মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। আখেরি জমানার মানুষ হিসেবে আমরা তাঁর উম্মত হওয়ায় পরম সৌভাগ্যের অধিকারী। হজরত আদম (আ.)-এর মাধ্যমে দুনিয়ার বুকে প্রথম নবীর আগমন, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের মাধ্যমে পৃথিবীতে নবী-রসুলের আগমন পর্বের সমাপ্তি টানা হয়েছে। মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর পৃথিবীতে আর কোনো নবী আসবেন না। তিনি হলেন সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য মনোনীত নবী। কেয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ পৃথিবীতে আসবে তারা তাঁর উম্মতের মধ্যেই গণ্য হবে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পথে মানুষকে ডাকার এ মহান জিম্মাদারি তাঁর উম্মতের মাঝে যারা কোরআন-হাদিসের জ্ঞানে জ্ঞানী তাদের ওপর দিয়েছেন। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগে যে হাজার হাজার নবী-রসুল এসেছেন তাঁদের বিশেষ সম্প্রদায়ের নবী-রসুল হিসেবে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু আখেরি নবীর আগমন ঘটেছে সমগ্র মানব জাতির জন্য। ইরশাদ করা হয়েছে, ‘হে নবী! আমি তোমাকে সারা বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে পাঠিয়েছি’ (সুরা আম্বিয়া-১০৭)। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়ায় এসেছিলেন মিথ্যা থেকে মানুষকে দূরে রাখতে। যারা সত্যের পথের অনুসারী তাদের আখেরাতের জীবনে কীভাবে পুরস্কৃত করা হবে তার বার্তাবাহক হিসেবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে সমগ্র জাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি, অধিকাংশ মানুষ তা জানে না’ (সুরা সাবা-২৮)। অন্যত্র মানব জাতিকে লক্ষ্য করে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কারও পিতা নন। বরং তিনি হলেন আল্লাহর রসুল ও শেষ নবী। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত’ (সুরা আল আহজাব-৪০)। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের কথা পবিত্র কোরআনের পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবগুলোয়ও উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বনি ইসরাইল! আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর পাঠানো রসুল, সত্যতা বিধানকারী সেই তাওরাতের, যা আমার আগে এসেছে, আর সুসংবাদদাতা এমন একজন রসুলের যে আমার পরে আসবে, যার নাম হবে আহমদ’ (সুরা আস সফ-৬)। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন শিষ্টাচার ও বিনয়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর সময় যে আরবরা ছিল শতধা বিভক্ত, হানাহানি ছিল যাদের স্বভাবের অংশ, তারা ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হয়।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সহিষ্ণুতার প্রতীক। শত অত্যাচার-নির্যাতনে স্বদেশভূমি ত্যাগ করেও তিনি রব্বুল আলামিনের মহান বাণী প্রচারে ক্ষান্ত হননি। তিনি জানতেন আজ যারা তাঁর দীন প্রচারে বিরোধিতা করছে, কিংবা বাধা সৃষ্টি করছে, কাল তারা ইসলামের আলো হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করবে। তাই তাঁর জীবদ্দশায় যারাই শত্রু ছিল তাদের সবাইকে তিনি ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তঃকরণ ছিল সমবেদনায় পরিপূর্ণ। বিরোধীদের সব অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে তাঁর ধৈর্য ও সহ্য ছিল সীমাহীন। তাঁকে যারা কষ্ট দিত, তাদের তিনি খুশি মনে ক্ষমা করতেন। যারা তাঁর ক্ষতি করত, তাদের তিনি মহান ঔদার্যের মাধ্যমে প্রতিদান দিতেন! যারা তাঁকে বঞ্চিত করত, তাদের তিনি অকাতরে দান করতেন। যারা জুলুম করত, তাদের প্রতি তিনি ছিলেন উদার। তাঁর বৈপ্লবিক জীবনে শত্রুর প্রতি দয়া ও ক্ষমার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত দেখা যায়। তিনি হিজরতের আগে তায়েফে ইসলাম প্রচার করতে যান, তখন সেখানকার মানুষ তাঁকে অকথ্য অত্যাচার করে তাড়িয়ে দেয়। তখন রসুল (সা.) বলেছিলেন, হে আল্লাহ! এরা কী করেছে, তা এরা বুঝতে পারছে না। তুমি এদের অন্তঃকরণে জ্ঞানের আলো প্রজ্বলিত করো। তিনি নিজে কখনো কারও ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। নিজ হাতে কোনো মানুষ এমনকি কোনো জীবজন্তুকে পর্যন্ত আঘাত করেননি। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমি কখনো নিজের তরফ থেকে কারও জুলুমের বদলা নিতে দেখিনি। অবশ্য কেউ আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করলে তাঁর চেয়ে বেশি রাগান্বিত হতেও আমি কাউকে দেখিনি। বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে প্রচুরসংখ্যক শত্রু বন্দি হয়। এর অনেককেই রসুল (সা.) মুক্তিমূল্য, শিক্ষাদান আর যারা নিঃস্ব-গরিব তাদের এমনিতেই মুক্তি দিয়েছিলেন। শত্রুদের প্রতি রসুল (সা.)-এর মহানুভবতা ও আচরণের আর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দাকে ক্ষমা করে দেওয়া। ওহুদের যুদ্ধে এই নারী শহীদ হামজার কলিজা চিবিয়েছিলেন। হামজার হত্যাকারী ওহুশিকে দেখে রসুল (সা.) শোক সংবরণ করতে পারেননি। তাই ওহুশিকে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাকে ক্ষমা করলাম, তবে তুমি আর আমার সামনে এসো না।’ শত্রুর প্রতি তাঁর ছিল এমন দয়া ও দাক্ষিণ্য। জাতিধর্মনির্বিশেষে সবার প্রতি তাঁর অন্তর ছিল উদার ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। চরম শত্রুও তাঁর অপূর্ব ক্ষমা ও দয়ায় হয়ে যেত বিমুগ্ধ।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমেনা খাতুন হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাডেট ইনস্টিটিউট কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ