আজ ১৩ নভেম্বর। দিনটি ঘিরে সারা দেশে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর সদস্যদের তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে। সবার মনে একটাই প্রশ্ন-আজ কী হবে? তবে আজকের দিনটি আমাদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যারা ভেবেছিল চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে, যারা দেশটাকে পৈতৃক সম্পত্তি মনে করেছিল, এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করেনি; আজ তাদের বিচারের রায় ঘোষণার দিন ধার্য হবে। এটা অবশ্যই বর্তমান সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সরকার ও আদালতের এমন এক সাহসী পদক্ষেপ বাধাগ্রস্ত করতে অপরাধীরা অপচেষ্টা চালাবে, এটাই স্বাভাবিক। ইতোমধ্যে যানবাহনে আগুন, ককটেল বিস্ফোরণসহ নানান ধ্বংসাত্মক কাজ তারা শুরু করেছে। অবশ্য রাজপথের আন্দোলন, নাশকতা, যানবাহনে আগুন লাগিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার রাজনীতিতে তাদের জুড়ি নেই। গত ১৬ বছরে যানবাহনে আগুন, যাত্রীভর্তি বাসে গানপাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করার মতো ঘটনা ফ্যাসিস্ট দলের নেতা-কর্মী ও তাদের বিপথে চালিত গোয়েন্দা সংস্থা করেছে। এসব কাজে তাদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছে তারা, আর মামলা হয়েছে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নামে। সেই গুপ্তঘাতী তৎপরতা তারা এখন আবার শুরু করেছে। আর তাদের এসব ধ্বংসাত্মক কাজ করার সুযোগ করে দিচ্ছে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো। সরকার যদি এত কিছু নিয়ে খেলাধুলা না করে সাদা মনে একটি নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চিন্তা করত, তাহলে ফ্যাসিস্টরা এমন দুঃসাহস দেখাতে পারত না। রাজনৈতিক দলগুলোও যদি শুধু ক্ষমতার লোভ না করে দেশের মঙ্গল চিন্তা করে ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকত, তা হলেও পলাতক ফ্যাসিস্ট মাত্র ১৫ মাসের মধ্যে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারত না।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ৫ আগস্টের ভাষণে বলেন, সরকারের তিনটি দায়িত্ব ছিল। দায়িত্বগুলো হলো সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। দেশের অর্থনৈতিক খাত, বিচারব্যবস্থা ও জনপ্রশাসনে গতিশীলতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি, দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানি হ্রাস করতে বেশ কিছু সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এসব কমিশনের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে গঠন করা হয় ঐকমত্য কমিশন। এ কমিশনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে সরকারের পছন্দের প্রবাসীদের এনে দায়িত্ব দেওয়া হলো। অনেক দিন ঐক্যের নাটক করে শেষ পর্যন্ত চরম অনৈক্য সৃষ্টি করা হলো। দেশের শীর্ষ দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সনদটি যেভাবে প্রকাশ করা হলো, তাতে দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের বদলে চরম অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় সবাই সরকারের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনল। অথচ এ দলগুলো জুলাই অভ্যুত্থানের পর নিঃশর্তভাবে এ সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সবাই মাথার তাজ বানিয়ে রেখেছিল। মাত্র ১৫ মাসের ব্যবধানে দলগুলো তাঁর বিরুদ্ধেই প্রতারণার অভিযোগ আনল! এ অবস্থায় অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। ঐকমত্য কমিশন কার স্বার্থে কাজ করেছে, কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে? স্বৈরাচার পতনের পর সব দল তো একমঞ্চে ছিল। হাতে হাত রেখে স্লোগান দিয়েছে। ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছে। সে ঐক্য নষ্ট করার জন্য সরকার কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছিল? ঐক্যের নাটক করে সরকার কি সময় নষ্ট করেছে? সরকার যত জোর দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের কথা বলছে, জামায়াতে ইসলামী তত জোরে নির্বাচনের আগে গণভোটের কথা বলছে। গণভোট ছাড়া ২০২৬-এ জাতীয় নির্বাচন হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। তাহলে কার কী উদ্দেশ্য? ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে যাদের সঙ্গে তাদের আঁতাত ছিল, সেই আঁতাত কি এখনো আছে?
সংস্কার ও জুলাই সনদ নিয়ে প্রত্যাশার চেয়ে অপ্রত্যাশিত ঘটনাই বেশি ঘটেছে। রোগী আগে টয়লেটে প্রস্রাব-পায়খানা করত, এখন বিছানায় করছে অবস্থাটা যেন অনেকটা এমনই। জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দলগুলোতে যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, ঐকমত্য কমিশন সে সম্পর্ক নষ্ট করে শত্রুতে পরিণত করেছে। আগে একজন অন্যকে সালাম দিয়ে কথা বলত, এখন ধমক দিয়ে কথা বলছে। তবে সংস্কারে আহামরি কিছু না হলেও বিচারকাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক। সেজন্য বিচারব্যবস্থাকে ধন্যবাদ। এর আগে ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘জুলাই-আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় বিচারকাজ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছে। বিচারের আনুষ্ঠানিক শুনানি পর্বও শুরু হয়েছে। ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞে যারা জড়িত, তাদের বিচার এ দেশের মাটিতে হবেই। বিচারপ্রক্রিয়া ও এর ফলাফল ক্রমান্বয়ে মানুষের কাছে প্রকাশিত হতে থাকবে। বিচারের পুরো প্রক্রিয়া দেশবাসীর কাছে স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান রাখা হচ্ছে।’ প্রধান উপদেষ্টার সেই প্রত্যাশা পূর্ণতা লাভ করছে। অবশ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিচারে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং জুলাই বিপ্লবের অত্যাচারিত-নির্যাতিতসহ সর্বসাধারণের মতো প্রধান উপদেষ্টারও খুশি হওয়ার কথা। কারণ শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত আক্রোশে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দিনের পর দিন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। শেখ হাসিনা আর কিছুদিন ক্ষমতায় থাকলে হয়তো ড. ইউনূসকে জেলখানাতেই থাকতে হতো। সেই মিথ্যা ভিত্তিহীন মামলা থেকে তিনি আইনি ব্যবস্থাতেই মুক্ত হয়েছেন। কথায় বলে, মানীর মান আল্লাহ রাখেন। ক্ষমতার দম্ভে যে শেখ হাসিনা একদিন ড. ইউনূসকে আদালতে ঘুরিয়েছেন, সেই ড. ইউনূসের সরকার এখন শেখ হাসিনার বিচার করছে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! অবশ্য নোবেল লরিয়েটের কারণে অনেকের ভাগ্যও খুলে গেছে। তিনি আদালতে গেছেন আসামি হয়ে। আর কিছু লোক তাঁর সঙ্গে গেছেন গণমাধ্যমের খবর হতে। আজ সেই সঙ্গীদের অনেকেই উপদেষ্টা। শুধু বাদ পড়লেন সেই মামলাগুলোর পরিচালনাকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন। যখন কোনো আইনজীবী ড. ইউনূসের মামলা পরিচালনা করার সাহস পাননি, তখন ব্যারিস্টার মামুন এগিয়ে এসেছিলেন। মামলার প্রতিটি তারিখে শুনানি শেষে তিনি যখন নির্ভয়ে সাংবাদিকদের বিস্তারিত বলতেন, সেই দৃশ্য অনেকের চোখে এখনো ভাসে।
প্রধান উপদেষ্টা একই দিনের ভাষণে নির্বাচন নিয়ে বলেছিলেন, ‘এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা। নির্বাচন অনুষ্ঠান। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠাব, যেন নির্বাচন কমিশন আগামী রমজানের আগে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আপনারা সবাই দোয়া করবেন যেন সুন্দরভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারি। দেশের সব নাগরিক একটি “নতুন বাংলাদেশ” গড়ার কাজে সফলভাবে এগিয়ে যেতে পারে। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে এ নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং উৎসবমুখরভাবে সম্পন্ন করা যায়, সেজন্য সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করব।’ প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে সেদিন জাতি আশান্বিত হয়েছিল। নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সংশয় কিছুটা হলেও দূর হয়েছিল। সে ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নির্বাচন কমিশনে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশনও প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। তাঁর এ ভাষণের প্রায় সাড়ে তিন মাস অতিক্রান্ত হচ্ছে। এ সময়ে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ও স্বীকৃত সব দল ফেব্রুয়ারির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। জামায়াতে ইসলামী অনেক আগেই প্রতিটি আসনে একক প্রার্থী দিয়েছে। তারা ভোট প্রার্থনা করছেন। বিএনপিও ৩ নভেম্বর ২৩৭ আসনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে। সারা দেশ এখন নির্বাচনমুখী। এমন সময়ে আবার নতুন করে নির্বাচন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, কোনো মহলকে খুশি করার জন্য ফেব্রুয়ারির নির্বাচন যদি অনিশ্চিত হয়ে যায়, তাহলে দেশ গভীর সংকটে পড়বে। লাভবান হবে পতিত ও পলাতক ফ্যাসিস্ট।
রাজনীতিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ। দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষই কমবেশি রাজনীতি বোঝে। রাজনৈতিক আলোচনা সবার প্রিয়। পাঁচ তারকা হোটেল বা দামি রেস্টুরেন্টে যারা আড্ডা দেয়, তাদের চেয়ে শহরের বা গ্রামের ফুটপাতের চায়ের দোকানে রাজনৈতিক চর্চা বেশি হয়। আরও একটি বিষয় আমরা অনেক বেশি জানি, সেটা হলো ডাক্তারি। কারও কোনো শারীরিক সমস্যা হলে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না, যে ডাক্তারি পরামর্শ দিতে পারে না। এ দুই বিষয়ে সবার জ্ঞান-অপজ্ঞান বেশি, সংকটও বেশি। এখন দেশে নির্বাচন নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা দূর করার জন্য রাজনৈতিক ঐক্যে আর কাজ হবে না। এর জন্য দরকার জাতীয় ঐক্য। চরম সংকটে স্বপ্নবাজ মানুষ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কেন্দ্র করে দেশবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তিনি ক্ষমতা ও মর্যাদার আসনটি পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৫ মাসে তাঁর সেই অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এখন একমাত্র বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষেই জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে একমাত্র তিনিই পারেন দলমতনির্বিশেষে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে। তিনি শুধু বিএনপির মতো একটি দলের নেত্রী নন, তিনি জাতীয় মুরুব্বি। সবার শ্রদ্ধেয় বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে পারলে বর্তমান সংকট দূর করা সম্ভব। এটা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন