এমনটাই বরাবর দেখে আসছে দেশের মানুষ, সর্দি-কাশির চিকিৎসার জন্যও অনেক মন্ত্রী-এমপি, রাজনীতিক-আমলা সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক-লন্ডনে ছোটেন। গুরুতর কিছু হলে তো কথাই নেই। দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর আস্থা নেই। তাদের চিকিৎসার জন্য এ দেশকে তারা উপযুক্ত মনে করেন না। পদ-পদবির সূত্রে, পেশার শর্তে যারা সরকারি খরচে চিকিৎসার সুবিধা পান, নিকট অতীতে অনেককেই দেখা গেছে- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে ক্ষণে ক্ষণে বিদেশে গেছেন। সেখানে রাষ্ট্রের মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়েছে। সরকারের হিসাব বিভাগ বলতে পারবে- এ খাতে বছরে কত শ কোটি টাকা খরচ হয়। একটা গরিব দেশে, ঘোরতর অপচয়ের এই অপচর্চা থেকে জাতিকে বেরিয়ে আসতে হবে। এমন নিয়ম-কাঠামো তৈরি করতে হবে- যাতে জনগণের টাকায় কারও বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ না থাকে। তারা দেশে সম্ভব সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা পাবেন। এটা যদি করা হয়, এক্ষেত্রে সাশ্রয় হওয়া টাকায় চিকিৎসা ক্ষেত্রের আশাব্যঞ্জক উন্নয়ন সম্ভব। অনেক চিকিৎসককে উন্নততর প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ করে তোলা যায়। আধুনিক চিকিৎসাসামগ্রী আমদানি ও স্থাপন তখন অসাধ্য থাকবে না।
এই সুরে সম্প্রতি কথা বলতে শুনেছি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। জুলাই বিপ্লবের বিজয়ের পর ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণ আন্দোলনে আহতদের দেখতে সেদিন রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক। তাদের সঙ্গে ছিলেন ওই কর্মকর্তাও। এ পর্যায়ে এক হাসপাতালের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাইকে দেশেই চিকিৎসা নিতে হবে। বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ থাকবে না। কারও বিদেশে চিকিৎসার ব্যয় সরকার বহন করবে না; এমন ব্যবস্থা করতে হবে। সঙ্গত ক্ষোভ এবং তাৎক্ষণিক আবেগে হলেও, এ বলিষ্ঠ উচ্চারণ যেন বাস্তবায়িত হয়-সে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
অতীতে অনেককেই দেখা গেছে ছয় মাস-নয় মাস পরপর, কেউবা বছর বছর স্ত্রী-পরিজনসহ বিরাট পর্ষদ বাহিনী নিয়ে চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য একের পর এক বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। এক দেশে চোখের তো অন্য দেশে পেটের চিকিৎসা। রাজা-বাদশাহর বিনোদন ভ্রমণের মতো। কাউকে কাউকে দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। নিয়মিত ফলোআপ করাতে হয়েছে। এমন অনেক নজির আছে। সমাজমাধ্যমে এসব তথ্য ভেসে বেড়ায়। সব খরচ জোগানো হয়েছে জনগণের টাকায়। খুব অন্যায় হয়েছে। যুগের পর যুগ এই অপধারা চলেছে, চলছে। এখন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এ থেকে বেরিয়ে আসার। নিয়ন্ত্রণ ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার। নষ্ট রাজনীতির দুষ্ট অনুচরবেষ্টিত নেতৃত্বের কাছ থেকে এটা আশা করা যায় না। কারণ, এ দেশে আদর্শের রাজনীতির অপমৃত্যু অনেক আগেই ঘটেছে। তারপর চলেছে হয় সামরিক, নয় ক্ষমতার জন্য আদর্শচ্যুত রাজনীতির শাসন। সামরিক স্বৈরশাসকের ক্ষমতার অবসান ঘটাতে ডান-বাম, পক্ষ-বিপক্ষ সব দলই জোটবদ্ধ হয়েছে। আবার সেই স্বৈরাচারের দলকেই সঙ্গে রাখতে হয়েছে ক্ষমতার জন্য। আমৃত্যু মন্ত্রীর মর্যাদায় সদ্য পতিত প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে সেই সামরিক স্বৈরাচারকে। কী বিচিত্র! রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে তাই এমন অনেক সিদ্ধান্তই নেওয়া সম্ভব হয় না, যা উচিত, অধিকতর জনকল্যাণমুখী এবং দেশের জন্য হিতকর। সুবিধাভোগীরা বেজার হবেন- এ আশঙ্কায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব শঙ্কিত থাকেন। আমলা-কামলাদের অন্যায্য সুবিধা দিয়ে অবৈধ পন্থায় ক্ষমতার মেয়াদ বাড়ানোর অ›িধসন্ধি খুঁজতে হয় তাদের। জগদ্দল পাথরের মতো জেঁকে বসতে চান জনগণের ঘাড়ে। সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসেও থাকেন। পর্যায়ক্রমে হয়ে ওঠেন কঠিন স্বৈরাচার। তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন না। ইতিহাসের দুর্ভাগ্যজনক শিক্ষাই হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। আখেরে অশেষ অসম্মান আর চরম গ্লানি মাথায় নিয়ে নিক্ষিপ্ত হতে হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে এসে এ দেশ আরেকবার স্বাধীন হয়েছে গত ৫ আগস্ট। আবেগে কেউ বলছেন ‘৩৬ জুলাই’। হাজারো জীবনের বিনিময়ে জুলাই বিপ্লবের এ অর্জন দেশের আপামর ছাত্র-জনতার। তারাই সৃজন করেছে বর্তমান ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ উপদেষ্টাদের কাউকে জনগণের কাছে ভোট ভিক্ষা করে, ভোট চুরি করে বা রাতের ভোটে ক্ষমতায় আসতে হয়নি। আপামর জনগণ গভীর সম্মান, শ্রদ্ধা ও আস্থায় সবিনয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের হাতে দেশকে তুলে দিয়েছে। তারা চান অনাচার-দুরাচার, দুর্নীতি-দুঃশাসন, দমন-পীড়নমুক্ত একটি বৈষম্যহীন দেশ গঠন। জাতি চায় সত্যিকার গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে সৎ, শিক্ষিত, আদর্শবাদী রাজনীতিকরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে জনহিতকর ও উন্নয়নের অনুকূল আইন প্রণয়ন করবেন। যেখানে বিচার বিভাগ থাকবে শতভাগ স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত। প্রশাসন হবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, জনগণের সেবক, ইংরেজিতে বললে, ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দলবাজির কোনো সুযোগ থাকবে না। কারও স্বৈরাচার হয়ে ওঠার সহায়ক হাতিয়ার হওয়ার দুর্মতি চাকরিবিধির দন্ডনীয় লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে। কঠোর মনিটরিং ও জবাবদিহিতায় তারা নিয়ন্ত্রিত হবেন। এসব করা কোনো বিপ্লবী সরকারের পক্ষেই সম্ভব। জুলাই বিপ্লবের ফসল অন্তর্বর্তী সরকারকে এমন অনেক শক্ত কাজই করতে হবে। করা হচ্ছেও, জাতি তা লক্ষ্য করছে। দেশ সংস্কারের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ জারি রাখতে হবে অক্লান্ত; সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রের শেষ বর্জ্যটি অপসারণ পর্যন্ত। এই অযুত-নিযুত জরুরি কাজের তালিকায় জনগণের টাকায় বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ বন্ধের বিষয়টিও সংযুক্ত করতে হবে। ভবিষ্যতে জনপ্রতিনিধিরা যেন নিজ এলাকার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন, তেমন বিধানও করা যেতে পারে। তখন তারা নিজেদের স্বার্থেই ওই কেন্দ্রের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপস্থিতি এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করবেন। সেখানকার চিকিৎসক যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে যদি উন্নততর চিকিৎসার সুপারিশ করেন- তার ভিত্তিতে তারা দেশের অন্য কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারবেন। বিদেশে যেতে হলে নিজ খরচে তো বটেই; সে অর্থও হতে হবে সাদা টাকা। তার বৈধতার সনদ থাকতে হবে। অর্থাৎ বাঁচতে হলে তাকে সৎও হতে হবে। এভাবেই সংস্কারের পেরেক ঠুকতে হবে সব অনাচারের মেরুদন্ডে-মজ্জায়।
শুধু দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিয়োজিত কোনো সৈনিক যদি গুরুতর আহত হন এবং দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা যদি প্রযুক্তিগত সক্ষমতার ঘাটতির কারণে বিদেশে চিকিৎসার সুপারিশ করেন- রাষ্ট্র সে ব্যবস্থা ও ব্যয় বহন করবে। এটাও আগামী পাঁচ-দশ বছরের মধ্যে বন্ধ করতে হবে। অনন্তকাল ধরে এ ব্যবস্থা চালু রাখার দীনতা থেকেও মুক্ত হতে হবে। পাশাপাশি, চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে আহতদের কারও জীবন রক্ষায় অনিবার্য প্রয়োজনের ক্ষেত্রেও এ মুহূর্তে এটা বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। অনেকেই উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে যন্ত্রণা ভোগ করছেন। অনেককে হাত-পা হারিয়ে বরণ করতে হচ্ছে পঙ্গুত্ব।
যথাসম্ভব দ্রুতই এসব বিধি-বিধান করতে হবে। সুুযোগ বারবার আসবে না। সরকার নিশ্চয় খুব ভালোই জানে, সূক্ষ্ম সুতোর ওপর দিয়ে তাদের চলতে হচ্ছে। নিচে ১৮ কোটি জনপ্রত্যাশার উষ্ণতা। অসংখ্য অদৃশ্য তীর তাক করে রয়েছে। তার মধ্য দিয়েই দেশ সংস্কারের মহান কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যেতে হবে। আশার বিষয় এটুকুই যে, এ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কারও হারানোর কিছু নেই। দুই তরুণ ছাড়া অন্য সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান অধিকার করেছিলেন আগেই। বর্তমান পদ তাদের বিশেষ মহিমান্বিত করেছে বলে ভাবার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। দেশের মানুষের আকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে তাদের প্রতি। যা করা দরকার তারা তা খুব দৃঢ়তার সঙ্গেই করবেন। সব আগাছা উপড়ে ফেলবেন। দুর্বৃত্তায়ন স্পর্ধার বিষদাঁত ভাঙবেন। জাতিকে গণতন্ত্রের অর্থ বুঝিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্রের সমঝদার ও রক্ষক করে গড়ে তুলবেন। বলিউডের শাহানশাহ খ্যাত কিংবদন্তি অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন তার সংক্ষিপ্ত রাজনীতিক জীবনের ইতি টেনে খুব আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘তৃতীয় বিশ্বে রাজনীতি হচ্ছে সততা ও দেশপ্রেমের বিপরীত শব্দ।’ এমন কঠিন অপবাদ থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিকে মুক্ত করা কি সম্ভব হবে? সময়ই তার জবাব দেবে। আমরা অসীম আশায় বুক বেঁধে রাখছি।
♦ লেখক : সহকারী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন