বর্তমান বিশ্বে কর্মসংস্থানের ধরন, চাহিদা ও প্রতিযোগিতা দিনদিন পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রযুক্তি, যোগাযোগ এবং বিশ্বায়নের যুগে শ্রম বাজার এখন আর একটি দেশের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ নয়; বরং এটি একটি গ্লোবাল বা বৈশ্বিক বাজারে পরিণত হয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে কর্মক্ষেত্রে শুধু পেশাগত দক্ষতা নয়, ভাষাগত দক্ষতাও এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। শ্রম বাজারের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাষা জানার প্রয়োজনীয়তাও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর এ প্রতিযোগিতামূলক যুগে যে ব্যক্তি একাধিক ভাষা জানে, তার কর্মজীবনের সুযোগ এবং সম্ভাবনা নিঃসন্দেহে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। এক সময় শ্রমবাজার বলতে বোঝানো হতো কারখানার কাজ, কৃষি, নির্মাণ বা সেবা খাতের শ্রমিকদের কর্মসংস্থান। কিন্তু বর্তমানে শ্রমবাজারের পরিধি বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন এটি তথ্যপ্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, শিক্ষা, চিকিৎসা, পর্যটন, ফ্রিল্যান্সিং, কল সেন্টার, ব্যবসাবাণিজ্য এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশের শ্রমশক্তি শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ব্যাপকভাবে কর্মরত। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন। কিন্তু সফলতার বিবেচনায় সেখানে শারীরিক সক্ষমতার পাশাপাশি স্থানীয় ভাষা জানা খুবই জরুরি, সংশ্লিষ্ট কাজের অভিজ্ঞতা তো লাগবেই। ভাষা জানলেই কর্মক্ষেত্রে যোগাযোগ সহজ হয়, কাজের মান উন্নত হয় এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়। ভাষা জানলে শুধু কাজ করাই সহজ হয় না, বরং নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা এবং আলোচনার দক্ষতা বাড়ে। এটি কর্মজীবনের এক অমূল্য সম্পদ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ওখঙ) রিপোর্ট অনুযায়ী, ভাষা জানার কারণে একজন প্রবাসী শ্রমিক গড়ে ২০-৩০% বেশি আয় করতে পারেন তুলনামূলকভাবে অজ্ঞদের চেয়ে। ভাষা হলো যোগাযোগের মূল মাধ্যম। ভাষা ছাড়া চিন্তা, প্রকাশ ও সম্পর্কের বিকাশ অসম্ভব। শ্রমবাজারে ভাষা সেই সেতু হিসেবে কাজ করে, যা নিয়োগকর্তা ও কর্মীর মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, একজন শ্রমিক যদি আরব দেশে কাজ করেন, কিন্তু আরবি না জানেন, তবে তিনি নিয়োগকর্তার নির্দেশ বুঝতে না পারলে কাজের মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে, যে শ্রমিক আরবি কিছুটা জানেন, তিনি সহজেই নির্দেশনা অনুসরণ করতে পারেন, ভুল কম করেন এবং দ্রুত পদোন্নতি লাভ করতে পারেন। একজন প্রবাসী শ্রমিক যখন বিদেশে যান, তখন ভাষা জানলে তিনি শুধু নিজের কাজেই নয়, স্থানীয় সমাজেও সম্মান পান। উদাহরণস্বরূপ, একজন আরবি জানা শ্রমিক সহজে বাজার করতে পারেন, চিকিৎসা নিতে পারেন, এমনকি ব্যাংকিং ও প্রশাসনিক কাজও সম্পন্ন করতে পারেন। ফলে তার জীবনযাত্রা সহজ হয় এবং মানসিক চাপও কমে। অন্যদিকে, ভাষাজ্ঞান না থাকলে সামান্য যোগাযোগেও সমস্যা হয়। অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝি থেকে বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। তাই ভাষা শেখা শুধু কর্মজীবনের জন্য নয়, নিরাপত্তা ও মর্যাদার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা শুধু অর্থনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। যখন একজন ব্যক্তি অন্য ভাষা শেখেন, তখন তিনি অন্য সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও মানুষের চিন্তাধারাকে বুঝতে পারেন। এটি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহনশীলতা ও আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। একজন ভাষাজ্ঞানসম্পন্ন শ্রমিক তাই শুধু অর্থনৈতিক প্রতিনিধি নন, তিনি সংস্কৃতির দূতও বটে।
বিশ্বায়নের ফলে ব্যবসাবাণিজ্য, শিক্ষা ও প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে একটি প্রতিষ্ঠানের ক্লায়েন্ট ইউরোপে, কর্মী এশিয়ায় এবং গ্রাহক মধ্যপ্রাচ্যে। এই বৈচিত্র্যময় বিশ্বে যোগাযোগের প্রধান হাতিয়ার হলো ভাষা। ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা হলেও চীনা (ম্যান্ডারিন), স্প্যানিশ, আরবি, ফরাসি, জাপানি ও কোরিয়ান ভাষারও গুরুত্ব দ্রুত বাড়ছে দিনকে দিন। বাংলাদেশে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মানুষ বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য পাড়ি জমান। কিন্তু অনেকেই ভাষা না জানার কারণে চাকরি হারান, ভুল বোঝাবুঝিতে পড়েন, এমনকি আইনগত সমস্যাতেও জড়িয়ে পড়েন। সেজন্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভাষা শিক্ষা, বিশেষ করে ইংরেজি, জাপানিজ, চীনা, কোরিয়ান ও আরবি ভাষা (অন্তত ২-৩ ভাষা) অবশ্যই বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। পাশাপাশি কোরিয়ান, জাপানি, ফরাসি ও চীনা ভাষার জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বাড়ানো দরকার। এ উদ্যোগগুলো শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। বাংলাদেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর হার বেশি, এটি এক বিশাল মানবসম্পদ। কিন্তু এই মানবসম্পদকে বিশ্বমানের শ্রমশক্তিতে পরিণত করতে হলে ভাষা শিক্ষা অপরিহার্য। অনেক সময় দেখা যায়, বিদেশে একই পদের জন্য বাংলাদেশি ও ফিলিপিনো বা ভারতীয় শ্রমিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ফিলিপিনো শ্রমিক ভাষাজ্ঞান ও যোগাযোগ দক্ষতায় এগিয়ে থাকায় তারা ভালো বেতন ও পদ পান। এ জায়গায় আমাদেরও উন্নতি করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়