মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য, তিনিই আমাদের খালেক, হায়াত, মউত, রিজিক ও ভালো মন্দ তকদিরের মালিক। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র তরিকায় দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বোচ্চ সফলতা ও কামিয়াবি জেনে, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সব ইবাদত বন্দেগি করাও দুনিয়াবি সব সার্থকতা থেকে নিজের মুখ ফিরিয়ে নেওয়াকে ইখলাস বলা হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে, একনিষ্ঠভাবে তার ইবাদত করতে। (সুরাতুল বাইয়িনাহ আয়াত-৫)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, জেনে রাখ! খাঁটি আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য। (সুরা জুমার আয়াত-৩)। প্রিয় নবী (সা.) একদা হজরত মোয়াজ (রা.)-কে বললেন, হে মুয়াজ! তুমি ইখলাসের সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত কর, তাতে অল্প ইবাদতই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। (আল হাদিস)। উপরোক্ত বর্ণনা থেকে জানা গেল যে, ইখলাস বা আন্তরিকতাসহ দীনের কাজ করলে তা আল্লাহর কাছে খুবই পছন্দনীয়। ইখলাসের সঙ্গে নিয়তের বিশুদ্ধতাও একান্ত প্রয়োজন। এ সম্পর্কে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহর কাছে মানুষের আমলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ত অনুসারে হয়। প্রত্যেক মানুষ তার কাজের ফলাফল আল্লাহর কাছে সে রকমই পাবে, যে রূপ সে নিয়ত করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সন্তুষ্টির জন্য হিজরত করবে, অবশ্যই তাঁর হিজরত আল্লাহ ও রসুলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। আর কেউ যদি পার্থীব জীবনের উদ্দেশে অথবা কোনো মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশে হিজরত করে তবে তার হিজরত হবে সেজন্যই। (বোখারি ও মুসলিম)। উপরোক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয় যে, মানুষ যখন কোনো কাজ করে তখন সে মনে মনে একটা উদ্দেশ্য ঠিক করে সেই কাজের প্রতি অগ্রসর হয়। এটা মানুষের জন্মগত স্বভাব। এবং এ উদ্দেশের পরিপ্রেক্ষিতেই মানুষ তার কাজের ফলাফল আল্লাহর কাছে পাবে। যেমন হিজরত বড় পুণ্যের কাজ এবং কঠিন। কারণ এতে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ধন দৌলত, ঘরবাড়ি, ও জন্মস্থান সবকিছু পরিত্যাগ করতে হয়। কোরআন ও হাদিসে হিজরতের অনেক সওয়াব ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং হিজরত যদি আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সন্তুষ্টির জন্যই হয়ে থাকে তবে আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদা পাবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে হিজরত করবে, যেমন সুখ্যাতি লাভ করা, টাকা উপার্জন করা, কোনো নারীকে বিবাহ করা বা এ জাতীয় কোনো হীন স্বার্থ হাসিল করা, সে কোনোরূপ সওয়াবের অধিকারী হবে না। প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেন- সর্বপ্রথম বিচারের জন্য কেয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে হাজির করা হবে, যে শহীদ হয়েছিল। সেই ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার যেসব নেয়ামত ভোগ করেছিল তা তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে। এবং তার স্বীকারও করবে। এরপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি এসব নেয়ামতের বিনিময়ে কী আমল করেছ? সে বলবে হে আমার প্রতিপালক! আমি তো আপনার দীনের জন্য জিহাদ করে শহীদ হয়েছি। তখন আল্লাহতায়ালা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি তো জিহাদ করেছিলে বীর পুরুষ বলে অভিহিত হওয়ার জন্য, তা তো তোমাকে বলা হয়েছে। অতঃপর তার সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া হবে এবং তাকে অধোমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর এমন এক ব্যক্তিকে হাজির করা হবে, যে ইলম শিখেছে এবং অপরকে শিখিয়েছে ও নিজে কোরআন পড়েছে। তাকেও তার প্রদত্ত নেয়ামতের কথা স্মরণ করতে দেওয়া হবে। এবং সে তা স্বীকার করবে। সে বলবে, হে আমার রব! আমি ইলম শিখেছি ও অন্যকে শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্য কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত করেছি। আল্লাহতায়ালা তখন বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ, বরং তোমার উদ্দেশ্য ছিল লোকেরা তোমাকে আলিম বলবে এবং কোরআন পড়েছ, যাতে লোকেরা বলবে সে একজন কারি, তা তো বলা হয়েছেই। অতঃপর তাকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। মূলত এটা হবে দুনিয়াদার, অর্থলোভী আলেমের পরিণতি। অতঃপর এমন ব্যক্তিকে হাজির করা হবে, যাকে আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রকার ধন দৌলত দান করেছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তুমি আমার জন্য কী আমল করেছ? সে বলবে, হে আমার রব! যেখানে দান করলে আপনি সন্তুষ্ট হবেন, আমি সেসব স্থানে দান খয়রাত করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি তো এই জন্য তা করেছ, যাতে তোমাকে দাতা বলা হয়, তা তো বলাও হয়েছে। অতঃপর তাকেও অধমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসলিম শরিফ)। উপরোক্ত হাদিসের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় প্রতিটি কাজের শুরুতেই নিজের উদ্দেশ্যকে সঠিক করে নেওয়া, আমি যে কাজটি করছি সেটা শুধু আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সন্তুষ্টির জন্য হচ্ছে কি না। নাকি দুনিয়াবি কোনো হীন স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশে আমি করছি। যদি আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উদ্দেশে হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহতায়ালা তাকে মহাবিনিময় দানে পুরস্কৃত করবেন। আর যদি দুনিয়াবি হীন স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে শাস্তি হিসেবে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। তাই খাঁটি নিয়তের অল্প আমলও কিয়ামতের দিন মানুষের মুক্তির জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। (আল হাদিস)। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের দুনিয়ার স্বল্প সময়ের হায়াতে জিন্দেগিতে কোরআন ও হাদিস অনুযায়ী, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সন্তুষ্টির নিমিত্তে খাঁটি মনে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : ইমাম ও খতিব, কাওলার বাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান, ঢাকা