বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষব্যক্তি শেখ হাসিনাসহ প্রত্যেককে শিক্ষার্থী ও অন্যসব নাগরিকদের পুলিশ ও অন্যসব আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগ সশস্ত্র মস্তান বাহিনী দ্বারা হত্যাকাণ্ড, গুলি, হামলায় গুরুতর আহত করা, অনেককে পঙ্গু বানিয়ে ফেলা, হিটলারি-গেস্টাপো বাহিনীর কায়দায় গুম, খুন এবং আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সমর্থক ঠিকাদার, পুলিশ-কর্মকর্তা ও অন্য আমলাদের মাধ্যমে অপরিসীম রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন ও লাখ লাখ কোটি টাকা ডলারে রূপান্তর ঘটিয়ে বিদেশে পাচার ইত্যাদির বিচার কাজ এক্ষুনি শুরু করা দরকার। এসব ভয়ংকর দুর্বৃত্ত-ডাকাত-খুনিদের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক কুড়ি হাজার ব্যক্তির বিচার সবার আগে শুরু ও সমাপ্ত করা প্রয়োজন এবং অবশ্যই এই বিচারকর্ম সম্পন্ন হতে হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এবং সর্বোচ্চ আদালত অবধি, এই অন্তর্র্বর্তী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই। এর বাইরে আরও যে প্রায় পৌনে দুই লাখ আওয়ামী-দুর্বৃত্ত থাকবে তাদের বিচার-কাজ চলমান রাখতে হবে পরবর্তী গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারের আমল অবধি।
বস্তুত, রাষ্ট্র সংস্কার ও পুনর্গঠনের যে আওয়াজটি এখন বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস জুড়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত, তার প্রথম কাজই হচ্ছে- পুলিশসহ সমগ্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে পর্যাপ্ত শৃঙ্খলায় এনে সুসংগঠিত করে সুপ্রতিষ্ঠা এবং তার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসনকালের সাড়ে পনেরো বছরের সব হত্যাকাণ্ডসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের উপযুক্ত বিচারকাজ সম্পাদন। দুঃশাসনের আওয়ামী সরকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যে ধ্বংস করে গেছে, সেগুলোর উপযুক্ত সংস্কার ও পুনর্গঠন চালাতে দ্রুততার সঙ্গে কর্মকাণ্ড পরিচালনা।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এক-এগারোর ভণ্ড সরকারের আমল থেকে সাড়ে সতেরো বছর একটানা গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে আসছে। রাজপথের আন্দোলনে অনেক নেতা-কর্মীর শাহাদাতবরণ, গুরুতর-আহত হয়ে পঙ্গুত্ব-বরণ, নিজ নিজ ব্যবসায়-বাণিজ্য উপার্জনের অবলম্বন হারানো, নিজের বাড়িঘর দোকান, ব্যবসা-ঘর সবকিছু রাজনৈতিক-দস্যুদের লুটের শিকার হওয়া এসব চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে বিএনপি এখন পোড়-খাওয়া সবচেয়ে আত্মত্যাগী সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল। দলগতভাবে তার একার যথেষ্ট শক্তি থাকার পরেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার বলে এসেছেন, বিএনপি সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমে জনগণের রায় পেলে সব ফ্যাসিস্টবিরোধী রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের জাতীয় সরকার গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। সেটা হলে নতুন কোনো কর্তৃত্ববাদী, স্বৈরাচারী সরকার আসার আশঙ্কা ‘একেবারে শূন্য’ হয়ে যাবে। তাই অন্তর্র্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে মাঝপথে দ্রুত অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে চলে গেলেও কোনো সমস্যা থাকবে না।
এদিকে অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বারবার বলে চলেছেন- “রাষ্ট্র সংস্কার ও পুনর্গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারের যৌক্তিক ও পর্যাপ্ত সময় প্রয়োজন। এবার যদি রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম ব্যর্থ হয়, তাহলে এই বাংলাদেশ-রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র থাকবে না।” আন্দোলনকারী এবং বিপ্লবী শিক্ষার্থীরাও বারবার বলে যাচ্ছেন, রাষ্ট্র সংস্কার ছাড়া তারা রাজপথ ছাড়বেন না। দেশের সুশীল ও বিভিন্ন পেশাজীবী নাগরিকও রাজপথের সংগ্রামরত ছাত্রদের বক্তব্য সমর্থন করছেন। তারা সবাই এ দেশের তেপ্পান্ন বছরের ইতিহাসে বারবার স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদী শাসকের ফিরে আসার অভিজ্ঞতা থেকে সাংঘাতিকভাবে ভয় পাচ্ছেন- আবার হয়তো পুরনো ফ্যাসিবাদ নতুনরূপে ফিরে আসবে, দেশ-মানুষ নিঃস্ব থেকে আরও নিঃস্বই হবে। দুর্ভাগ্যজনক কিছু ঘটনা দেশের নাগরিকদের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। যদিও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিব দলের নেতা-কর্মীদের কঠোরভাবে সাবধান করে যাচ্ছেন- যাতে লড়াকু নেতা-কর্মী, সংগঠকরা আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের মতো দখলবাজি, চাঁদাবাজি না করে। সুস্থ রাজনীতির পথে থেকে যেন সংগ্রাম চালিয়ে যান। বেশ কিছু অনাচারের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব অভিযোগ এখনো প্রকাশিত হচ্ছে, যা দুশ্চিন্তার কারণ।
অন্তর্বর্তী সরকার বৈধ-অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে যে তৎপরতা চালাচ্ছে তা খুবই ধীরগতির। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী ও টহলরত প্রতিরক্ষা বাহিনী সদস্যদের বাড়তি ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে, বিভিন্ন শিক্ষার্থী গোষ্ঠী ও গার্মেন্ট সেক্টরসহ অনেক পেশাজীবী শ্রমিক-কর্মচারীরা তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলনে রাজপথে নামার কারণে। যারা ফ্যাক্টরিগুলোতে হামলা-ভাঙচুর চালাচ্ছে, তাদের পেছনে পতিত স্বৈরাচারের ষড়যন্ত্রকারীরা আছেন উসকানি-দাতারূপে। এসব চক্রান্তকারীদের কয়েকজনকে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমনকী সচিবালয়-কেন্দ্রিক আমলাগোষ্ঠীর একাংশ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, পদোন্নতি, জেলা প্রশাসক হওয়া ইত্যাদি নিয়ে অযৌক্তিক আন্দোলন ও অস্থিরতা সৃষ্টি করছেন। এসব ঘটনা সরকারকে এতটুকু স্বস্তিতে কাজ করতে দিচ্ছে না।
পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের নেতাদের বিচার কাজের বিষয়টি এগোচ্ছে খুবই ধীরগতিতে। তাদের প্রধান নেতা শেখ হাসিনা তো প্রথম সুযোগেই পলায়ন করে ভারতে গিয়ে উঠেছেন। ইতোমধ্যে তার সঙ্গী-সাথী সব দুর্বৃত্ত-নেতার অনেকেই ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, বর্ডার দালালদের বিপুল অঙ্কের ঘুষ দিয়ে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি আওয়ামী লীগ নেতাদের দেশের ভিতরে আটকে রাখার কাজে ব্যর্থ। দেশের ভিতরে পুলিশ ও অন্যসব আইন-রক্ষা বাহিনী এখনো দুর্বল দশায়, তাদের মন-মানসিকতায় যথেষ্ট দেশপ্রেম ও সাহসিকতার নিদারুণ সংকট। তাদের স্বস্তিদায়ক কর্ম-পরিবেশ না-দেওয়া অবধি তাদের মনোবল চাঙা করাই কঠিন। অবস্থাদৃষ্টে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, উপদেষ্টাদের বেশির ভাগই অনভিজ্ঞ এবং অদক্ষ। তারা যতটা আলাপ-আলোচনায় দক্ষ, ততটাই অদক্ষ আসল কাজে। আর প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সচিব ও তার অধীনস্ত অন্যসব আমলা সদ্য-সাবেক সরকারের মোসাহেব-স্তাবকের জায়গাটা পরিত্যাগে অনিচ্ছুক এবং নিজেদের অবৈধ-উপার্জনের পথ বন্ধ হওয়ায় বাড়তি হতাশায় বিষণ্নতায় ভুগছেন। আশার কথা, রাজপথের সংগ্রামী শিক্ষার্থীরা অতি-মাত্রার আত্মসন্তুষ্টি নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েনি; তারা সাবধান হয়েছেন- পাল্টা-অভ্যুত্থান প্রতিরোধে এবং পতিত-স্বৈরাচারের সঙ্গে বিপ্লবী-পক্ষের যে কোনো ধরনের আপসরফার বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশের তেপ্পান্ন বছরের ইতিহাসে আমরা দেখেছি, একটি সরকারের পতনের পরবর্তী সরকার নানা কারণে পূর্ববর্তী সরকারের জঘন্য হত্যাকাণ্ড, নানা অপরাধ, রাষ্ট্র-লুণ্ঠন ইত্যাদির বিচার-কাজ করতে পারেনি। ভয়ংকর অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে হেসে-খেলে বদমায়েশির নতুন চক্রান্ত করেছে। প্রথম সাড়ে তিন বছরে (১৯৭২-১৯৭৫/ ১৪ আগস্ট অবধি) কুড়ি হাজার থেকে তেত্রিশ হাজার বাম প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক নেতা-কর্মী রাজনৈতিক হত্যার শিকার হয়েছেন আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের হাতে। পরবর্তী সরকার সেই হত্যাকাণ্ডগুলোর কোনো বিচার-কাজ সম্পাদন করতে পারেনি। আরও পরের স্বৈরাচার এরশাদের আমলের অগণন হত্যাকাণ্ড ও নানা-অপরাধের বিচার করা যায়নি। তার পরিণাম শুভ হয়নি। সেটা যেন আমরা ভুলে না যাই। শহীদদের প্রতি দায়বোধ আমরা যেন না ভুলি।
লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক