একসময় ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছিলেন নেদারল্যান্ডসের নাগরিক পিটার ভ্যান উইংগারডেন ও মিনকে ভ্যান উইংগারডেন। ২০১২ সালে ব্যবসায়িক সফরে তাঁরা গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটিতে। সেখানে তাঁদের পড়তে হয় হারিকেন স্যান্ডির তাণ্ডবে। ঝড়টি মুহূর্তেই ম্যানহাটনকে প্লাবিত করে দেয়। বিদ্যুৎব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। মানুষ অন্ধকারে দিন কাটাতে থাকে। শহরের রাস্তাঘাট, সেতু, যোগাযোগব্যবস্থা সবকিছু অচল হয়ে যায়। খাদ্যপণ্যবাহী ট্রাকগুলো তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারায় শহরজুড়ে দেখা দেয় তীব্র খাদ্যসংকট।
দীর্ঘ সময় অনাহারে থাকা সেই নগরবাসীর দুর্ভোগ পিটারের মনে গভীর রেখাপাত করে। তিনি ভাবলেন, যদি শহরের ভিতরেই স্থানীয়ভাবে খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে এমন পরিস্থিতিতে মানুষকে কষ্ট পেতে হতো না। নেদারল্যান্ডসে ফিরে তিনি ও তাঁর স্ত্রী সিদ্ধান্ত নিলেন ভবিষ্যতের জন্য টেকসই কোনো সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এমন দুর্যোগ ক্রমেই বাড়বে, তা তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন। এই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় এক অভিনব উদ্যোগের, ভাসমান খামার বা ফ্লোটিং ফার্মের ধারণা।
রটার্ডাম সমুদ্রবন্দরের এক ক্যানেলের পাশে পানির ওপর নির্মিত হয়েছে সেই ভাসমান খামারটি। বছর তিন আগে এক এপ্রিলে নেদারল্যান্ডসে ডেল্টা প্ল্যান-সম্পর্কিত কার্যক্রম দেখতে গিয়ে সরেজমিন ঘুরে দেখি পিটার ও মিনকে দম্পতির সেই বিস্ময়কর প্রকল্প। পানির ওপর ভাসছে তিন তলা এক আধুনিক গরুর খামার, যা সত্যিকার অর্থেই টেকসই কৃষির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
খামারটির মূল পরিকল্পনাকারী পিটার ভ্যান উইংগারডেন। তবে দৈনন্দিন পরিচালনার দায়িত্বে আছেন তাঁর সঙ্গী ও উদ্যোক্তা মিনকে ভ্যান উইংগারডেন। পিটার তখন শহরের বাইরে থাকায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি, কিন্তু মিনকের সঙ্গে লম্বা সময় কথা হয়। আন্তরিক মিনকে প্রজেক্টরের মাধ্যমে উপস্থাপন করলেন তাঁদের পুরো উদ্যোগের সারসংক্ষেপ।
তিনি বললেন, ‘আমরা এক অদ্ভুত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সবকিছু দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আবহাওয়া, জলবায়ু, শহরের কাঠামো; কিছুই আগের মতো নেই। এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারলে আমরা টিকে থাকতে পারব না। গবেষণায় বলা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৯.৮ বিলিয়নে, যার ৭০ শতাংশই বসবাস করবে শহরে। তাই শহরগুলোকে এখন থেকেই নিজেদের খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর হওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে।’ তাঁর কথায় স্পষ্ট হয়ে উঠল এক দৃঢ় বিশ্বাস। ভবিষ্যতের শহর টিকে থাকবে স্থানীয় খাদ্য উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে। রটার্ডামের সেই ভাসমান খামারই যেন সেই ভবিষ্যতের এক বাস্তব উদাহরণ।
ভাসমান খামারের দিকে যেতে যেতে কথা হচ্ছিল মিনকে ভ্যান উইংগারডেনের সঙ্গে। খামারটি নদীর পানিতে ভাসছে, আর তীরে রয়েছে তাঁদের অফিস ও বিক্রয় কেন্দ্র। বিশাল এলাকাজুড়ে গবাদিপশুর বিচরণ ক্ষেত্র। ভবিষ্যতের কৃষি ও পরিবর্তিত জলবায়ু নিয়ে কথা বলতে বলতে মিনকে বললেন, ‘যে কোনো পরিস্থিতির জন্যই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আসলে আমরা কেউই জানি না ভবিষ্যতে কী ঘটবে। জলবায়ু দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এই বিবর্তনের সময়টাতে অভিযোজন করতে না পারলে হয়তো আমাদের হারিয়ে যেতে হবে। তাই এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। শহরকে খাদ্য উৎপাদনের কেন্দ্র থেকে আলাদা রাখলে চলবে না। কৃষির এই পরিবর্তন বা রূপান্তরকেই আমরা বলছি “ট্রান্সফরমেশন”।’
২০১৯ সালের ১৩ মে মাসে ৩২টি গরু নিয়ে বিশ্বের প্রথম ভাসমান ফার্মটির যাত্রা শুরু হয়। এটি মূলত একটি ডেইরি ফার্ম। বর্তমানে এখানে প্রায় ৪০টি গাভি রয়েছে। মিনকের কাছে জানতে চাইলাম, কেন তারা এমন এক ভাসমান খামারের চিন্তা করেছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, ‘দেখুন, কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে। শহর ক্রমেই বাড়ছে। আজ যেখানে সুউচ্চ ভবন দাঁড়িয়ে আছে, এক সময় সেখানেই ছিল কৃষিজমি। মানুষের বাসস্থানের প্রয়োজনীয়তা যেমন সত্য, তেমনি নিরাপদ ও সতেজ খাদ্যের কথাও ভাবতে হবে। এই দুটি বিষয় একসঙ্গে বিবেচনা করেই আমাদের এই উদ্যোগ। পাশাপাশি আমরা নগরের মানুষদেরও সচেতন করতে চেয়েছি, যেন তারা বুঝতে পারে তাদের খাদ্য কোথা থেকে আসে। সিঙ্গাপুরের মতো দেশ, যেখানে শতকরা ৯০ ভাগ খাদ্য আমদানি করা হয়, তারাও চাইলে এমন ভাসমান খামার গড়ে নিজেদের সতেজ খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে পারে।’
তাঁর কথা শুনে বুঝলাম, তাদের লক্ষ্য কেবল দুধ উৎপাদন নয়, বরং ভবিষ্যতের কৃষি বাণিজ্যের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা। খামারের কাঠামোটি মূলত স্টিলের তৈরি। ওপরের অংশে সাদা প্লাস্টিকের আবরণ। এটি পানিতে ভাসমান হওয়ায় জোয়ার-ভাটার সঙ্গে খামারটি ওপরে নিচে ওঠানামা করে। পুরো স্থাপনাটি তিনটি ভাগে বিভক্ত। নিচে রয়েছে গবেষণা কেন্দ্র, মাঝখানে দুধ প্রক্রিয়াকরণ ফ্লোর এবং একদম ওপরে গরুর থাকার জায়গা।
জানতে চাইলাম, এই কাঠামো নির্মাণ কি খুব ব্যয়সাপেক্ষ নয়? মিনকে হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, প্রাথমিকভাবে হয়তো ব্যয়সাপেক্ষ মনে হয়, কিন্তু আপনি যদি দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদন ও ফলনের হিসাব করেন, তাহলে দেখবেন এটি অত্যন্ত লাভজনক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যেখানে কৃষিজমি পাওয়া যায় না, সেখানে এই পদ্ধতি নিরাপদ ও সতেজ খাদ্য উৎপাদনে নতুন আশা জাগায়।’
খামারটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ এখানে সম্পন্ন হয় রোবটের সাহায্যে। এমনকি দুধ দোহানোর কাজও করে মিল্কিং রোবট। প্রতিটি গাভির গলায় রয়েছে সেন্সরযুক্ত চিপ। গাভি যখন দুধ দেওয়ার সময় অনুভব করে তখন রোবট স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংকেত পায় এবং দুধ দোহানো সম্পন্ন হয়। সবকিছুই স্মার্ট প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণে।
মনে পড়ল ২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডসের ডে মার্ক এলাকায় গরুর এক আধুনিক খামারে গিয়ে বিস্মিত হয়েছিলাম। প্রযুক্তির এমন সুচারু প্রয়োগ কৃষিকে সত্যিই এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ বা আইওটি কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে। আমাদের দেশেও কয়েক বছর আগে কিছু শিল্পোদ্যোক্তা স্মার্ট গরুর খামার গড়তে উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
ভাসমান খামারটিতে বর্জ্য বা পানির কোনো কিছুই নষ্ট হয় না। প্রতিটি উপকরণেরই পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। এটি টেকসই ও সার্কুলার ফার্মিংয়ের এক অনন্য উদাহরণ। শহরের মানুষের ফেলে দেওয়া খাবার, ফুটবল মাঠের কাটা ঘাস, সুপারশপ ও ঘরবাড়ির জৈববর্জ্য সবকিছুই গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ রুটি, সবজি বা আলু, যা সাধারণত ফেলে দেওয়া হয়, সেগুলোকেই এখানে রূপান্তর করা হয় পুষ্টিকর পশুখাদ্যে। ফলে খাদ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়, একই সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাতেও এটি রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
খামারে উৎপাদিত দুধ সরবরাহ করা হয় শহরের মানুষদের কাছে। গরুর গোবর থেকে তৈরি হয় জৈবসার, যা দিয়ে ফলানো হয় শাকসবজি ও ফলমূল। খামারের পাশে রয়েছে বিশাল সোলার প্যানেল এলাকা, সেখানেই উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে চলে পুরো খামার। ছাদ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে রাখা যায়।
মিনকে বলছিলেন, ‘ভালো দুধ উৎপাদনের জন্য শুধু পুষ্টিকর খাবার নয়, গরুর আরামদায়ক পরিবেশও অত্যন্ত জরুরি। আমরা গরুগুলোকে সারাক্ষণ বদ্ধ অবস্থায় রাখি না। সকালে খাবারের পর তারা নিজেরাই মাঠে যায়, বিকালে আবার ফিরে আসে। তাদের জন্য স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে, কোনো কিছুতেই জোর করা হয় না।’
এই খামারে কিছুই অপ্রয়োজনীয় নয়। গরুর গোবর ও মূত্র থেকে তৈরি হয় জৈবসার। পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করা এই উদ্যোগ তিন বছরে সফল প্রকল্পে পরিণত হয়েছে। এখন এটি নগর কৃষির এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছে। ক্রমেই বাড়ছে তাদের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা। মিনকে জানালেন, শিগগিরই তারা দুধের পাশাপাশি ভাসমান সবজি প্লট এবং পোলট্রি ফার্ম গড়ে তুলবেন। সবই হবে পানির ওপর ভাসমান। শুধু রটার্ডাম নয়, অন্য শহরগুলোতেও এই মডেল সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। এখানে উৎপাদিত দুধ স্থানীয় মানুষের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করে। দুধ থেকে তৈরি হয় দই, মাখন, চিজ। এসব পণ্য বিক্রি হয় অনলাইনে এবং খামারের নিজস্ব বিক্রয় কেন্দ্রে। এই খামার ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সার্কুলার ইকোনমি। উৎপাদন, বিপণন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সবকিছুই পরিবেশবান্ধব এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত। নিশ্চয়ই ফ্লোটিং ফার্মের মতো ব্যয়বহুল ব্যবস্থাপনা আমাদের সাধারণ খামারিদের নাগালের বাইরে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমরা ইতোমধ্যে অনুভব করছি। অসময়ে বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘন ঘন ঘটছে। উন্নত বিশ্ব যেমন আগামীর কৃষিকে নতুনভাবে ভাবছে, আমরাও টিকে থাকার প্রশ্নে সেই ভাবনাকে অনুসরণ করতে পারি। আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় এনে, ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব