প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী অনেকেই হয়েছেন এবং হবেন। কিন্তু তাঁদের কতজনকে রাষ্ট্রনায়ক বলা যাবে, তা একটি প্রশ্ন। আমাদের দেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে একজন ব্যতিক্রমধর্মী রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে যিনি রেখেছেন অবিস্মরণীয় ভূমিকা। দেশপরিচালনায় উত্তরসূরিদের জন্য রেখে গেছেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
বয়সে আমি শহীদ জিয়া থেকে চার-পাঁচ মাসের বড়। তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ১৯৭৯ কিংবা ১৯৮০-এর একটি ঘটনা। বন্ধুবর হাবিবুল্লাহ খান (রানু) তথ্যমন্ত্রী। এখানে হাবিবুল্লাহ খান সম্পর্কে দু-একটি কথা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমি তখন আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা বিওএসির বাংলাদেশের ম্যানেজার। আমাকে প্রায়শই গুলশানের ৭নং রোডের বিওএসি হাউসে পার্টি দিতে হতো। এক পার্টিতে হাবিবুল্লাহ খান উপস্থিত। সেই পার্টিতে মেজর জেনারেল নুরুল ইসলাম (শিশু ভাই) ছিলেন। রানুর দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করলেন, এ লম্বা হ্যান্ডসাম স্বল্পভাষী লোকটি কে? আমি পরিচয় দিলাম। সে সময়ে শিশু ভাইকে জেনারেল জিয়া দায়িত্ব দিয়েছিলেন ‘হেড হান্টের’। শিশু ভাইকে বলা হতো ‘রাসপুটিন’। সপ্তাহখানেক পরে এক ছুটির দিন দুপুরবেলা গোসল করছি, এমন সময় জরুরি টেলিফোন তৎকালীন এনএসআই ডিজি এ বি এম সাফদারের কাছ থেকে। তিনি ঢাকা ক্লাবের চারবারের প্রেসিডেন্ট এবং আমার ব্যাডমিন্টন পার্টনার। জিজ্ঞেস করলেন তুমি হাবিবুল্লাহ খান নামে কাউকে চেন? বললাম হ্যাঁ। বললেন, সন্ধ্যায় তাঁকে মন্ত্রিত্বের শপথ নিতে হবে এবং আমাকে বিকাল ৪টার মধ্যে ভাবীমন্ত্রী সম্পর্কে রিপোর্ট দিতে হবে। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ছেলে-অটোমবিল ইঞ্জিনিয়ার-আমেরিকান জেনারেল মোটরের আঞ্চলিক ম্যানেজার ছিলেন, সম্প্রতি গান্ধারা ইন্ডাস্ট্রিজের উত্তরসূরি প্রগতি ইন্ডাস্টিজের এমডি ইত্যাদি।
সেই হাবিবুল্লাহ খান তথ্যমন্ত্রী আমাকে এবং স্ত্রীকে দাওয়াত দিয়েছেন টেলিভিশনে প্রথমবারের মতো সাদা-কালো থেকে রঙিন অনুষ্ঠান প্রচার করা উপলক্ষে। উদ্বোধন করবেন প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া। আমরা যথারীতি বসে আছি অনেক কাতার পেছনে। অনুষ্ঠানের পর প্রেসিডেন্ট ডায়াস থেকে নেমে মাঝপথ ধরে হেঁটে আসছেন। হঠাৎ আমাদের কাতারের পাশে এসে আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন তুমি এনু, বেনু না তনু? স্ত্রীর উত্তর তনু। আবার প্রশ্ন- তোমার সঙ্গের লোকটি তোমার স্বামী? উত্তর হ্যাঁ। তীক্ষè দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন। প্রেসিডেন্ট আমার স্ত্রীর পরিবারকে চিনতেন। আমার স্ত্রীর বড় বোন বেনু ছিলেন মেজর জেনারেল আবদুল মান্নাফের স্ত্রী।
কিছুদিন পর বন্ধুবর মওদুদ আহমদ টেলিফোনে বললেন, প্রেসিডেন্ট তোমার সাক্ষাৎ নিতে চান। আমি অ্যাপয়েনমেন্ট করে দিয়েছি, মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার সাদেকুর রহমান যোগাযোগ করবেন। তুমি অবশ্যই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করবে।
যথাসময়ে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁর সামনে বসেছিলেন কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান এবং জয়পুরহাটের আবদুল আলীম, যিনি জেলের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। প্রেসিডেন্টের প্রথম কথা ‘যারাই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে মন্ত্রী হতে চায়, আপনি কি তাই চান? বললাম না স্যার, আমার বয়স ৪৫ বছর পূর্ণ হয়নি তিন থেকে পাঁচ বছর মন্ত্রিত্বের পর আমাকে কেউ চাকরি দেবে না। বিওএসিতে এখনো আমার ১৩ বছর চাকরির মেয়াদ আছে। তিনি বললেন, এ উত্তরটাই আমি আশা করেছিলাম। আমি আপনাকে পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেব। তিন বছরে এ করপোরেশনকে ক্ষতি থেকে বাঁচান। ১৯৭২ থেকে পরপর সিএসপি অফিসাররা করপোরেশনের দায়িত্ব নিয়েছে কিন্তু লোকসান থেকে বাঁচাতে পারেনি। আমার কাছে দুজন সিএসপি অফিসারের ফাইল এসেছে নিয়োগের জন্য, আমি কিন্তু আপনাকেই দায়িত্ব দিতে চাই। পরবর্তী সময়ে আপনাকে বিমানের দায়িত্ব দেব। এরপর তিনি আমার সামনে সোনালী ব্যাংকের একটি চেক রাখলেন। লেখা জিয়াউর রহমান- পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ টাকা। বললেন, একজন মেজর জেনারেলের গত মাসের মাইনা। সেদিন ছিল মাসের ১ তারিখ। জানি না, প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার মাইনা কত হওয়া উচিত। মরহুম শেখ মুজিব একজন সরকারি কর্মকর্তার বেতন সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা করে গেছেন। এ মুহূর্তে তাঁর ধার্য করা বেতন পরিবর্তন করব না, তবে ভবিষ্যতে বেতনের পরিবর্তন আসবে। আপাতত আপনাকে একজন সচিবের সর্বোচ্চ বেতন ৩ হাজার টাকা দেওয়া হবে। এত দিন বহু টাকা রোজগার করেছেন, দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করুন। বিনা মেঘে বজ্রপাত। বিওএসিতে আমার বেতন লাখ টাকা। আপ্যায়ন খরচ বেহিসাব। দুই বছর পরপর ইংল্যান্ডে ফারলো ভি ইত্যাদি। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে বদলি হওয়ার কথাবার্তাও চলছে। স্ত্রীকে আমি কী বোঝাব? পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় সাহস করে বললাম, স্যার, বিওএসি তো আমাকে ছাড়বে না। এবার তিনি সোজা হয়ে বললেন, আপনি দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলছেন। আমি এখনই লন্ডনে বিওএসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বললে কি আপনাকে রিলিজ করবে না? বললাম, স্যার আমি ইস্টার্ন ডিভিশনের সঙ্গে কথা বলব। এবার তিনি মিলিটারি সেক্রেটারিকে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের কাছে টেলিফোন লাগাতে বললেন। ব্যারিস্টার সাহেব আপনি বিওএসির ম্যানেজার রেজা হোসেনকে চেনেন? অন্যদিক থেকে নিশ্চয়ই হ্যাঁ-সূচক জবাব। আমি তাকে পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছি। সে গুলশানের বিওএসি হাউসে থাকে, গুলশানের যেসব এবানডেন্ট বাড়ি আপনি সচিবদের বরাদ্দ দেন ওখান থেকে একটি তাকে দেবেন। ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন তখন গৃহায়ন ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ের স্টেট মিনিস্টার। আমাকে গুলশানের ১১৪নং রোডে ৪ বেড রুমের একটি বাড়ি বরাদ্দ দিলেন। এটাতে থাকতেন মন্ত্রণালয়ের মতিউল ইসলাম। তিনি ইউনিডোর রিজিওনাল চিফ হিসেবে দিল্লিতে চলে যান।
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের পর বাড়িতে এসে যে তুলকালামের সৃষ্টি হয়েছিল তার বর্ণনা দিতে চাই না। ডিভোর্স হয় হয় অবস্থা। বিওএসিতে ইস্তফা না দিয়ে আগাম অবসর গ্রহণ করলাম। সব ধরনের সুযোগসুবিধা নিয়ে যার মধ্যে ছিল পরিবারসহ ফ্রি ট্রাভেল এবং অবসর গ্রহণে যে প্যাকেজ পেলাম, এতে আগামী পাঁচ বছর সংসার চালাতে কোনো অসুবিধা হবে না।
পর্যটনের দায়িত্ব নিলাম ১ মে ১৯৮১। দায়িত্ব গ্রহণের এক দিন আগে সচিব জাঁদরেল সিএসপি মোহাম্মদ আলী আমাকে সতর্ক করেছিলেন আমার কাছে পর্যটন করপোরেশনে ম্যানজার পদে অধিষ্ঠিত মহিলা কর্মকর্তা জুলফিয়া আসাফের ফাইল আসবে তাঁর রিলিজ অনুমোদনের জন্য। সাবধান তাঁর স্বামী একজন সিএসপি সচিব, তিনি চান না তাঁর স্ত্রী রিলিজ নিয়ে বিদেশে যান। জয়েন করার পরদিনই চারটি ফাইল এলো অনুমোদনের জন্য, যার মধ্যে জুলফিয়ার ফাইল ছিল। আমি চারটি ফাইল বাড়িতে নিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত পড়লাম। পরদিন চারটি ফাইলেই অনুমতি দিলাম, কারণ অনুমতি বাতিল করার কোনো অজুহাতই দেখতে পাইনি। এর পরদিনই টেলিফোন। প্রেসিডেন্টের মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার সাদেকুর রহমান কথা বলবেন। এমএসপি বললেন, ধরেন প্রেসিডেন্ট আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। আমি ঘাবড়ে গেলাম, দুই দিনে কী এমন করলাম যে প্রেসিডেন্টের কথা বলার দরকার পড়ল। বললাম, স্যার, সালাম আলাইকুম। উনি বললেন, আপনি কাল একজনকে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার থেকে ম্যানেজার পদে প্রমোশন দিয়েছেন। আপনি কি এ প্রমোশন দিয়েছেন তাকে আমার ছোট ভাই জেনে? আমি বললাম, স্যার, আমি ঘুণাক্ষরে জানি না সে আপনার ছোট ভাই, তার পারফরম্যান্স দেখেই প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। এরপর তিনি লাইন কেটে দিলেন। শহীদ জিয়া ছিলেন সততা ও দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক। মৃত্যুর পর তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ছিল ৭ হাজার কয়েক শ টাকা। তিনি বিদেশে তৈরি কোনো পোশাক পরতেন না। ডিআইটি মার্কেট শাহবাগে অবস্থিত নিউ এলিগেন্ট টেইলার্সের মালিক সাবু ভাই তাঁর স্যুট, সাফারি স্যুট, ট্রাউজার, শার্ট সবকিছু তৈরি করে দিতেন। একদিন সাবু ভাইয়ের টেলিফোন, রেজা ভাই বিপদে আছি। প্রেসিডেন্ট চাইছেন আমি তাঁর নেক টাই তৈরি করে দিই। বললাম, স্যার, এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। পরিশেষে শহীদ জিয়ার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা তিনি বাংলাদেশের জন্য যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কল্পনা করেছিলেন সেটা যেন সার্থক হয়।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য