দ্রব্যমূল্য নিয়ে স্বস্তিতে নেই মানুষ। প্রতিদিনই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। বাধ্য করছে বাজার পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে। বাজারে গিয়ে ব্যাগ বোঝাই খাদ্যপণ্য নিয়ে ঘরে ফেরার পরিবর্তে কম পণ্য নিয়ে ফিরছেন গৃহকর্তা। খাদ্যপণ্যেও পরিবর্তন আনতে হচ্ছে স্বল্প মূল্যের পণ্য খুঁজতে গিয়ে। এ দেশের মানুষের একটি সহজাত প্রবণতা নিজের খাদ্য তালিকায় যা-ই রাখা হোক, সন্তান বিশেষ করে শিশু সন্তানের খাদ্য তালিকায় পুষ্টি ও স্বাদের বিষয়টি বিবেচনায় রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন একজন বাবা। কিন্তু সেই সন্তানের খাবারের তালিকায়ও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। গৃহকর্তার সঙ্গে সঙ্গে রান্না পরিকল্পনায়ও পরিবর্তন আনছেন গৃহকর্ত্রী। কোনো সুখকর পরিবর্তন নয় এটি, পরিবর্তনটি নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর দ্রব্যমূল্যে খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায়নি। তবে চাঁদাবাজরা পালিয়ে যাওয়ায় পরিবহনে চাঁদাবাজি কিছুদিন বন্ধ থাকে এবং কিছু পণ্যের দামও কমে যায়। মানুষ আশান্বিত হয়ে ভেবেছিলেন ধীরে ধীরে সব পণ্যের দামই কমবে। কিন্তু চাঁদাবাজরাও রং বদলিয়ে নতুন উদ্যমে চাঁদাবাজি শুরু করায় নতুন করে পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। চাঁদাবাজদের পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন পণ্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সিন্ডিকেট, আছে মধ্যস্বত্বভোগীদের তৎপরতা। কিন্তু এদের দৌরাত্ম্য বন্ধে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও কোনো উদ্যোগই সফল হয় না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ যখন রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন তখন গত ১৫ সেপ্টেম্বর ডিম ও মুরগির মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী খুচরা পর্যায়ে ফার্মের মুরগির প্রতিটি ডিমের দাম রাখা হয় ১১ টাকা ৮৭ পয়সা।
সেই হিসাবে প্রতি ডজন ডিমের মূল্য দাঁড়ায় ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা। বাংলাদেশের বাজারে এখন পয়সার ব্যবহার নেই, এমনকি কোথাও ১ টাকার নিচে কোনো মুদ্রা দেখাও যায় না। তবু মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে টাকার সঙ্গে কেন পয়সা জুড়ে দেওয়া হয় সেটা অবশ্য বোধগম্য নয়। ডিমের মূল্য সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও বিক্রেতারা তা মানছেন না। বাজারে ফার্মের মুরগির ডিম প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। দেশি মুরগির ডিমের মূল্য সরকারিভাবে নির্ধারণ করা না হলেও তা বিক্রি হচ্ছে ২১০ টাকা ডজন। আর ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে হাঁসের ডিম। অবশ্য দেশি মুরগির ডিম আর হাঁসের ডিমের কথা সাধারণ মানুষ অনেক আগেই ভুলে গেছেন।
সরকার নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির মূল্য ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা। বাজারে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২১০ টাকায়। সোনালি মুরগি ২৬৯ টাকা ৬৪ পয়সা কেজি নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে ২৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির ক্ষেত্রেও বিক্রেতারা মানছেন না সরকারের বেঁধে দেওয়া মূল্য। বাজারে এখন দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা কেজি দরে। সরকার অবশ্য দেশি মুরগির মূল্য নির্ধারণ করে দেয়নি। প্রোটিনের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে মাংসের বাজারে ঢুকে দাম শুনে অনেক ক্রেতাই এখন আর মাংসে হাত দেন না। গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ টাকায়। আর ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খাসির মাংস। বাজারভেদে কোথাও কোথাও বেশি দামেও বিক্রি হচ্ছে মাংস।
ভাতে-মাছে বাঙালির বাংলাদেশে মাছের বাজারেও কিন্তু স্বস্তি নেই। আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশের ভরা মৌসুমেও অনেক মানুষ তার পাতে ইলিশ নিতে পারেননি। এরই মধ্যে মা ইলিশের প্রজনন নিরাপদ করতে ২২ দিনের জন্য ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে। এ সময়ে ইলিশ ধরা, বেচাকেনা ও পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ থাকবে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে মৎস্য অধিদপ্তরের ঘোষণায়। তবে এ নিষেধাজ্ঞা কতটা কার্যকর হয় সেটা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
কারণ এর আগে প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে জেলে ও ব্যবসায়ীদের ইলিশ ধরে বাজারজাত করার উদাহরণ রয়েছে অনেক। ভরা মৌসুমে ইলিশের বাজারে গিয়ে হতাশ মানুষ ২২ দিন পর ইলিশের দাম কমবে বলে আশা করতেই পারেন। কারণ ভরা মৌসুমে ইলিশের দাম দিন দিন শুধু বেড়েছেই। দিন দশেক আগেও মাঝারি আকারের একটি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ২ হাজার টাকা কেজি দরে। নিষেধাজ্ঞা শুরুর ঠিক আগে তা বিক্রি হয় ২ হাজার ৬০০ টাকায়। অথচ এ ইলিশ নিয়ে কত পদের রান্নার আয়োজন ছিল ঘরে ঘরে। রুই, কাতলা, চিংড়ি, বোয়াল, পাবদা, পাঙাশ, টাটকিনি, কাচকি কিংবা পুঁটি- সব মাছই সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
মানুষ নানা পদের সবজি কেনার আশা নিয়ে সবজিবাজারে ঢুকে হতাশ হন। আলু এবং কাঁচা পেঁপে ছাড়া সব সবজির দামই এখন ১০০ টাকা কেজির ওপরে। কোনো কোনোটি ৪০০ টাকা ছাড়িয়েছে। দাম দর করতে গেলে বিক্রেতারাও বলে দিচ্ছেন আলু-পেঁপে ছাড়া যাই নেবেন দাম কিন্তু ১০০ টাকার ওপরে। বাজারে নতুন শিম এখন ৪০০ থেকে ৪২০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ৩২০ টাকা কেজি। দেশি গাজর ১৬০ ও চাইনিজ গাজর ২২০ টাকা। ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে টম্যাটো। যে বরবটি এক সপ্তাহ আগেও বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকায় তার মূল্য এখন ১৬০। কাঁচা মরিচ প্রতিদিনই নতুন খবর দিচ্ছে। এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ টাকা কেজি দরে।
পিঁয়াজসহ মসলার বাজারেও এখন আগুন। সপ্তাহখানেক আগে পিঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা কেজিতে। এখন তার মূল্য ১৩০ টাকা। আদা এখন বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকা কেজিতে। রসুনের মূল্য ২২০। অন্যান্য মসলা কিনতে গিয়েও মানুষ হিমশিম খাচ্ছেন।
দ্রব্যমূল্য নিয়ে জনজীবনে অস্বস্তি নতুন নয়। কারণ আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য কখনোই স্থিতিশীল থাকে না। আর যে পণ্যের মূল্য একবার বেড়ে যায় তা সাধারণত আর কমে না। কোনো পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানো হলে তার মূল্য বেড়ে যায় শুল্কের হারের চেয়ে বেশি। কিন্তু যে পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো কিংবা শুল্কমুক্ত করা হয় সেসব পণ্যের দাম কমে না কখনোই। তবে একটি সরকার পরিবর্তন হলে মানুষ নতুন করে আশাবাদী হন, স্বস্তি পেতে চান। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিও মানুষের সেই প্রত্যাশা রয়েছে। কারণ গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সংস্কারের অঙ্গীকার নিয়ে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার সংস্কার কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ। আমাদের বাজারব্যবস্থায় সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজ ও মধ্যস্বত্বভোগীসহ নানা মহলের যে দৌরাত্ম্য যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে এবং এর পেছনে একশ্রেণির দায়িত্বশীল কর্মকর্তার যে দুর্নীতি তা দূর করতে হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে আসতে হবে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। নইলে জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসবে না। কারণ দ্রব্যমূল্য মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। আর জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে না পারলে কোনো সংস্কারই দেশবাসীর জন্য কল্যাণকর হবে না।
অবশ্য দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের জীবনে যখন নাভিশ্বাস অবস্থা তখন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আশার বাণী শুনিয়েছেন। সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এই বলে আশ্বস্ত করেছেন, ‘আপনারা স্বস্তি পাবেন। অধৈর্য হবেন না।’ মূল্যস্ফীতি ১ শতাংশ কমেছে উল্লেখ করে তিনি জানান, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব হবে না। বিভিন্ন পণ্যের শুল্ক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ডাল কেনার, এলএনজি আমদানি ও সার কেনার। তেল ও চিনির ওপর শুল্ক কমানো হয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে আরও কিছু পদক্ষেপের উল্লেখ করে তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য কমাতে ‘একটু সময়’ লাগবে।
দ্রব্যমূল্যের বর্তমান লাগামহীন অবস্থা নিয়ে সরব এখন সংবাদপত্র-টেলিভিশনসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। জনজীবনে অস্বস্তি থেকে তৈরি হচ্ছে অসন্তোষ ও ক্ষোভ। তবে আমরা আশাবাদী হতে চাই। অর্থ উপদেষ্টার কথা অনুযায়ী ‘একটু সময়’ অপেক্ষাও করতে চাই আমরা। এই একটু সময় পর একদিকে গৃহকর্তা যেমন বাজার পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে পারবেন তেমনি গৃহকর্ত্রীও পরিবর্তন আনবেন তার রান্না পরিকল্পনায়, সন্তানের মুখে তুলে দিতে পারবেন পুষ্টিকর ও সুস্বাদু খাবার। সমাজ সংসার জীবনে আসবে একটি সুখকর পরিবর্তন। জনজীবনেও ফিরে আসবে স্বস্তি।
♦ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক