প্রকৃতির মতো রাজনীতিতেও অনেক ঘটনা ঘটে। যার মধ্যে কিছু হয় বিনাশী, আবার কিছু হয় সৃষ্টির। খুলে দেয় সম্ভাবনার দ্বার। রাজনীতিতে এই সম্ভাবনাকে ধারণ করাই হচ্ছে মূল বিষয়। ধারণ করতে পারলে এগিয়ে যাওয়া, ব্যর্থ হলে খেসারত। পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি পরিষ্কার, রাজনীতির গতিধারাকে ধারণ করার ক্ষেত্রে বিস্ময়করভাবে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে তারেক রহমান বিশেষ সাফল্য দেখিয়েছেন। এদিকে প্রতিবারই পিছিয়েছে আওয়ামী লীগ। দুবার তথা ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট এবং ২৪-এর ৫ আগস্ট দিয়েছে চরম খেসারত, সুযোগ হাতছাড়া করেছে ’৯১ সালে। ফলে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতিবাচক তকমা পেয়ে গেছে। আর এর পুরো সুযোগ চলে গেছে বিএনপির ঘরে। প্রতিটি জনবিদ্রোহ অথবা জনরোষের রাজনৈতিক ফসল বিএনপি ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। পিছনে তাকালে দেখা যাবে, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ ছিল। বাকশাল প্রতিষ্ঠার ফলে মুজিব-বিরোধী মনোভাব প্রবলতর হয়ে ওঠে। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ তখন অত্যন্ত নেতিবাচক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হতো। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাঁক বদলের প্রধানত তিনটি ঘটনা ঘটেছে। এই তিনটি ঘটনা ঘটেছে ১৯৭৫, ১৯৯০ এবং ২০২৪ সালে। এর সবই বেনিফিশিয়ারি বিএনপি। বর্তমানে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থানকে অতীতের ধারাবাহিকতা হিসেবেই বিবেচনা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন বিএনপি। জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের ফলে এই বিএনপি সরকারের পতন হয়। ’৯০-এর সফল গণ অভ্যুত্থানের পরে ’৯১-এর জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। অথচ সরকার গঠনের দিবাস্বপ্নে বিভোর ছিল আওয়ামী লীগ। ২০২৪ সালের গণ অভ্যুত্থানের পটভূমিতে বিএনপির জন্য আবার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, খুলে দিয়েছে স্বপ্ন দ্বার। এই পেক্ষাপটে ‘বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে ১৭ সেপ্টেম্বর বিএনপির সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তারেক রহমান যে বক্তব্য দিয়েছেন তাকে অনেক গভীরের বিষয় বলে বিবেচনা করছেন অনেকেই। আর বিরাজমান বাস্তবতায় তারেক রহমানকে বিবেচনা করা হচ্ছে সময়ের বরপুত্র হিসেবে।
জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং চরম রাষ্ট্রীয় অরাজকতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার ফলে সেই সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক চরম শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। সেই শূন্যতা পূরণ করতে জনভিত্তিসম্পন্ন নির্ভরযোগ্য কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। এর প্রায় তিন মাস পর ৭ নভেম্বরের নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে দৃশ্যপটের সামনে চলে আসেন জিয়াউর রহমান এবং আড়ালে যেতে থাকেন কর্নেল তাহের। খন্দকার মোশতাক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। ১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাসে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের হাতছাড়া হয়। তখন জিয়াউর রহমানের হাতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পাঁচ মাসের মাথায়, ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব জিয়াউর রহমানের কাছে হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার দেড় বছরের মধ্যে রাজনৈতিক দল গঠন করেন জিয়াউর রহমান। তাঁর এই উদ্যোগকে অনেকেই ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি সেই সময়ের ঘটনা প্রবাহ এবং রাজনীতি তার পক্ষে নিতে পেরেছিলেন। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও জিয়াউর রহমান পরিস্থিতি সামাল দিয়ে নিজেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। কিন্তু দেশের রাজনীতি সরলরেখায় আগায়নি।
ইতিহাস বলে, গণআকাক্সক্ষায় প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বহুবার হোঁচট খেয়েছে। বহুমাত্রিক গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা চলেছে বারবার। দেড় দশক ধরে অবিরাম সংগ্রামের পটভূমিতে ওপরে গত জুলাই মাসে শিক্ষার্থী-জনতার বিস্ময়কর গণ অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ইতিহাসের জঘন্যতম স্বৈরশাসকের পতন ঘটে। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর ১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আন্দোলন শুরু করে। তাদের সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দলও ছিল। কিন্তু দেখা গেল, এরশাদ পতনের পরে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের প্রথম গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এরশাদের শাসনামলে ’৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ দলটির প্রতি পুরনো জনঅনাস্থা আবার সামনে চলে আসে। উল্লেখ্য, তখন এরশাদবিরোধী বড় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশ্য ঘোষণা ছিল, স্বৈরাচার সরকারের আমলে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। কিন্তু জনগণের কাছে দেওয়া ওয়াদা ভঙ্গ করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। সেই সময়ের প্রসঙ্গে মওদুদ আহমদ তাঁর বইতে লিখেছেন, ‘সরকারের সঙ্গে এক গভীর সমঝোতার পর আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়সীমার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তারা তাদের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।’ এদিকে বিএনপি একটি ধারণা সৃষ্টি করতে পেরেছিল, আওয়ামী লীগ যদি ’৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ না নিলে এরশাদের পতন আরও আগেই ঘটানো সম্ভব হতো। এ বিষয়টি এরশাদের পতনের পর বিএনপিকে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছিল। এর সঙ্গে আরও অনেক ঘটনা যুক্ত হয়ে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়। প্রসঙ্গ, জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবে কেবল নয়, বেগম খালেদা জিয়া নেতা হয়েছিলেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ৫ আগস্ট অকল্পনীয় যে পরিবর্তন ঘটেছে তা ইতিহাসে বিরল। ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগ দৃশ্যত রাজনীতি থেকে নির্বাসিত। এদিকে দেশের রাজনীতিতে এক নতুন শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, যার পরিপূরক হতে এখন নানান রাজনৈতিক গোষ্ঠী তৎপর। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন কোনো পথে যাচ্ছে? বিগত ১৬ বছরে কোটি কোটি ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়নি। দেশের কয়েক প্রজন্ম গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চা ও প্রয়োগ ছাড়াই একটি ভীতিকর ও কর্তৃত্ববাদী পরিবেশে বেড়ে উঠেছে। অপশাসনে সংকুচিত স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতা তথা মানবিক, মানসিক বিকাশ ও প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিনযাপন করতে হয়েছে শেখ হাসিনার শাসনামলে। তরুণদের উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে নস্যাৎ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার এবং দল এরই চরম খেসারত দিয়েছে ৫ আগস্ট। যা আর একটি ১৫ আগস্টের দোরগোড়ায় চলে গিয়েছিল। এদিকে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে যে দুটো রাজনৈতিক দল এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে লাভবান হয়েছে তারা হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ আওয়ামী লীগ বিরোধীদের দখলে চলে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত নেতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কর্মদোষে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক সুবিধা খুব স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ বিরোধীদের হাতে চলে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মানুষ আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বরাবর বিএনপিকেই দেখেছে। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের বাইরে যদি আরেকটি কার্যকরী শক্তি থাকত তাহলে বিএনপি হয়তো এই সুবিধা পেত না। এখনো বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো নতুন কোনো শক্তির আবির্ভাব ঘটলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে সেটি এখনই নির্দিষ্ট করে বলার সময় হয়তো হয়নি। তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘সবল ও শক্তিশালী গণতন্ত্র গড়ে তুলতে বাংলাদেশকে এখনো অনেক দূর এগোতে হবে। কারণ, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এখনো গণতন্ত্রের দুর্বলতা বিদ্যমান।’
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক