বিলের ধারে কাশফুল। মাথার ওপরে শরতের আকাশ। আকাশে বড় বড় মেঘ। এই রোদ এই বৃষ্টি। ভোরে ফজর নামাজ পড়তে গেলে দেখা হয় ঘাসের গালিচায় ফুটে থাকা বিন্দু বিন্দু শিশির ফুলের সঙ্গে। বর্ষা বিদায় নিয়েছে কেবল। শীতের এখনো অনেক বাকি। বর্ষা আর শীতের মাঝামাঝি এই শরৎ ঋতু অন্যরকম শুভ্রতায় মোড়ানো। শরৎ মানেই সাদা। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই সাদা। যতদূর চোখ যায় ততদূর সাদা। বর্ষার তুমুল বর্ষণ চারদিক ধুয়েমুছে ঝকঝক করে দিয়েছে। শরৎ ধোয়া প্রকৃতির গায়ে শুভ্রতার চাদর পরিয়ে দিচ্ছে। সে চাদর প্রকৃতি থেকে টেনে মুমিন তার জীবনে জড়িয়ে নেবে। পাপে জীর্ণ কালো কলব তওবার বৃষ্টি দিয়ে ধুয়ে ইবাদতের শুভ্রতায় নিজেকে রাঙাবে। সে রং ছড়িয়ে পড়বে জনে জনে। গ্রামে গ্রামে। শহরে নগরে। দেশে- বিদেশে। জগতে-মহাজগতে। শুভ্রতার শক্তিই এমন। শুভ্রতা তো প্রভুর প্রতীক। শুভ্রতা তো নুরের ঝিলিক। আলোর চমক। যে আলো কখনো কমে না। যে আলো কখনো নেভে না। যে আলো জাগিয়ে দেয়। যে আলো জানিয়ে দেয়। যে আলো নাড়িয়ে দেয়। যে আলো আঁধার চূর্ণ-বিচূর্ণ করে নতুন ভোর আনে। যে আলো ভোর শেষে ঝলমলে দুপুর আনে। সে আলোর নাম ইমান। সে আলোর নাম ইসলাম। জাহেলি যুগের অন্ধকার মানুষ এ আলো গায়ে মেখে নুরানি হয়েছেন। হয়েছেন পৃথিবীর বুকে চিরস্মরণীয়-বরণীয়-রমণীয়-লোভনীয় জান্নাতি মানুষ। তেমনই জান্নাতি মানুষ ছিলেন হজরত তালহা (রা.)। ইমান একজন মানুষকে কতটা শুভ্র করে তোলে এক আশ্চর্য মেহমানদারি করে জগৎবাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে। তিনি বলেন, ‘এক ক্ষুধার্ত মেহমান এসে নবীজিকে (সা.) বললেন, ‘আমাকে কিছু খাবার দিন।’
নবীজি (সা.) ঘরে খোঁজ নিয়ে জানলেন খাবার নিই। উপস্থিত সাহাবিদের উদ্দেশ্যে নবীজি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে এই সম্মানিত মেহমানের দায়িত্ব নেবে?’
তালহা (রা.) বললেন, ‘হুজুর আমি তার দায়িত্ব নিলাম। আজ রাতে সে আমার মেহমান।’
মেহমানকে নিয়ে বাড়ি গিয়ে তালহা বললেন, ‘ঘরে কিছু আছে কি?’
স্ত্রী বললেন, ‘আমাদের জন্য কিছু নেই। তবে শিশুদের জন্য সামান্য খাবার রেখেছিলাম।’
তালহা বললেন, ‘এক কাজ করো, শিশুদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও। তারপর মেহমানকে ওই খাবারটুকু দিয়ে দিও। মেহমানের সঙ্গে আমরাও খেতে বসব। খাওয়ার সময় কোনো অজুহাতে বাতি নিভিয়ে দিও। আমরা মুখ নেড়ে খাওয়ার অভিনয় করব। আর মেহমান পেট ভরে খেয়ে নেবেন।’ যেমন বলা তেমন কাজ। তালহার স্ত্রী মজার মজার গল্প বলে শিশুদের ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। তারপর মেহমানকে সঙ্গে নিয়ে খাবার খেতে বসলেন। মেহমানের প্লেটে খাবার দিয়ে কোনো এক অজুহাতে বাতি নিভিয়ে দিলেন। অন্ধকার ঘরে স্বামী-স্ত্রী মুখ নেড়ে চপ চপ শব্দ করে খাওয়ার অভিনয় করে যাচ্ছেন। মেহমান নিশ্চিন্ত মনে খেয়ে যাচ্ছেন। দৃশ্যটা আল্লাহর খুব ভালো লেগেছে। সকালে তালহা (রা.) যখন মসজিদে নববিতে নামাজ পড়তে এলেন, রসুল মুচকি হেসে তালহাকে বললেন, ‘বাহ! তোমাদের অপূর্ব মেহমানদারি দেখে আল্লাহ সীমাহীন খুশি হয়েছেন।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস নম্বর-২০৫৪)। আসলে আলোকিত মানুষের মেহমানদারিও আলোকিত। লৌকিকতামুক্ত সহজ-সরল মেহমানদারিই ছিল নববি সমাজের বৈশিষ্ট্য। কারও ক্ষুধা লাগলে সে নির্দ্বিধায় খাবার চেয়ে খেত। আবার যার কাছে খাবার চেয়েছে সেও খুশি মনে নিজের জন্য যা রেঁধেছে তা থেকেই মেহমানকে বেড়ে দিত। আলাদা কোনো আয়োজন নেই। কে কী বলবে খুশি হলো না রাগ হলো এমন কোনো ভাবনা মনে জাগত না। তারা চাইতেন আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর আল্লাহ দেখেন নিয়ত। খালেস নিয়তে তারা মেহমানদারি করতেন। কে কী বলল না বলল এসব ভাবার মতো নিচু মানসিকতা নবীর শিক্ষায় নেই। সাহাবিদের চর্চায়ও ছিল না।
হায়! সোনার বাংলার মুসলমান সমাজে মেহমানদারি এখন লৌকিকতা আর বাহুল্য খরচের উটকো ঝামেলায় পরিণত হয়েছে। হাদিসে যেখানে মেহমানের সেবাকে ইমানের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়েছে, সেখানে এত দামি ইবাদতকে আমরা সামাজিক নানা কুসংস্কারে জটিল থেকে জটিলতর করে ফেলেছি। কারও বাসায় গেলে দামি উপহার নিয়ে যেতে হবে, খালি হাতে গেলে লোকে কী বলবে, এত বড় অনুষ্ঠানে দাওয়াত করেছে ৫ হাজার টাকা না দিলে সম্মান থাকবে না-আরও কত সামাজিক কুসংস্কারের বৃত্তে বন্দি হয়ে পড়েছে আমাদের মেহমানদারি বলে শেষ করা যাবে না। শুধু মেহমান নয় মেজবানেরও তো ভোগান্তির শেষ নেয়। এত দূর থেকে এত দিন পর এত কাছের আত্মীয় এসেছে তাকে ৩০ পদ দিয়ে না খাওয়ালে ইজ্জত থাকে? পোলাও কোরমা কোফতা না খাওয়ালে সে কি সম্পর্ক রাখবে? ভালো করে না খাওয়ালে তাকে দিয়ে তো আমার ওই কাজ হবে না এমন হাজারো দুনিয়াবে স্বার্থে আমরা মেহমানদারিকে বেঁধে ফেলেছি। ফলে রসুল (সা.) যে মেহমানদারির কথা বলেছেন মুসলমানের সমাজে এখন সে মেহমানদারি নেই। বরকতও নেই। কারও সামর্থ্য থাকলে আল্লাহর ওয়াস্তে মেহমানের জন্য সে ১০০ পদও তৈরি করুক।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীরসাহেব আউলিয়ানগর