জাতির ক্রান্তিলগ্নে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ক্ষমতায় আসীন হন। সে সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৭ কোটি। বাংলাদেশ ভূখন্ডে দারিদ্র্য বিমোচন কথাটি অনেক পুরনো। ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন, অতঃপর ২৪ বছরের পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন, তদুপরি বাংলাদেশের অভ্যুদয় এ অঞ্চলের দারিদ্র্য বিমোচনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বিপরীতে বাজার অর্থনীতির বিকাশ : স্বাধীনতা-পরবর্তী দাতাগোষ্ঠীর মূল্যায়নে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মকান্ডের প্রধান অন্তরায় ছিল ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও জনসংখ্যা। জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ব্যাপক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এসব অন্তরায়ের জন্য উন্নয়ন কর্মকান্ড পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। এ প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমান সরকারের নীতিনির্ধারক মহল দেশ থেকে দারিদ্র্য বিমোচন, বেকারত্ব দূরীকরণ ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সবার জন্য শিক্ষাকে ক্রমান্বয়ে আরও গতিশীল করার উদ্যোগ নেন। ১৯৭২ সালে দেশের সংবিধানে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে মূলমন্ত্র হিসেবে রাখা হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীতে টেকনোলজিনির্ভর শিল্প-বাণিজ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কোনো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার ক্ষমতা ছিল না। জিয়াউর রহমান তাই বর্তমান বিশ্বের বাস্তব প্রেক্ষাপটে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে গৌণ হিসেবে দেখেন। তাঁর এ দূরদর্শিতা আমরা বর্তমানে মূল্যায়ন করতে পারি। একজন সামরিক বাহিনীর সদস্য হয়েও মুক্তবাণিজ্য সম্পর্কে তিনি পরিষ্কার ধারণা রাখতেন। জিয়াউর রহমান শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে পাঁচটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এ পাঁচটি বিষয় হচ্ছে- অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও স্বাস্থ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন খাদ্যের। কারণ খাদ্য না পেলে মানুষ বাঁচবে না। তারপর বস্ত্র। লজ্জা নিবারণ করতে পারলে, আসবে শিক্ষা। এ তিনটির সাহায্যে বাকি দুটো মেটানো সম্ভব।
১৯১৭ সালে যে মতবাদের ওপর ভিত্তি করে সমাজ বিপ্লব সাধিত হয়েছিল, সেটি মাত্র ১০০ বছর পার না হতেই মুখ থুবড়ে পড়ল। এর মূল কারণ অর্থনীতি। এ ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা ছিল না বলে উৎপাদন ক্ষমতায় চরম ভাটা পড়ে। অন্যদিকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো বাজারমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অর্থনীতির কারণে শিল্পসমৃদ্ধ অর্থনীতিতে পরিণত হতে পেরেছে। বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে তিনি দেশের সংবিধানে পরিবর্তন আনেন। যা পরবর্তীতে ফলপ্রসূ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনামলেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অচল বলে মনে করতেন। তিনি বাজার অর্থনীতিকে প্রাধান্য দেন।
বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন ও কৌশল : জিয়াউর রহমানের চিন্তা-চেতনায় ছিল স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, নিজস্ব পতাকা, পরিচয়, দেশপ্রেম ও রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদের বাংলাদেশ। সিকিম, ভুটান, নেপাল কিংবা পশ্চিমবঙ্গের মতো অবস্থা যাতে বাংলাদেশের না হয়, সে দিকটি ছিল তাঁর রাজনীতির মূল কৌশল। বিংশ শতাব্দীতে বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশ একটি বা দুটি দেশের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে না। এ মূলমন্ত্রকে জিয়াউর রহমান বিশ্বাস করতেন।
বাংলাদেশ শুধু ভারতের সঙ্গে বিশেষ অর্থনৈতিক সম্পর্ক রেখে কখনোই একটি স্বনির্ভর দেশে পরিণত হতে পারবে না। প্রেসিডেন্ট জিয়া ভারতীয় আধিপত্যবাদকে সুকৌশলে মোকাবিলা করে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে, মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপন করে ১৯৭৫-পূর্ব বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনেন। ইসলামী সম্মেলন সংস্থায় দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে তুলে ধরেন। ১৯৮০ ও ১৯৮৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওআইসির সম্মেলন অনুষ্ঠানে জিয়াউর রহমান সরাসরি ভূমিকা রাখেন। আঞ্চলিক ফোরাম সার্ক গঠন ও মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বিশেষ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কথা বলে দেয়। তাঁর বক্তব্য ছিল- ‘আত্মমর্যাদা বজায় রেখে সব দেশের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতিতে বন্ধুত্ব চাই, কোনো শত্রুতা আমাদের কাম্য নয়।’ তাই জিয়াউর রহমান তাঁর উন্নয়নের ১৯ দফার ১৬তম দফায় সংযুক্ত করলেন সব বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন জোরদার করা। পূর্বতন আওয়ামী সরকার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোনো ধরনের ভূমিকা রাখতে পারেনি।
১৯৭৪ সালে একদিকে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ, অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশের পারমাণবিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার আগ্রহ সবই যেন একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের জনগণের একবেলা দুমুঠো ভাত খাওয়ার সামর্থ্যও ছিল না, রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়, স্থানে স্থানে লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারত তখন পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটাতে ব্যস্ত। বিপদের সময় সত্যিকার বন্ধুর পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় বাংলাদেশ তার বন্ধুদেশগুলোকে চিনতে পেরেছে। আগস্ট-২০২৪ এ ভারত কোনো পূর্ব সিগন্যাল না দিয়েই বাঁধের গেট খুলে দেয়। এক রাতের মধ্যেই ১৬টি জেলায় বন্যা হলো। কী অমানবিক আচরণ পেল বাংলাদেশ প্রতিবেশী বন্ধুর কাছ থেকে। ইতোমধ্যে ফারাক্কা বাঁধের ১০৯টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। ভারতের গণমাধ্যম এ তথ্য জানিয়েছে। এ কনসেপ্টের ওপর ভিত্তি করে প্রেসিডেন্ট জিয়া দেশের বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনেন। দেশের নব্বই শতাংশ লোক মুসলমান। তাই মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই দেশের উন্নয়ন নীতি তৈরি করেন। আজ তাঁর সেই দিনের কর্মপ্রচেষ্টা, দূরদর্শিতার সফল বাস্তবায়ন হয়েছে।
জনশক্তি রপ্তানি ও বৈদেশিক রেমিট্যান্স : ১৯৬০ দশকের শুরুতেই মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি দ্রুত বিকাশ লাভ করে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তেলের ওপর ভিত্তি করে শিল্পকারখানা ও অবকাঠামো উন্নয়ন করতে থাকে। এ দেশগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় জনসংখ্যা কম থাকার কারণে তারা স্বভাবতই বিদেশি শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল। ষাট ও সত্তর দশকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে, আফ্রিকার মিসর, নাইজেরিয়া ও মরক্কো এবং এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার জনশক্তি এসব উন্নয়ন কর্মকান্ডে সংযুক্ত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশ এ সুযোগকে কাজে লাগাতে পারেনি। এরই প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশ সফর করেন। বাংলাদেশি দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক ১৯৭৭-১৯৭৮ সাল থেকে পরিকল্পনামাফিক সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় মধ্যপ্রাচ্যে যেতে শুরু করে। ১৯৭৯ সালে কুয়েত বিশ্বের এক নম্বর (মাথাপিছু গড় আয়) ধনী দেশ হিসেবে বিবেচিত ছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়া কুয়েতের আমিরকে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানান। ১৯৮০ সালে কুয়েতের আমির শেখ জাবের বিন আহমেদ আল সাবাহ ঢাকায় আসেন। তাঁর এ সফর ছিল ঐতিহাসিক। ১৯৭৯-৮০ মৌসুমে বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের নাটকের মূল কথাই ছিল ‘দুবাই যামু, টাকা দেন।’ বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা রিয়াল, দিনার উপার্জনের যে প্রবল আগ্রহ, তা এ নাটকের প্রবাদ থেকেই বোঝা যায়। বিদেশ থেকে অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতা তখন থেকে শুরু হয়ে যায়।
১৯৭৬-পূর্ব যে শ্রমিক দুবেলা পেট পুরে ভাত খেতে পারেনি, ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারেনি। ১৯৮০-৮১ সালে সেই শ্রমিকের ঘরে এসেছে টেলিভিশন কিংবা ফ্রিজ। একজন অশিক্ষিত শ্রমিক তার শ্রম দিয়ে বিদেশ থেকে টাকা উপার্জন করতে পারে, যা আগে ছিল প্রায় অসম্ভব। জিয়াউর রহমান দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তরের চেষ্টা করেন। চট্টগ্রাম থেকে সেই সময় প্রকাশিত ম্যাগাজিন ‘রাই মাস্টার’-এর একটি কবিতার বচনে দেখা যায়- ‘আবুধাবি কে কে যাবি, সুখচাবি বানাতে’; দুবাই, আবুধাবি, রিয়াদ কিংবা কুয়ালালামপুরে সর্বত্রই বাংলাদেশি শ্রমিকদের জয়জয়কার, সবই সম্ভব হয়েছে প্রেসিডেন্ট জিয়ার গতিশীল চিন্তাধারার কারণে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচিত।
লেখক : যুগ্ম মহাসচিব, অ্যাসোসিয়েশন অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স; মনিটর, জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন (জেডআরএফ)