রবিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৬ ০০:০০ টা
শিক্ষকের কথা

মূল্যবোধের প্রথম শিক্ষা পরিবার থেকেই

মূল্যবোধের প্রথম শিক্ষা পরিবার থেকেই

এইচএসসি ছাড়াও অনার্স এবং মাস্টার্স প্রোগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে— দেশের এমন ৬৮৫টি কলেজের ওপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি একটি র্যাংকিংস প্রকাশ করেছে। র্যাংকিংয়ে বরিশাল বিভাগের সেরা ১০টি কলেজের মধ্যে একটি হচ্ছে সরকারি বরিশাল কলেজ। প্রতিষ্ঠানটির এ সাফল্যের পেছনে রহস্য কি, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক মানোন্নয়নে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণাবলির বিকাশে করণীয় কি— এসব নিয়ে কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ প্রফেসর খোন্দকার অলিউল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক—রাহাত খান

 

প্রশ্ন : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমবারের মতো দেশের সব কলেজের র্যাংকিংস প্রকাশ করেছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

অধ্যক্ষ : এজন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য মহোদয়কে হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর মধ্যে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে। তাই এটা অবশ্যই একটি মহতী উদ্যোগ।

প্রশ্ন : কলেজ র্যাংকিংয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে আপনার প্রতিষ্ঠান সেরা দশটির একটি। এ সফলতার পেছনে কোন কোন বিষয় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন?

অধ্যক্ষ : সুষ্ঠু একাডেমিক পরিবেশ, প্রতিভাবান নিবেদিত প্রাণ, প্রতিশ্রুতিশীল ও অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর আন্তরিক প্রচেষ্টা ; ছাত্র-ছাত্রীদের শৃঙ্খলা মেনে চলা এবং নিয়মিত ক্লাস, প্রাকটিক্যাল, টিউটোরিয়াল, ইনকোর্সসহ অন্যান্য পরীক্ষাসমূহ গ্রহণ ও মূল্যায়নে সব সময় সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। সর্বোপরি কলেজ প্রশাসনের উপযুক্ত ও সময়োপযোগী তদারকি তথা দিকনির্দেশনাই এ সার্থকতার মূল কারণ। এছাড়াও নিয়মিত ভিজিল্যান্স টিমের সার্বক্ষণিক তদারকিতে কলেজের একাডেমিক পরিবেশ উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে।

প্রশ্ন : শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে এগিয়ে যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

অধ্যক্ষ : শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন মেধাবী ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন উপযুক্ত প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত শিক্ষকমণ্ডলী যারা শিক্ষার্থীদের আগ্রহ নিয়ে শিক্ষাদানে সচেষ্ট থাকেন। শিক্ষামূলক বিভিন্ন প্রতিযোগিতা যেমন স্কাউটিং, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, ডিবেটিং, বিএনসিসিসহ সব সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। তাছাড়া শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক সংঘ প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার্থীদের মেধা, শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনে যৌথ ভূমিকা রাখতে পারলে কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

প্রশ্ন : দেশের শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। মান বাড়াতে হলে সংশ্লিষ্ট সবার করণীয় কী বলে আপনি মনে করেন?

অধ্যক্ষ : এজন্য শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবাইকে সমন্বিত ভূমিকা পালনের মাধ্যমেই গুণগত মান বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে হবে। এরই অংশ হিসেবে মেধাবী ও দেশপ্রেমিকদের শিক্ষকতায় আসতে হবে, যাতে তারা মেধাবী জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করতে পারে। প্রয়োজনে প্রণোদনা প্রদান করার ব্যবস্থা করতে হবে; বার্ষিক একাডেমিক ক্যালেন্ডার তৈরি ও সে অনুযায়ী একাডেমিক কার্যক্রম চালু রাখার ব্যবস্থা করতে হবে; পাঠ্যক্রমে শিক্ষার্থীর মনন ও বোধনের উৎকর্ষ সাধনের উপযোগী পাঠ্য বিষয়ের উপস্থিতি।

প্রশ্ন : শিক্ষার মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকরা কি ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

অধ্যক্ষ : প্রথমত শিক্ষার্থী শিক্ষক অনুপাত সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতির জন্য শিক্ষকরাই তাদের উৎসাহিত করবেন। কম মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের বাড়তি মনোযোগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ঘাটতি পূরণে শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। পাঠ্যক্রমের সর্বশেষ তথ্যগত ধারণা শিক্ষার্থীদের প্রদান, মাল্টিমিডিয়া প্রযুক্তির মাধ্যমে পাঠদান এবং সহপাঠ্য ক্রমিক কার্যক্রমে শিক্ষকদেরই নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখতে হবে।

প্রশ্ন : শিক্ষকদের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। এ থেকে উত্তরণে করণীয় কী?

অধ্যক্ষ : এজন্য বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন কেবল শিক্ষকতায় আগ্রহী মেধাবী প্রার্থীদের মধ্য থেকে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে; শিক্ষক নিয়োগে শতভাগ স্বচ্ছতা থাকতে হবে;

শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের আগে একজন শিক্ষককে উপযুক্তভাবে নিজেকে তৈরি করতে হবে এবং শিক্ষকদের শিক্ষাদানে সন্তুষ্টির জায়গাটি নিশ্চিতকরণ ও কর্মস্পৃহা সৃষ্টি করতে হবে।

প্রশ্ন : মূল্যবোধের অবক্ষয় এখন সমাজের সর্বস্তরে প্রতীয়মান হচ্ছে। এর উন্নয়নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কী ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন?

অধ্যক্ষ : মূল্যবোধের শিক্ষা প্রথমত পরিবার থেকেই শিক্ষার্থীরা পেয়ে থাকে। শিক্ষার্থীরা সবাই সমান মূল্যবোধসম্পন্ন হবে না এটা স্বাভাবিক। এ লক্ষ্যে সরকারি বরিশাল কলেজ অভিভাবক, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের যৌথসভা বছরে একাধিকবার করে থাকে। শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, ভদ্রতা, নম্রতা, পারস্পরিক কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ কীভাবে বাড়ানো যায় এসব আলোচনা ও পর্যালোচনা সভায় হয়ে থাকে।

প্রশ্ন : সহশিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার মান উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশের ক্ষেত্রে কীভাবে ভূমিকা রাখে?

অধ্যক্ষ : সহশিক্ষা কার্যক্রম নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া সৃষ্টিতে সাহায্য করে। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে পবিত্র বন্ধুত্ব ও একে অপরের একাডেমিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়।

প্রশ্ন : আপনার শিক্ষাজীবনের কোনো মধুর স্মৃতি থাকলে বলুন।

অধ্যক্ষ : অনেক মধুর স্মৃতি রয়েছে। তবে একটা স্মৃতির কথা বেশ মনে পড়ছে। ২০০৩ সালে পবিত্র হজ পালনের জন্য মক্কা শরিফ যাই। নিজ বাসা বরিশালে ফোন করার জন্য একটি ফোনের দোকানে যাই। ফোন শেষ হলে দোকানের এক কর্মচারী ভিতর থেকে বের হয়ে এসে আমাকে সালাম দিয়ে বলল, ‘স্যার আপনি বিএম কলেজের শিক্ষক না?’ আমি বললাম, হ্যাঁ। কিন্তু কেন? সে উত্তর দিল, ‘স্যার আমি আপনার ছাত্র। এখানে চাকরি করি। চলেন, চা খাবেন।’ আমি বললাম, ‘না। পেটে একটু সমস্যা।’ সে বলল,  ‘তাহলে একটা ড্রিংকস খাবেন, পেট ভালো হয়ে যাবে।’ আমি গ্রহণ করলাম। এতে প্রমাণিত হয়, ‘শিক্ষক কখনো মরে না, বেঁচে থাকে শিষ্যদের মাঝে।’

প্রশ্ন : স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আপনার উপদেশ কি?

অধ্যক্ষ : ‘মানুষ হও। মনন ও স্নায়ুতে নিবেদিত হও দেশের কল্যাণে।’

সর্বশেষ খবর