এটা সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। মূলধারার সংবাদমাধ্যম তথা রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র জনমত গঠনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে আসছে আগে থেকেই। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সোশ্যাল মিডিয়াও যথেষ্ট প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। ব্যস্ত জীবনে খবরের কাগজ পড়া বা টিভি দেখার সময় পান না অনেকে। তাই ভরসা ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, এক্স ও ইউটিউব। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চোখ বুলিয়ে নেন সোশ্যাল মিডিয়ায়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় যা কিছু ছড়িয়ে পড়ে তার সবটাই কিন্তু সত্য নয়। কিছু সত্য, কিছু অর্ধসত্য এবং কিছু মিথ্যা। বাড়িয়ে বলা বা ‘তিলকে তাল করা’ অনেকের স্বভাব। মানুষ নাকি মনগড়া গল্প পছন্দ করে। দর্শকপ্রিয় টিভি সিরিয়ালগুলো তার বড় প্রমাণ। অবাস্তব আর উদ্ভট কাহিনির ছড়াছড়ি। সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্য সহজেই বিশ্বাস করে অনেক মানুষ। ছাপার অক্ষরে কিছু দেখলে বিশ্বাস জন্মায়। আবার মন যা চায়, তাকেই সত্য বলে আঁকড়ে ধরতে চান অনেকে। তথ্য যাচাই-বাছাই করার সক্ষমতা ও অভ্যাস কোনোটাই আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নেই বললেই চলে। সুযোগসন্ধানী ও মতলববাজরা এ সুযোগটাই নেয়। তথ্যের উৎস যাচাই এবং উৎসের নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিরূপণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
গুজব ছড়াতে পছন্দ করেন অনেকে। মজা পান। নেটমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ও গুজব ছড়ানোর অঘোষিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্যে তৈরি করা ভুয়া ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সংবেদনশীল পুরনো ছবি বা ভিডিও কেটে-ছেঁটে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। কোনটা ‘ফ্যাক্ট’ অর্থাৎ প্রকৃত সত্য আর কোনটা ‘ফিকশন’ অর্থাৎ কল্পকাহিনি তা চিনতে না পারলে পদে পদে বিপদের আশঙ্কা থেকেই যায়।
কথায় বলে, খারাপ সংবাদ দ্রুত ছড়ায়। অতিরঞ্জিত খবর, বিকৃত ছবি ও ফেক ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। শুধু নিজে জানলেই তো আর হলো না। আরও ১০ জনকে তা জানানো চাই এবং তা কালবিলম্ব না করেই। সত্যাসত্য যাচাই করার সময় নেই। মুহূর্তে ফেসবুকে শেয়ার বা হোয়াটসঅ্যাপে ফরোয়ার্ড না করা পর্যন্ত যেন স্বস্তি নেই! সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হবে না?
ভুয়া, অপতথ্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোকে। তথ্যের অতিপ্রবাহের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে তথ্যের যথার্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার কাজটি চ্যালেঞ্জিং বটে। বাংলাদেশিদের বিনা ভিসায় পাকিস্তান ভ্রমণের সুযোগ-ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এ দাবিটি ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছে একটি পত্রিকা। ফেনীতে বন্যায় ভেসে যাচ্ছেন এক নারী, ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি সাজানো বলে পত্রিকাটির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা এবং উপবৃত্তি বন্ধের ভাইরাল হওয়া পোস্টটি নিছক ‘গুজব’ বলে জানিয়েছে পত্রিকাটি। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো মাত্র। নাৎসি জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলারের প্রচারমন্ত্রী ছিলেন পল জোসেফ গোয়েবলস। তিনি বলেছিলেন, ‘একই মিথ্যা বারবার বললে সেটাই সত্যি হয়ে যায়। এখনো এই তত্ত্বে বিশ্বাস করেন অনেকে।
‘গুজবের জন্ম’ নামে কবি ও শিশুসাহিত্যিক সুনির্মল বসুর [১৯০২-১৯৫৭] একটা মজার গল্প আছে। তারকবাবু তামাক খেয়ে অফিসে যাবেন। তাই গৃহভৃত্য কেষ্টা তাড়াতাড়ি করে যেই হুকোটা বাবুকে এগিয়ে দিতে যাবে অমনি কলকে থেকে এক টুকরো আগুন হঠাৎ বৈঠকখানার দামি ফরাসটার ওপরে পড়ে গিয়ে খানিকটা জায়গা পুড়ে গেল। কেষ্টা অন্দরমহলে এসে কাজের মেয়েকে বলে ঘটনাটি। ঘরে ফেরার পথে রায়গিন্নির সঙ্গে দেখা কাজের মেয়ের। সে রায়গিন্নিকে ঘটনাটি খুলে বলে। পাড়ার টুনু কোথাও যেন যাচ্ছিল। রায়গিন্নি ঘটনাটি তাকে জানায়। মানুষের মুখে মুখে রটে গেল সেই খবর। তারকবাবু সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছিলেন। পথে কবিরাজ জগন্নাথবাবুর সঙ্গে তার দেখা। তিনি তারকবাবুকে দেখে চোখ দুটো কপালে তুলে কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইলেন। কয়েকবার ঢোক গিলে বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ কী, তবে তুমি মর নাই!’ তারকবাবু বিস্ময়ের সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘সে কী, মরতে যাব কোন দুঃখে?’ কবিরাজ মশাই আমতা আমতা করে বললেন, ‘এই শুনছিলাম করিম গয়লার কাছে, তোমার চাকর কেষ্টা কাল রাতে ডাকাতের দলে যোগ দিয়ে তোমার জিনিসপত্তর, ঘরবাড়ি, এমনকি তোমাকে পুড়িয়ে মেরেছে। সে নিজে তোমার পোড়া লাশ দেখে এসেছে।’ তারকবাবু বাড়ি এসে দেখেন, ভীষণ ব্যাপার। ঘরবাড়ি লোকে গমগম করছে। কেষ্টা ধরা পড়েছে। পুলিশের লোক তাঁকে বেঁধে ফেলেছে। তবে ডাকাত দলের অন্য কেউ এখনো ধরা পড়েনি। জোর তদন্ত চলছে। [বিশেষ দ্রষ্টব্য : সেকালে মোবাইল ফোন বা সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না।] এই কাহিনি থেকে কে কী পাঠ নেবেন তা জানি না। তবে এই সময়ে গল্পটি খুবই প্রাসঙ্গিক। হাওয়ায় ভাসছে গুজব। গুজব থেকে সাবধান! মিথ্যা তথ্য, বিকৃত ছবি বা ভুয়া ভিডিও বিভ্রান্তি ও উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। পরিস্থিতিকে অশান্ত করে তুলতে পারে। এ ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন হওয়া জরুরি।
লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক পিএলসি