আগস্টের আকস্মিক বন্যা দেশের পূর্বাঞ্চলে ১১টি জেলায় ভয়াবহ হলেও কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে ফসলি জমি আক্রান্ত হয়েছে ২৩ জেলার। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৫৭৩ হেক্টর ফসলি জমি; দুর্দশায় পড়েছেন ১৪ লাখেরও বেশি কৃষক। বন্যা-পরবর্তী সময় ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো কৃষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহযোগিতায় অন্তর্র্বর্তী সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়েও অনেকে উদ্যোগ নিচ্ছেন, যা সত্যি আশাজাগানিয়া। বন্যা ত্রাণ কার্যক্রম যখন চলছে তখন আমি ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে এবং ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এর কলামে চারা উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকদের সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছিলাম। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চারা উৎপাদনের দারুণ উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। খবর নিয়ে জেনেছি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ একর, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ একর, চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ৪ একর, লক্ষ্মীপুরে ২ একরসহ মোট ১২ একর জমিতে চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। এ চারায় রোপণ করা যাবে সাড়ে সাত শ বিঘা জমি। তরুণ শিক্ষার্থীদের এ উদ্যোগ সত্যি প্রশংসনীয়।
বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কৃষিবিজ্ঞান বিভাগ উদ্যোগ নিয়েছে ৪০ লাখ ধানের চারা উৎপাদনের। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষক আবদুর রহিম এখন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কৃষিবিজ্ঞান বিভাগে কর্মরত। তিনি আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাদের কার্যক্রমটি ঘুরে দেখার জন্য। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আশুলিয়ার স্থায়ী ক্যাম্পাসটি সুন্দরভাবে সাজানো। সবুজ এবং দৃষ্টিনন্দন চারপাশ। তরুণ শিক্ষার্থীদের কলরোল আমার তারুণ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। আমাদের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটি ছিল সবুজ এবং নীরব। অধ্যাপক রহিম আমাদের স্বাগত জানালেন। প্রথমেই নিয়ে গেলেন কৃষি বিভাগের নিজস্ব মাঠ কৃষি গবেষণা প্লটে। সেখানে একদল শিক্ষার্থী আপন মনে কাজ করছে। ড. রহিম জানালেন, কৃষিবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা এ উদ্যোগে একই সঙ্গে ব্যবহারিক শিক্ষা যেমন অর্জন করছে, তাদের প্রচেষ্টায় উৎপাদন হচ্ছে কৃষকের জন্য ধানের চারা। ১২০ একর জমিতে ধান চাষের জন্য প্রয়োজনীয় চারা উৎপাদন চলছে বিভিন্ন প্লটে ভিন্ন ভিন্ন ধাপে। শিক্ষার্থীরা ট্রে পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করছেন। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলি। বেশ প্রফুল্ল তারা। ড. রহিম মনে করিয়ে দিলেন আমাদের ‘ফিরে চল মাটির টানে’ কার্যক্রমের কথা। বললেন, আপনার ‘ফিরে চল মাটির টানে’ অনুষ্ঠানে যেমন শিক্ষার্থীরা কৃষকের মাঠে কাজ করে কৃষির মর্ম উপলব্ধি করে, একইভাবে তারা তাদের ক্যাম্পাসে বন্যায় আক্রান্ত কৃষকদের জন্য এ কাজ করতে গিয়ে কৃষির গুরুত্ব নতুনভাবে উপলব্ধি করছে।’
চার পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনের কাজ চলছে। ট্রে পদ্ধতিতে যে চারা উৎপাদন হচ্ছে তা রোপণ করা হবে মেশিনের সাহায্যে। বীজতলায় ব্রডকাস্ট অর্থাৎ ছিটিয়ে তৈরি করা হচ্ছে চারা। এসব চারা সনাতন পদ্ধতিতে রোপণ করা হবে। ওয়েট বেড তৈরি করে চারা তৈরি করছে শিক্ষার্থীরা। তরুণদের এ ব্যতিক্রমী উদ্যোগগুলো দারুণ প্রশংসনীয়। তারা শুধু ধানের চারাই নয়, তৈরি করছে সবজির চারাও। শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে দারুণ উৎসাহ নিয়ে তরুণ শিক্ষার্থীরা আত্মনিয়োগ করেছে এ কাজে। কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় আমার। তারা তাদের কাজের উৎসাহ হিসেবে মানবিক দিকটাকেই তুলে ধরে। বন্যার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ থেকে শিক্ষার্থীরা চায় পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে সব সংকট দূর করে সুন্দর একটি দেশ গড়তে। দল বেঁধে তারা কাজ করছে। কেউ মাটি তৈরি করছে। কেউবা তৈরিকৃত মাটি পলি ব্যাগে ভরছে। অন্য দল সেই ব্যাগে পুঁতে রাখছে সম্ভাবনার বীজ। দেখে খুব ভালো লাগল। একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে শিক্ষার্থীদের এ সম্মিলিত প্রচেষ্টা বড় আশাবাদী করে। আর মনে পড়ে আমরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এভাবে কাজ করেছি বন্যার্তদের সহযোগিতা করার জন্য। দলবেঁধে কত শত রুটি বানিয়েছি। কেউ রুটি বানাতাম, কেউবা রুটি সেঁকত, আর কেউ কেউ রুটি প্যাকেট করত। তারুণ্যের এ শক্তি দেখে নিজের তারুণ্যবেলার কথা ভাবছিলাম।
মাঠে শিক্ষার্থীরা দাপোগ পদ্ধতিতেও চারা তৈরি করা শিখছিলেন। দাপোগ পদ্ধতিতে চারা তৈরির ক্ষেত্রে বাড়ির উঠান বা যে কোনো শুকনো জায়গায় অথবা কাদাময় সমতল জমিতে পলিথিন, কাঠ অথবা কলাগাছের বাকল দিয়ে তৈরি চৌকোনা ঘরের মতো করে তার মধ্যে অঙ্কুরিত বীজ ছড়িয়ে দিতে হয়। এ বীজতলায় মাটি থেকে চারাগাছ কোনোরূপ খাদ্য বা পানি গ্রহণ করতে পারে না বলে বীজতলায় প্রয়োজনমাফিক পানি ছিটিয়ে দিতে হয়। বীজতলায় প্রতি বর্গমিটারে সর্বোচ্চ ৩ কেজি অঙ্কুরিত বীজ দিতে হয়। এভাবে প্রস্তুতকৃত ২ থেকে ৩ বর্গমিটার দাপোগ বীজতলা থেকে উৎপাদিত চারা দিয়ে এক বিঘা জমি রোপণ করা যায়।
এসব ঘুরে দেখতে বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হলো। তারাও বলছিলেন তরুণরা যেন হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেছে। তারা দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে। এর মাঝে লক্ষ্য করলাম পাশের পুকুরের পানিতে নেমে গেছেন অধ্যাপক রহিম। তিনি ভাসমান বীজতলা তৈরির কৌশল হাতে-কলমে শেখাচ্ছিলেন শিক্ষার্থীদের। বন্যা নেমে গেলেও যদি বীজতলা তৈরির মতো জমি কৃষকের না থাকে তবে ভাসমান বীজতলা তৈরি করেও বীজ বপন করা যেতে পারে। কলার ভেলা বা কচুরিপানা দিয়ে ভেলা তৈরি করে মাটি তুলে বীজতলা তৈরি করা যায়। এ বিষয়ে আমি অনেক বছর আগে বিভিন্ন প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম। বন্যাকবলিত এলাকায় যদি বীজতলা করার মতো জায়গা না থাকে এবং বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর চারা তৈরির প্রয়োজনীয় সময় না থাকে তবে বন্যার পানি, নদী, বিল, পুকুর, ডোবা বা খালের পানির ওপর কলাগাছ কেটে বাঁশ বা কঞ্চি দিয়ে জোড়া লাগিয়ে ভেলা তৈরি করে তার ওপর হোগলা বা চাটাই দিয়ে সেখানে মাটির প্রলেপ দিতে হবে। এ ছাড়া বাঁশ এবং বাঁশের চাটাইয়ের মাচা অথবা কচুরিপানা দিয়ে তৈরি বেডের ওপর ২-৩ সেন্টিমিটার পরিমাণ পুকুরের তলার কিংবা মাটির পাতলা কাদার প্রলেপ দিয়ে ভেজা বীজতলা তৈরি করা যায়। এ ছাড়া ভাসমান বেডের যেখানে শাকসবজির আবাদ করা হতো সেখানেও আপদকালীন সময়ের জন্য আমন বীজতলা তৈরি করা যায় অনায়াসে। বন্যার পানিতে ভাসমান বেড যেন ভেসে না যায় সেজন্য ভাসমান বীজতলার বেডকে দড়ির সাহায্যে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখতে হয়। এরপর মাটির আস্তরণের ওপর অঙ্কুরিত বীজ ছিটিয়ে দিতে হয়। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্যমতে, ভাসমান বীজতলার ক্ষেত্রে অন্য স্বাভাবিক বীজতলার মতোই বীজের হার প্রতি বর্গমিটারে ৮০ থেকে ১০০ গ্রাম হবে। এক্ষেত্রে এক বিঘা জমি রোপণের জন্য ৩৫ বর্গমিটার বা প্রায় ১ শতক ভাসমান বীজতলা ব্যবহার করা যেতে পারে। চারার বয়স ২০ থেকে ২৫ দিনের হলে চারা উঠিয়ে মাঠে রোপণ করা যেতে পারে। এভাবে তৈরি চারা অন্যসব স্বাভাবিক চারার মতোই রোপণ করতে হবে এবং পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা অন্য স্বাভাবিক বীজতলার চারার মতোই হয়। পানিতে ভাসমান থাকার জন্য এ বীজতলায় সাধারণত সেচের দরকার হয় না, তবে মাঝে মধ্যে প্রয়োজনে ছিটিয়ে পানি দেওয়া যেতে পারে। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান মো. সবুর খান বন্ধুস্থানীয় মানুষ। তার সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়। তিনি তরুণ শিক্ষার্থীদের এ কার্যক্রম নিয়ে বেশ আশাবাদী। তিনি আমাকে তার আরেকটি মানবিক উদ্যোগ ঘুরে দেখালেন আমাকে। এতিম শিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ায় তার প্রচেষ্টা দেখে মুগ্ধ হলাম।
অনেক জায়গায় বন্যার পানি ইতোমধ্যে নেমে গেছে, এখনো পানির নিচে আছে অনেক কৃষিজমি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ১৪ লাখ ১৪ হাজার ৮৯ জন। ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির মধ্যে আউশ ৩৮ হাজার ৬৮৯ হেক্টর, রোপা আমন ১ লাখ ৪১ হাজার ৬০৯ হেক্টর, বোনা আমন ৭৬৪ হেক্টর, রোপা আমন বীজতলা ১৪ হাজার ৯০৮ হেক্টর, শাকসবজি ১১ হাজার ২৯০ হেক্টর এবং অন্যান্যসহ মোট ২ লাখ ৮ হাজার ৫৭৩ হেক্টর।
এ ক্ষতি কাটিয়ে তুলতে কৃষককে সহযোগিতা দিতে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের উদ্যোগ যেমন আছে, আছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ। এসব উদ্যোগ সফল করতে প্রয়োজন পারস্পরিক যোগাযোগ এবং পরিকল্পিত বণ্টন ব্যবস্থাপনা। যেন প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তের কাছে যথার্থ কৃষি ত্রাণ পৌঁছাতে পারে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা নিশ্চয়ই এ দুঃসময় কাটিয়ে উঠব ইনশাল্লাহ।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব