে পারলেই শূন্য বৈষম্যের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়