বাদশাহ জুলানদি। ওমানের বাদশাহ। সত্যানুসন্ধানী বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। তার কাছে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের দাওয়াত পাঠান। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে সাহাবি আমর ইবনুল আস (রা.) ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যান। বিচক্ষণ এই বাদশাহ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনন্য চরিত্র মাধুর্যে বিমোহিত হয়ে মন্তব্য করেন- আল্লাহর কসম! সে (দূত) আমাকে এমন একজন উম্মি নবীর কথা বলেছে- তিনি যখনই কোনো ভালো কাজের আদেশ করেন প্রথমে তিনিই সেই কাজটি করেন। আর যে কাজ হতে তিনি নিষেধ করেন, প্রথমে তিনিই তা বর্জন করেন। তিনি বিজয়ী হয়েও অহংকার করেন না। কেউ তাঁর ওপর প্রতাপ দেখালে রুষ্ট হন না। তিনি ওয়াদা পালন করেন। চুক্তিসমূহ বাস্তবায়ন করেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, নিঃসন্দেহে তিনি একজন সত্য নবী (কাজী ইয়াজ রচিত আশ- শিফাঃ ১/২৪৮)।
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র মাধুর্যের খানিকটা ঝলক বাদশাহ জুলানদির মন্তব্যে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আখলাক-চরিত্র ছিল পূর্ণতা ও পরিব্যাপ্তিতে বিভাসিত। তাঁর চরিত্রের প্রতিটি দিক ছিল পূর্ণাঙ্গ ও সমপর্যায়ের। পাহাড়সম ধৈর্য ও দুর্বার সাহসিকতার অপূর্ব সমন্বয় ছিল তাঁর যাপিত জীবনের ছত্রে ছত্রে। দয়া-মায়া, সহনশীলতা ও আমানতদারিতার সর্বোচ্চ চূড়ায় ছিল তাঁর অবস্থান। সময়ের আবর্তনে তাঁর চরিত্রের মাঝে তারতম্য ঘটেনি। জীবনের কোনো সময়ে একটু বেশি আবার কখনো একটু কম এমনটা ঘটেনি। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত জগতের আর কোনো মানুষের মাঝে একসঙ্গে এতগুলো চারিত্রিক গুণের সমাবেশ পরিলক্ষিত হয়নি। তাই বিখ্যাত জার্মান লেখক ও দার্শনিক কবি জোহান গ্যাটে বলতে বাধ্য হয়েছেন- ইতিহাসের পাতায় আমি তন্নতন্ন করে সর্বোচ্চ শ্রেষ্ঠ মানুষের দৃষ্টান্ত খুঁজেছি, অবশেষে তা পেয়েছি আরব নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে। (জিগরিদ হুংকেঃ শামসুল আরব তাসতায়ু আলাল গারব- ৪৬৫)। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তম চরিত্রাবলির মূল উৎস কী ছিল? কোন সে প্রেরণায় চরিত্রমাধুর্যে তিনি আকাশের উচ্চতাকেও হার মানিয়েছেন? আল কোরআনুল কারিম। হ্যাঁ, কোরআনুল কারিমই ছিল তাঁর অনন্য চরিত্র মাধুর্যের অনুপম উৎস। তিনি কোরআন মাজিদ থেকেই তাঁর চারিত্রিক গুণাবলি আহরণ ও সমৃদ্ধ করেছেন। ফলে কোরআনই তাঁর পূর্ণ গুণাবলিকে পৌঁছে দিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। তাঁর সুন্দর শিষ্টাচারকে করেছে আরও সৌন্দর্যময়, আরও বিভাময়। আর এটা সম্ভব হয়েছে কোরআনের প্রতি তাঁর আত্মনিবেদনের বদৌলতে। তিনি নিজেকে কোরআনের প্রতিটি কল্যাণের দিকেই সমর্পণ করে দিয়েছিলেন। কোরআনের অনুপম নির্দেশনামালা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যাপিত জীবনে বাস্তবায়িত চমৎকারভাবে। যেন তিনি ছিলেন কোরআনের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তাই তো হজরত সাদ ইবনে হিশাম ইবনে আমের (রা.) যখন উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.)-কে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন তখন উম্মুল মুমিনীন জবাবে বলেছিলেন- তুমি কি কোরআন পড়নি? সাদ ইবনে হিশাম বললেন- পড়েছি। হজরত আয়েশা (রা.) বললেন- কোরআনই ছিল রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আখলাক চরিত্র। (সহীহ মুসলিম-৭৪৬)
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে যেমন উত্তম চরিত্রের সর্বোচ্চ চূড়ায় ছিলেন ঠিক তেমনি অন্যদের উত্তম চরিত্রবান হওয়ার নির্দেশনা দিতেন। তিনি বলেন- নিশ্চয়ই মুমিনদের মধ্যে তার ইমান পরিপূর্ণ, যার চরিত্র সর্বোৎকৃষ্ট এবং যে তার স্ত্রী-পরিবারের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল। (সুনানে তিরমিজি- ২৬১২)। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তম চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর পরিবারের সঙ্গে, তাঁর সাথী সঙ্গী মুমিনদের সঙ্গে, সমাজে বসবাসরত অমুসলিমদের সঙ্গে এমনকি যুদ্ধরত শত্রুদলের সঙ্গেও তাঁর সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতাপূর্ণ আচরণ তাঁর চরিত্রকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। আবু সুফিয়ান (রা.) ইসলাম গ্রহণের আগে তাঁর উত্তম চরিত্রের নমুনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, যখন তিনি কাফেরদের সর্দার। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি অকপটে স্বীকার করে বলেছিলেন- “আপনার ওপর আমার পিতামাতা উৎসর্গিত হোক। আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই আপনি একজন মহান ব্যক্তি। আমি যুদ্ধ করেছি আপনার বিরুদ্ধে, আপনি কতই-না উত্তম যোদ্ধা ছিলেন! আমি আপনার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি, আপনি কতই-না উত্তম চুক্তিকারী ছিলেন!”
মহান আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। (আবু নুয়াইম ইস্পাহানীকৃত মারিফাতুস সাহাবাহ-৩/১৫০৯)। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তম চরিত্র এতটা ব্যাপক যে, তা যেন এক বিশাল দরিয়া। তাঁর চরিত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করে বিস্মিত ও বিমুগ্ধ হয়েছেন মুসলিম থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেক অমুসলিম পন্ডিতও। তারা নির্দ্বিধায় রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনন্য চরিত্র মাধুর্যের কথা স্বীকার করেছেন।
লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর