পৃথিবীর বয়স আনুমানিক সাড়ে চার শ থেকে পাঁচ শ কোটি বছর। সৃষ্টি পর্ব থেকে ক্রমান্বয়ে পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য হয়ে পড়ে প্রাকৃতিকভাবে। মাটি, পানি, বাতাস, আলো, বৃক্ষ লতাগুল্ম, পাহাড়, পর্বত সমুদ্র ইত্যাদি নানান উপকরণে সজ্জিত হয়ে পৃথিবী হয়ে উঠে অপরূপ। কিন্তু মাত্র কয়েক হাজার বছরের নিষ্ঠুর দলনে পৃথিবী আজ অনেক সন্দেহের সম্মুখীন। একাধিক প্রশ্নমালায় বেষ্টিত পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীকে নিয়ে প্রশ্ন জাগে আর কত দিন বেঁচে থাকবে এ পৃথিবী, কত দিনই বা থাকবে সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ। কেননা দিন দিন পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ অরণ্যানি, মানুষের নখের থাবায় ছিন্নভিন্ন হচ্ছে প্রকৃতি। বৃক্ষের সঙ্গে রয়েছে প্রকৃতির সরাসরি সম্পর্ক। আমরা সবাই প্রাণিকুল শ্বসন প্রক্রিয়ায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে অক্সিজেন গ্রহণ করি। প্রাণিকুলের পরিত্যক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে সূর্যালোক ও পানির উপস্থিতিতে উদ্ভিদ সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরি করে এর উপজাত হিসেবে অক্সিজেন নির্গমন করে। নির্গত অক্সিজেন প্রাণিকুল গ্রহণ করে। এভাবে প্রাকৃতিক আবর্তের মাধ্যমে বাতাসের বিশুদ্ধতা বজায় রয়েছে। এজন্য বনাঞ্চলকে পৃথিবীর ফুসফুসের সঙ্গে তুলনা করা হয়। পরিবেশবিজ্ঞানীদের মতে, ১ হেক্টর বনভূমি ৩ দশমিক ৭ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং ২ টন অক্সিজেন ত্যাগ করে। এ থেকে সহজেই বোঝা যায় প্রাণিজগতের বেঁচে থাকার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান অক্সিজেন সরবরাহের অন্যতম উৎসস্থল সবুজ অরণ্য। তাছাড়া পর্যাপ্ত বনাঞ্চল বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেমন বাড়ায় তেমনি অত্যধিক তাপমাত্রা ও পরিবেশ দূষণ রোধে এর ভূমিকা অপরিহার্য। কিন্তু অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে প্রতিদিন জনসংখ্যার চাপে ও বসতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বনাঞ্চলকে উজাড় করা হচ্ছে। ফলে ক্রমাগত উত্তপ্ত হচ্ছে পৃথিবীকে রক্ষাকারী স্তর। ‘ওজোন স্তর’ হালকা ও পাতলা হয়ে যাচ্ছে। শুধু কি তাই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশেষ করে আমাদের মতো বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত এলাকার আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটতে শুরু করছে দিন দিন। অন্যদিকে পৃথিবীর ভূমির যে পরিমাণ আগে ছিল তা আজও রয়ে গেছে কিন্তু বেড়ে চলেছে মানুষ। অসংখ্য মানুষের ভিড়ে ও চাপে পৃথিবী যেন এখন হিমশিম খাচ্ছে। মানুষ বেঁচে থাকার কারণে নতুন নতুন প্রযুক্তির যেন প্যান্ডেরার প্যাটরা থেকে পালানো এক দৈত্য। যার উদ্যত খড়গ ফালাফালা করে দিয়েছে প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে। ছেড়ে দিতে হয় এ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে বীণার তারে বাঁধা আশ্চর্য প্রাণশক্তিকে। এক সময়কার মানুষের কল্পিত ও কাক্সিক্ষত শিল্প বিপ্লব নির্মল আকাশকে উপহার দেয় বিষাক্ত কালো ধোঁয়া, আর পানির উৎস নদীকে দেয় ময়লা ও আবর্জনা।
মানুষের বেহিসাবি ব্যয়ে উড়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ তেল, গ্যাস ও কয়লা। পৃথিবীর এ ক্ষতি করে চলেছে কিন্তু ধনী দেশগুলো। তারা উন্নয়ন ও প্রযুক্তির বদৌলতে মুছে ফেলছে অরণ্যকে। একসময় ২০০ ফুট লম্বা গাছেরা ঘিরে থাকত অ্যামাজান জঙ্গলকে। খুলনার সুন্দরবনেও তা অভাব ছিল না। কিন্তু সেখানে গিয়ে হাতুড়ি ও কঠোর হাতে মানুষ শুরু করেছে জঙ্গল সাফাই। জঙ্গলের পরিবর্তে সেখানে গড়ে উঠেছে বসতি, নির্মাণ করা হচ্ছে শহর, বন্দর, রাস্তাঘাট, কলকারখানা ইত্যাদি। কিন্তু এর ফল কিংবা প্রতিক্রিয়া হলো অত্যন্ত বিরূপ। প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ ও ঐশ্বর্যকে কি নিষ্ঠুরভাবে ধ্বংস করে ফেলছে অবিবেচক মানুষের দল। মাতৃস্বরূপ এ প্রকৃতির দান ও কল্যাণের কথা একটিবারও ভাবছে না মানুষ। চিন্তা করলে আমরা দেখি কী অদ্ভুদ এ প্রকৃতি, তার পরিকল্পনাতে কী চাতুর্য। মানুষ যত কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়বে, তার সবটাই চুষে নেবে আশপাশের গাছপালা। এ অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় আমরা বিস্মিত না হয়ে পারি না। আমরা বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ বেমালুম ভুলতে বসেছি। তাই অবাধে গাছ কেটে ফেলছি নেশা কিংবা পেশায়। পরিণামে সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে এ সুন্দর পৃথিবী থেকে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই ধ্বংস হবে পৃথিবী। মূলত পৃথিবীতে পরিবেশ দূষণ নতুন কিছু নয়, আবহমানকাল থেকে এটি হয়ে আসছে। ফলে প্রকৃতিতে ওলট-পালট ঘটছে বারবার। কত উদ্ভিদ ও প্রাণী যে নষ্ট হয়ে গেছে তার কোনো হিসাব নেই। এসব চড়াই-উতরাইতে মানুষ ঠেকে শিখেছে কোথায় তার সীমাবদ্ধতা। শুরু করল মানুষ পরিবেশ আন্দোলন। পরিবেশকে সুস্থ, সুষ্ঠু ও নিরাপদ রাখার আন্দোলন। শুরু হলো দেশে দেশে প্রচার। আলোচনা, সেমিনার, বিতর্ক সিম্পোজিয়াম সর্বোপরি পালন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ আর্থ সামিট অর্থাৎ ধরিত্রী সম্মেলনও করল জাতিসংঘ মহারোহে। এতে স্থানীয় স্তরে কিছু সদস্য এলেও সামগ্রিকভাবে পরিবেশের কোনো উপকার হয়নি। কাজেই পরিবেশকে দূষণমুক্ত করতে হলে চাই পরিবেশ আন্দোলন, পরিবেশ বিপ্লব-পরিবেশকে উপযুক্ত সংরক্ষণের বাস্তব কর্মপন্থা। যে বৃক্ষ আমাদের পরিবেশ রক্ষা করে, খাদ্য জোগায়, অক্সিজেন দেয়, চিকিৎসা করে, জীবন বাঁচায়, এমনকি পুণ্য ও সম্পদ সঞ্চয়ে সাহায্য করে, সে বৃক্ষরোপণ ও রক্ষার ব্যাপারে আমাদের প্রচুর আগ্রহ, আন্তরিকতা ও উদ্দীপনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য আমরা যেন সবুজ গাছের নির্মল বাতাস আর সূর্যের সোনালি আলো রেখে যেতে পারি সেটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার। আমরা যদি তাই করি তাহলে রেখে যেতে পারব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক বাসযোগ্য সবুজ পৃথিবী। সমৃদ্ধ পৃথিবী।
লেখক : সাংবাদিক