অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, এ অন্তর্বর্তী সরকার- যার নেতৃত্বে ড. মুহাম্মদ ইউনূস রয়েছেন, তারা তাদের অন্তরিকতা, দেশপ্রেম ও যোগ্যতা দিয়ে দেশকে খুব দ্রুত একটা স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদী। একই সঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্রুত সরকারের সংলাপেরও দাবি জানান তিনি। অপরদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছেন, বৈঠকে বিএনপি প্রতিনিধি দল অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছে। বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের যে সংলাপ তারা চাচ্ছিলেন, তা গত ৩১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১২টি দল ও জোটের নেতারা সেদিন মতবিনিময় করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে। খবরে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্র সংস্কার প্রশ্নে প্রায় দুই হাজারেরও বেশি দাবি ও প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা বরাবর। তারা প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দাবি করলেও কোনো সময়সীমা বেঁধে দেননি। পক্ষান্তরে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আয়োজনে অযৌক্তিক সময় নষ্ট করবে না অন্তর্বর্তী সরকার, যৌক্তিক সময়ের মধ্যেই নির্বাচন দেওয়া হবে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বৈঠকের পর একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, রাষ্ট্র সংস্কার প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকার ও দলগুলোর পারস্পরিক অবস্থানে তেমন একটা ফারাক নেই। গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে আস্থার পরিবেশ এ মুহূর্তে প্রয়োজন, তা সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে বিএনপি মহাসচিবের ‘অতি দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ’ দাবি করা নিয়ে সচেতন মহলে যে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছিল, তাও অনেকটা কেটে গেছে। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সৃষ্ট সমঝোতার পরিবেশ কোনো কারণে বিনষ্ট না হলে দেশে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসবে বলে সবাই আশাবাদী।
তবে এর আগে বিএনপি মহাসচিবের ‘অতিদ্রুত’ নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়েছিলেন সরকারের কাছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলে দেওয়া হয়েছে সংস্কার শেষেই নির্বাচন হবে। বিএনপি তা মেনেও নিয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপি এখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী দল। নির্বাচন যখনই হোক, দৈবদুর্বিপাক না হলে বিএনপির জয়ী হওয়া ও সরকার গঠনের বিষয়টি মোটামুটি নিশ্চিত। তাহলে কেন এ অতি দ্রুত নির্বাচনি রোডম্যাপ দাবি? কেউ কেউ বলছেন, আঠারো বছর রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির এখন আর তর সইছে না। অনেকে আবার হাসিনা সরকারের পতনের ক্ষেত্রে বিএনপির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। তারা বলছেন, গত পনেরো বছর চেষ্টা করেও বিএনপি শেখ হাসিনার গদিকে এতটুকু টলাতে পারেনি। ওই দীর্ঘ সময়ে তারা বারবার সরকার উৎখাতের ‘আলটিমেটাম’ দিলেও শেষ পর্যন্ত তা বায়বীয় আস্ফালন হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছে। এবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পনেরো দিনে সে অসাধ্য সাধন করেছে। শিক্ষার্থী-জনতার রক্তসিক্ত রাজপথে যে গণঐক্য গড়ে উঠেছিল তার সামনে টিকে থাকতে না পেরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন দুঃশাসক শেখ হাসিনা।
অবশ্য এটা অনস্বীকার্য যে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও তাদের অনুগামী দলগুলো ছাড়া দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই সমর্থন দিয়েছিল। সে আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতির ফসল এ অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে বিএনপি শুধু নয়, কোনো রাজনৈতিক দলেরই ক্ষমতার এ পট পরিবর্তনের একক কৃতিত্ব দাবি করার সুযোগ নেই। আর সরকারও কোনো রাজনৈতিক দলের অযৌক্তিক দাবির কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য নয়। আবার এটাও ঠিক যে, একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার অনির্দিষ্টকাল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে পারে না। নির্বাচিত সরকারের কাছে তাদের অবশ্যই দায়িত্ব হস্তান্তর করতে হবে। তবে সে হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য যে পরিবেশ দরকার তা এ সরকারকেই তৈরি করতে হবে। আর সেজন্য দরকার পর্যাপ্ত সময়। গত ২৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, কখন নির্বাচন হবে এবং তারা সরকারের দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাবেন, সেটা দেশবাসীকেই ঠিক করতে হবে। তিনি দেশবাসীকে এ সরকারের ‘নিয়োগকর্তা’ আখ্যায়িত করে বলেছেন, তারা যখন বলবেন, তখনই এ সরকার চলে যাবে। সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে রাষ্ট্রের যেসব বিষয়ের সংস্কারের কথা বলেছেন, তা সম্পন্ন করতে বেশ, কয়েক বছর সময় লাগবে। কেননা, ড. ইউনূসের হাতে কোনো আলাদীনের চেরাগ নেই যে, তাতে ঘষা দিলে দৈত্য এসে বলবে- ‘গোলাম হাজির, হুকুম করো মালিক’ এবং তিনি বলবেন- ‘সবকিছু সাফ করে দাও’ আর চোখের নিমিষে তা হয়ে যাবে।
এদিকে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার রাষ্ট্র সংস্কারে ছয় দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য সংবিধানের আমূল পরিবর্তন আনতে হবে, প্রচলিত আইনকানুন যুগোপযোগী করতে হবে, ব্যক্তির পরিবর্তনের পাশাপাশি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অবসান ঘটাতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। (২৬ আগস্ট, ২০২৪)। অপরদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি গত ২৮ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। তাদের প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে- এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকা, একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান, সরকারপ্রধান ও সংসদ নেতা না থাকা, দলীয় প্রভাবমুক্ত স্পিকার নির্বাচন ও বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ, দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থা প্রণয়ন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধন করে সংসদে এমপিদের ভোটদানের স্বাধীনতা প্রদান ইত্যাদি। এ ছাড়া ২৯ আগস্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এর উপদেষ্টা বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আলী রীয়াজ এক সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনিও দুই মেয়াদের বেশি একজন ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকা এবং সংবিধানের পুনর্লিখনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। যেহেতু এখন সংসদ নেই তাই রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে ‘কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি’ বা ‘গণপরিষদ’ গঠন করে সংবিধানের পুনর্লিখন সম্ভব বলে অনেকে মনে করেন।
সব মিলিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের যেসব প্রস্তাবনা এ পর্যন্ত সমাজের বিভিন্ন কর্নার থেকে এসেছে, তার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের চিন্তাভাবনার খুব একটা বৈপরীত্য নেই। এসব প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ সমাধা করা এক-দুই বছরে সম্ভব নয়। কেননা, এ সংস্কার কাজ করতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। যাতে ‘বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘরের’ মতো কোনো ছিদ্র না থাকে, যা দিয়ে কোনো বিষধর সাপ প্রবেশ করে লখিন্দরকে (রাষ্ট্র) ছোবল মারতে না পারে। সবচেয়ে বড় কথা সুযোগ বারবার আসে না। তাই যেহেতু এবার সুযোগ এসেছে, তাই সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। শীতের আগমনের শুরুতেই গাছিরা যেমন খেজুর গাছের পুরনো ডাল-পাতা ও শুকিয়ে যাওয়া বাকল ফেলে দিয়ে গাছকে পরিষ্কার করে রস আহরণের উপযোগী করে তোলে, তেমনি এবার আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার পুরনো সব আবর্জনা ছেঁটে ফেলে পরিষ্কার করে তুলতে হবে একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য।
বিএনপি মহাসচিব তাঁর পূর্ববর্তী বক্তব্যে দাবি করেছিলেন, সংস্কার হতে হবে জনগণের মাধ্যমে অর্থাৎ নির্বাচিত পার্লামেন্টের দ্বারা। একদিক দিয়ে তিনি ভুল বলেননি। তবে অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এ ধরনের রাষ্ট্র সংস্কার দলীয় সরকারের অধীনে কখনোই সম্ভব হয় না। কেননা, রাজনৈতিক দলগুলোর পদক্ষেপের মধ্যে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও লাভ-লোকসানের হিসাব-নিকাশ থাকে। ফলে জনসাধারণের মনে এরই মধ্যে প্রতীতী জন্মেছে যে, রাষ্ট্রের যে কোনো ইতিবাচক সংস্কার একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের মাধ্যমেই হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর অতীত কার্যকলাপের কারণেই জনগণ তাদের ওপর আস্থা হারিয়েছে। এটি একটি বাস্তবতা। তাই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্বাচনের পর দলীয় সরকারের বদলে জাতীয় সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার আগ্রহ দেখিয়েছেন। যাতে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মকান্ড অব্যাহত থাকে।
এর আগেও বাংলাদেশকে গণতন্ত্রায়ন ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে সংস্কারের একাধিক সুযোগ আমাদের সামনে এসেছিল। প্রথমে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর, দ্বিতীয়বার ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর। কিন্তু দুভার্গ্যজনক হলো, দুবারই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সুযোগ আমরা হারিয়েছি। আজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় জনগণের বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ ও রাজনৈতিক অধিকার হরণ করেছিলেন। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্রের কবর রচনা করে কায়েম করেছিলেন একদলীয় পদ্ধতি; যা বাকশালী পদ্ধতি হিসেবেই সমধিক পরিচিত।
দীর্ঘ নয় বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের পর ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন হয় স্বৈরশাসক এরশাদের। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭-দলীয় ঐক্যজোট, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দল ও ৫-দলীয় বাম মোর্চা, এই তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয় বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অন্তর্বর্তী সরকার। সে সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। আবার ১৯৯৬ সালে নিজেদের আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদৌলতে ২০০৮ সালেও ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ২০১১ সালে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেই গলাটিপে হত্যা করে। সুতরাং এটা প্রমাণিত, দলীয় সরকারের দ্বারা জনগণ-কাক্সিক্ষত রাষ্ট্র সংস্কার সম্ভব নয়, অন্তত আমাদের দেশে। নির্বাচনের পর আগামীতে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা হলে রাষ্ট্র সংস্কারের কাক্সিক্ষত ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে। তবে তা যাতে কথার কথা নয় সে ব্যাপারেও সচেতন থাকা দরকার।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক