মহানবী (সা.)-এর মুহতারামা জননী বিবি আমিনা বলেন, যখন মহানবী (সা.) তাঁর গর্ভে স্থিতি লাভ করলেন, তখন তাঁকে স্বপ্নে সুসংবাদ দান করা হয় যে, “তোমার গর্ভে যে সন্তানটি রয়েছে তিনি এই উম্মতের সরদার। অধিকাংশ আলেমের মতে ‘আসহাবে ফিল’ অর্থাৎ হস্তিবাহিনী নিয়ে আবরাহা যে বছর কাবাঘর আক্রমণ করেছিল, সেই বছরের রবিউল আউয়াল মাসে সোমবার মহানবী (সা.) এর শুভজন্ম হয়। মহান আল্লাহ তাদেরকে আবাবিল নামক কতিপয় ক্ষুদ্র পাখির মাধ্যমে পরাভূত করেন। পবিত্র কোরআনের সুরা ফিলে এর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা রয়েছে। বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে : আদম (আ.)-এর পৃথিবীতে অবতরণের প্রায় ৬ হাজার ৩৯২ বছর পরে অর্থাৎ সপ্তম সহস্রাব্দে আখেরি নবী মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (সা.) এ পৃথিবীতে শুভাগমন করেছিলেন। (তারিখে ইবনে আসাকির, মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক হতে প্রথম খন্ড, পৃ. ১৯-২০)। মহানবী (সা.) এর জন্মের সময় পারস্য রাজপ্রাসাদের ১৪টি গম্বুজ ভূমিকম্পে ধসে পড়ে। পারস্যের শ্বেত উপসাগর সহসাই শুকিয়ে যায়। পারস্যের অগ্নিকুন্ড নিজে নিজেই নিভে যায়- যা বিগত এক হাজার বছর ধরে মুহূর্তের জন্যও নির্বাপিত হয়নি। (সিরাতে মোগলতাঈ, পৃ. ৫)।
বস্তুত এ ছিল অগ্নিউপাসনা ও যাবতীয় গোমরাহির পরিসমাপ্তির ঘোষণা এবং পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যের পতনের প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। সহিহ হাদিসগুলোতে বর্ণিত আছে যে, মহানবীর (সা.) ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় তাঁর ¯ন্ডেœহময়ী জননীর উদর হতে এমন একটি নূর প্রকাশিত হয়, যার আলোতে উদয়াচল ও অস্তাচল আলোকিত হয়ে ওঠে। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, মহানবী (সা.) যখন ভূমিষ্ঠ হলেন, তখন তিনি উভয় হাতের ওপর ভর দেওয়া অবস্থায় ছিলেন। তারপর তিনি এক মুষ্টি মাটি হাতে তুলে নিলেন এবং আকাশের দিকে তাকালেন। (মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া)।
মহানবী (সা.) ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে তাঁর সম্মানিত পিতা আবদুল্লাহকে তাঁর পিতা আবদুল মুত্তালিব মদিনা প্রেরণ করেন। আবদুল্লাহ তাঁকে গর্ভাবস্থায় রেখে মদিনা চলে যান। ঘটনাক্রমে সেখানেই তাঁর ইন্তিকাল হয়ে যায়। এভাবেই ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই পিতৃছায়া তাঁর মাথার ওপর থেকে অপসৃত হয়। (সিরাতে মোগলতাঈ, পৃ. ৭)।
শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রথমে তাঁর শ্রদ্ধেয় জননী এবং এরপর আবু লাহাবের দাসী ছুওয়ায়বা স্তন্যদান করেন। তারপর হালিমা সাদিয়া এ পরম সৌভাগ্যের অধিকারিণী হন। (সিরাতে মোগলতাঈ)। আরবের সম্ভ্রান্ত গোত্রগুলোর মধ্যে সাধারণভাবে এ প্রথা প্রচলিত ছিল যে, তারা দুধপান করার জন্য নিজ সন্তানদের আশপাশের গ্রামে পাঠিয়ে দিত। এতে শিশুদের দৈহিক স্বাস্থ্য সুন্দররূপে বিকাশ লাভ করত এবং তারা বিশুদ্ধ আরবি ভাষাও আয়ত্ত করে নিত। আর এ কারণেই গ্রামের মহিলারা দুগ্ধপোষ্য শিশু সংগ্রহের উদ্দেশ্যে প্রায়শই শহরে গমন করত। প্রথানুযায়ী হালিমা সাদিয়া (রা.) দুগ্ধ পোষ্য শিশুর সন্ধ্যানে বানু সাদ গোত্রের অন্যদের সঙ্গে তায়েফ হতে মক্কা গমন করেন। ওই বছর দেশে দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছিল। হালিমার কোলেও তার একটি দুগ্ধ পোষ্য শিশু ছিল। কিন্তু দরিদ্রতার কারণে অভুক্ত থাকায় তার স্তনে যথেষ্ট পরিমাণ দুধ ছিল না। সারা রাত ওই শিশু ক্ষুধার তাড়নায় কাতরাত। তাদের একটি উটনিও ছিল কিন্তু উটনির স্তনেও তখন দুধ ছিল না। মক্কায় পৌঁছে জানতে পারল মুহাম্মদ নামে একটি শিশু এতিম থাকায় তার পক্ষে যথেষ্ট পুরস্কার ও সম্মানী না দেওয়ার কারণে কেউ তাকে গ্রহণ করতে রাজি হচ্ছিল না। অপরদিকে হালিমার দুধের স্বল্পতা দেখে তাকেও কেউ শিশু দিতে সম্মত হচ্ছিল না। তখন হালিমা (রা.) খালি হাতে ফিরে যাওয়ার চেয়ে তার স্বামীর সম্মতিতে এ শিশুকে গ্রহণ করেন। আল্লাহর রহমতে হালিমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো এবং দোজাহানের সরদার শিশু মুহাম্মদ (সা.) তাঁর কোলে চলে এলেন। তাঁবুতে ফিরে দুধপান করাতে বসার সঙ্গে সঙ্গে বরকত ও কল্যাণের অজস্র ধারা প্রকাশ পেতে লাগল। স্তনে এত অধিক পরিমাণে দুধ নেমে এলো যে, শিশু মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর দুধভাই উভয়ে তৃপ্তি সহকারে পান করলেন এবং ঘুমিয়ে পড়লেন। এদিকে উটনির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন যে, তার স্তন দুধে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। হালিমা বলেন, “আমার স্বামী উটনির দুধ দোহন করে আনলেন এবং আমরা সবাই খুব পরিতৃপ্ত হয়ে পান করলাম। যাই হোক শিশু মুহাম্মদকে নিয়ে তারা বাড়ি পৌঁছলেন। হালিমার পরিবার যেখানে চরম দুর্ভিক্ষে ছিল, বাড়ি পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তাদের গৃহের সবকটি বকরির স্তন দুধে ভরপুর হয়ে উঠল। এমনিভাবে তারা শিশু মুহাম্মাদ-এর বরকতগুলো প্রত্যক্ষ করছিলেন। এমনিভাবে দুই বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর হালিমা শিশু মুহাম্মদকে দুধ পান ছাড়িয়ে দিলেন। (আস-সালিহাত)।
হালিমা (রা.) বলেন, যে সময় আমি শিশু মুহাম্মদকে দুধ ছাড়ালাম তখন তাঁর পবিত্র জবান থেকে এ কথাটি উচ্চারিত হয়েছিল “আল্লাহু আকবার কাবিরা ওয়ালহামদুল্লিাহে কাছিরা ওয়া সুবহানাল্লাহে বুকরাতাও ওয়াছিলা।” অর্থ : ‘আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহর জন্যই সব প্রশংসা, আল্লাহর জন্যই অনেক অনেক প্রশংসা’, এটাই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম বাক্য’ বায়হাকি ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করেছেন। (খাসাইসে কুবরা প্রথম খন্ড, পৃ.-৫৫)।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ইসলামবিষয়ক গবেষক