গত সংখ্যায় বলেছিলাম সংলাপের কথা। এবং সেই সংলাপের জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। ৩০ আগস্ট দেখলাম সরকারের সঙ্গে বিএনপির কথা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ফোন করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কথা বলার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ফোনটা করা হয়েছিল কেবল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। কিন্তু জনাব আলমগীর বলেছিলেন, তিনি তো একা যেতে পারবেন না, তার সঙ্গে পার্টির আরও গুরুত্বপূর্ণ দু-একজন নেতা যেতে হবে। সেভাবেই আরও দুজন স্থায়ী কমিটির সদস্যকে নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন এবং উভয় পক্ষে কথা হয়েছিল। এর পরেই ঘোষণা করা হয়েছিল, ৩১ আগস্ট সরকার অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসবেন। সেদিন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ১৭টি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দৈনিক পত্রিকাগুলোর খবর অনুযায়ী নির্বাচন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অপরাধী আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার এবং সংস্কারসহ মোট প্রায় দুই হাজার প্রস্তাব উত্থাপিত বা আলোচিত হয়েছে সেই বৈঠকগুলোতে।
এ বৈঠকগুলোকে নিশ্চয়ই একটি রাজনৈতিক সংলাপ বলা যায়, তা সেই সংলাপ দলগুলোর জন্য যতই স্বল্প সময়ের হোক না কেন। বোধহয় এটাও বলা যায় যে, সেটাই হলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের সংলাপ শুরু। এর আগে বিএনপির সঙ্গে যে আলোচনা হয়েছে তাকে মিডিয়াগুলো যেভাবে বলছে, সেভাবে একটি সংলাপের অংশ বলা যায় কি না তার জবাব বিএনপি দিতে পারবে। ৩০ আগস্ট থেকেই ফোন পাচ্ছিলাম, লোকে জানতে চাচ্ছিল কাল কখন আপনারা কথা বলতে যাবেন। আমি বা গণতন্ত্র মঞ্চের আমরা কেউ তখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আমন্ত্রণ পাইনি। তবে সেই দুপুরে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আমাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, এখন আমাদের ডাকা হবে না। কারণ ইতোমধ্যেই আমরা একবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি। এখন ডাকা হচ্ছে তাদের যাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার আগে কোনো কথা হয়নি।
এখানে বলা প্রয়োজন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আমাদের এ বৈঠক ছিল একটি সুনির্দিষ্ট এজেন্ডার ওপর। ১৫ আগস্ট। সরকার কীভাবে দেখবে এ দিনটিকে, সেটাই তারা আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। আলোচনার শুরুতেই প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়ে আসিফ নজরুল বলেছিলেন, একটি বিষয়েই আপনাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আপনাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আরও অনেক বিষয় আছে আলোচনার, সেগুলো আমরা পরে কথা বলব, সময় নেই এখন আমাদের। উনি বলেছিলেন আধা ঘণ্টা থেকে ৪৫ মিনিটের মধ্যে আমরা এ আলোচনা শেষ করে দিতে চাই।
১৫ আগস্টও একটি রাজনৈতিক বিষয়। ওই দিনটি তখন পর্যন্ত জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষিত। পতিত সরকার এটিকে ছুটির দিন ঘোষণা করে রেখেছেন। আমাদের জানা দরকার বর্তমান সরকার এটিকে কীভাবে দেখছেন। সেদিনই মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, তাদেরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি। তারা নিজেদের সংগঠিত করুক। জোটের সমন্বয়কারী হিসেবে আমি সে কথা তুলেছিলাম। তখন আসিফ নজরুল বলেছিলেন সে কথা আর আলোচনা না করতে। কারণ তারা ইতোমধ্যেই এ বিষয় নিয়ে বিব্রত। তারপর যা যা ঘটেছে, পাঠক, সেটা আপনারা জানেন। কথাটা বললাম এজন্যই যে আমাদের সঙ্গে ওই বৈঠকটি আসলে রাজনৈতিক সংলাপের অংশ কোনোক্রমেই ছিল না।
সে যাই হোক, যেভাবেই হোক, সংলাপ শুরু হয়েছে। এটা ভালো কথা। প্রথম থেকেই আমি এ ধরনের সংলাপের প্রয়োজনে কথা বলে আসছিলাম। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে লড়াই বাংলাদেশের জনগণ সাম্প্রতিক প্রায় এক যুগ ধরে করে আসছিল তা প্রাথমিকভাবে জয়যুক্ত হয়েছে। আন্দোলন তার পরবর্তী পর্যায়ে পা রেখেছে। সেটা হলো নতুন বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রাম। যে দেশ হবে গণতান্ত্রিক, মানবিক, কল্যাণধর্মী। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণায় যেমন আছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের দেশের কথা। এক যুগ ধরে বিরোধী দলগুলোর নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ যে লড়াই করছিল, সেটারও লক্ষ্য ছিল এ নতুন রাষ্ট্র গড়ার। তারা বলেছিল আমরা শুধু সরকার পরিবর্তনের লড়াই করছি না, একই সঙ্গে আমরা শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন করতে চাই। রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার করতে চাই। এ সংস্কারের লক্ষ্যেই তারা ৩১ দফা দাবিনামা প্রণয়ন করেছিল।
আবার উল্লেখ করছি, আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায় শুরু। এটা হলো রাষ্ট্রকে নতুনভাবে গড়ে তোলার আন্দোলন। এ কাজটা কারা করবে? এ মুহূর্তের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে। দেশ পরিচালনা করবে তারাই। অতএব অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য দেশের সংস্কার কর্মকান্ডও তারাই পরিচালনা করবে। কিন্তু সংস্কার তো একটি চলমান প্রক্রিয়া। যতদিন রাষ্ট্র টিকে থাকবে ততদিন চলবে সংস্কার। তার মানে কি ততদিন পর্যন্ত এ সরকারও থাকবে? তা তো হতে পারে না। যে ক্ষমতার কোনো সীমানা নেই, সময় সীমা নেই, সে ক্ষমতা স্বেচ্ছাচারী হতে বাধ্য। স্বাভাবিক নিয়মের যে সরকার হয় তাদেরও সময়সীমা সাংবিধানিকভাবেই বাঁধা থাকে। আর এটা তো একটা অন্তর্বর্তী সরকার। এক সরকার থেকে আরেক সরকারে যেতে যে সময় লাগে সেটাই অন্তর্বর্তী সময়। এ অন্তর্বর্তী সময় কতখানি? সেটা নির্ভর করে সরকার কী পরিস্থিতিতে কী কাজের জন্য দায়িত্ব নিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে কথা তো স্পষ্ট। দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে, জোর করে এক যুগেরও অধিক সময় ক্ষমতায় টিকেছিল একটি দল। এ সময়ের মধ্যে তারা দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব দাঁড়ায় একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়তে নির্বাচনব্যবস্থাকে বিশ্বাসযোগ্য জায়গায় দাঁড় করাতে। এটাই তার প্রাথমিক কাজ। এবং সেটা করতে যা যা সংস্কার করা দরকার তার সবকিছুই সে করবে; কিন্তু সে তো মেলা কাজ। একটি দায়িত্বশীল নির্বাচন কমিশন : নির্ভরযোগ্য, দক্ষ এবং অঙ্গীকারবদ্ধ প্রশাসন (সিভিল এবং পুলিশসহ সব)। এক পুলিশ প্রশাসনকেই সরকার এখনো যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। পুলিশ প্রশাসনে যেভাবে দলীয়করণ করা হয়েছিল, নিজেদের অবৈধ ক্ষমতাকে সর্ব প্রকারে বহাল রাখার জন্য এ বাহিনীকে যেভাবে হৃদয়হীন দানবে পরিণত করা হয়েছিল এবং তার পরিণতিতে জনগণ যেভাবে ক্রোধে ফুঁসে উঠেছিল তার ফলাফল আমরা এখন ভোগ করছি। ৫ আগস্টের পর পুলিশ বাহিনী বলতে আসলে কিছু ছিল না। রাস্তাঘাটে ট্রাফিক পুলিশের কাজ করেছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এটাও একটা অবিস্মরণীয় উদাহরণ। ট্রাফিক পুলিশ ছাড়াও যে একটি শহরের যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা যায় তার উদাহরণ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনীকে কাজে নামানোর কাজটিই ছিল সরকারের প্রধান কাজ। এবং সেটা সরকার করেছে। কিন্তু এই এক মাসে পুলিশের উচ্চতর পদে যা হয়েছে এবং পুলিশকে নিয়ে যা করা হয়েছে উচ্চতর পদের অনেকেরই পলায়ন, পদত্যাগ এবং সরকারের পক্ষ থেকে এ জায়গাগুলো পূরণ করা। পুলিশ বাহিনীকে সামগ্রিকভাবে কাজে অংশগ্রহণ করানো- এগুলো কোনোভাবেই এ প্রশাসনকে সংস্কার করা বুঝায় না। সংস্কার হলো- পুলিশ বাহিনীকে অত্যাচারী বাহিনী থেকে জনবান্ধব বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা। এটা একটা বিশাল কাজ। আমি যতদূর জানি, আওয়ামী সরকারের এ দলীয়করণ ও দুর্বৃত্তপনা শুরুর আগে পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরে এ চর্চা শুরু হয়েছিল। পুলিশ বাহিনী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এ মর্মে একটি পেপারও তৈরি করেছিল। সে কথা হয়তো এখন আর কারও মনে নেই।
দেশের অভ্যন্তরীণ নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ বাহিনীর কোনো বিকল্প নেই। পুলিশ বাহিনীকে যদি সংস্কার করে জনবান্ধব বাহিনীতে রূপান্তরিত করা না যায় তাহলে যে দেশ গড়ার জন্য এত রক্ত দান, তা বিফলে যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে বর্তমান সরকার কি এ সংস্কার করতে পারবে? অনেক সময় তো লাগবে এতে। অতখানি সময় একটা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য যুক্তিসঙ্গত হবে? একইভাবে সিভিল প্রশাসন সম্পর্কেও এ প্রশ্ন করা যায়। জনপ্রশাসন বলতে আমরা যা বুঝি অথবা এরশাদ সরকারের আমলে যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আওয়াজ তুলেছিলেন- আমরা কোনো দলের কর্মচারী নই; আমরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, তা তো হয়নি। সে রকম করতেও সময় লাগবে। অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চয়ই এতগুলো কাজ করার সময় পাবে না।
বর্তমান সরকারের মূল কাজ হলো একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। যে নির্বাচন ধ্বংস করে ফেলেছে বিগত আওয়ামী স্বেচ্ছাচারী সরকার; সেই অবস্থার পরিবর্তন করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য একটি সমতল খেলার মাঠ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার কাজটাই আসল। সেই কাজটার জন্যও কম সময় লাগবে না। আমরা যখন জোট গড়ে তোলার কাজ করছি, যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি তৈরি করছি, তখন বলেছিলাম অন্তত তিন বছর সময় লাগবে এর জন্য। বিএনপি তখন কেয়ারটেকার সরকারের কথা বলতে চাইত। আমাদের বক্তব্য ছিল, কেয়ারটেকার সরকারের মেয়াদ তো সাংবিধানিকভাবে মাত্র তিন মাস। এত কম সময়ের মধ্যে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে না। একটা সংহতের মতো দাঁড়িয়ে ছিল, বিএনপি কেয়ারটেকার সরকার বা তিন মাসের সরকারের কথা বলবে না। আর আমরাও তিন বছরের কথা বলব না। তখনকার মতো এভাবেই মতপার্থক্যের বিষয়টি ঘুচিয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন এ সময় নির্ধারণের ক্ষণ এসেছে।
বিএনপি হাসিনা স্বৈরাচারের পতনের পরপরই বিশাল এক সমাবেশ করে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার দাবি করেছিল। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও একই রকম কথা বলেছিলেন। অল্প দিনের মধ্যেই বিএনপি বুঝতে পেরেছিল এ মুহূর্তে এ দাবি তোলায় জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এজন্যই তারা পরবর্তীতে বলেছে, সরকারকে যৌক্তিক সময় দেবে তারা। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৯ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপকালে নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ দাবি করেছেন।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি : রোডম্যাপ। আগামী সংখ্যায় এর ওপর আরও বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রইল।
♦ লেখক : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য