সোমবার, ১০ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

অষ্টম শ্রেণির চারু ও কারুকলা

সুকুমার মন্ডল, সিনিয়র শিক্ষক

দ্বিতীয় অধ্যায়

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে চারুশিল্প ও শিল্পীরা

 

১. ঢাকা শহরে প্রথম নবান্ন উৎসব বিষয়ে বিস্তারিত লেখ?

উত্তর : ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। অগ্রহায়ণ মাসে কৃষক ফসল (ধান) কেটে ঘরে তোলে। চাষির ঘরে ঘরে আনন্দ। নতুন ধানের পিঠা-পায়েস খাওয়া, আনন্দ অনুষ্ঠান করা, যেমন-কবিগানের লড়াই, হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্ধা খেলা, যাত্রাপালার আয়োজন এবং কখনো কখনো মেলা। গ্রামের সেই নবান্ন উৎসবকে নতুন রূপে শহরে পালন করতে শুরু করে চিত্রশিল্পীরা। ১৯৭০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে ১০-১২ জন তরুণ চিত্রশিল্পী, কবি ও সাংবাদিকের উদ্যোগে শিল্পকলা একাডেমিতে বিশাল আকারে অনুষ্ঠিত হয় নবান্ন চিত্রপ্রদর্শনী। ছবি এঁকে বিশাল প্রদর্শনী হলো। শিল্পাচার্য তাঁর বিখ্যাত ‘নবান্ন’ দীর্ঘ স্ক্রল ছবিটি এই নবান্ন প্রদর্শনী উপলক্ষেই আঁকলেন, যার দৈর্ঘ্য ৬০ ফুট ও প্রস্থ ৬ ফুট। ‘নবান্ন’ স্ক্রল চিত্রটি শিল্পকলা জগতের মূল্যবান সম্পদ।

নবান্ন প্রদর্শনীর প্রধান উদ্যোক্তা ও উপদেষ্টা ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। অন্য সদস্যরা হলেন-শিল্পী হাশেম খান, শিল্পী রফিকুন নবী, লেখক ও শিল্পী বুলবন ওসমান, শিল্পী মঞ্জুরুল হক, আবুল বারক আলভী, বীরেন সোম, মতলুব আলী, শিল্পী ও সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, কবি ও সাংবাদিক মো. আকতার প্রমুখ। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সে সময়ে নবান্ন চিত্র প্রদর্শনী ছিল বিশাল ও বিপ্লবী পদক্ষেপ। যাঁরা এই প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেন তাঁদের জন্য ছিল অনেক বাধা ও ভয়ভীতি। সেই সময়ের পাকিস্তানি সামরিক সরকার এ ধরনের উদ্যোগকে মনে করত পাকিস্তানের আদর্শবিরোধী। অন্যদিকে কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি অপপ্রচার করে বলতে লাগল এই প্রদর্শনীর পেছনে শিল্পাচার্য জয়নুল ও উদ্যোক্তা শিল্পীদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে ইত্যাদি। কিন্তু শিল্পীর অশেষ চেষ্টায় সব শিল্পীকে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে এমন একটি প্রদর্শনী করলেন, যা দেখে মানুষ বিস্মিত ও বিমোহিত। প্রায় হারিয়ে যাওয়া নবান্ন উৎসবের আনন্দকে শহরের মানুষদের নতুন করে মনে করিয়ে দিলেন শিল্পীরা। প্রায় সব শিল্পীই এঁকেছেন বাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার নানা রকম চিত্র। অন্যদিকে আছে মহাজনের শোষণ ও নানাভাবে বঞ্চিত হওয়ার ছবি। বাংলাদেশের নদী-নালা, মাঠ-ঘাট ও বিভিন্ন ঋতুতে প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের ছবি। নবান্ন প্রদর্শনী উপলক্ষে ‘নবান্ন’ নাম দিয়ে দেশের খ্যাতনামা ও নবীন কবিদের কবিতা, ছড়াসহ একটি পুস্তিকাও প্রকাশিত হয়েছিল।

 

২. চিত্রশিল্পীরা কোন কোন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থেকে জনগণের দাবি আদায়ে সহযোগিতা করেছেন?

 

উত্তর : স্বাধীনতার পূর্ববতী সময়ে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে যেসব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দল আন্দোলন করে চলেছে-তাদের প্রচারে পোস্টার আঁকা, কার্টুন আঁকা, ফেস্টুন, ব্যানার, মঞ্চসজ্জা-সব কিছুতে চিত্রশিল্পীরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকতেন। যেসব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জনগণের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে চিত্রশিল্পীরা সহযোগিতা করেছিলেন সেগুলো হলো-আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং সাংস্কৃতিক দল ছায়ানট, উদীচী ও প্রগতিশীল নাট্যদলগুলোর সঙ্গে। এ ছাড়া শিশু সংগঠন খেলাঘর ও কচি-কাঁচার মেলার মাধ্যমে চিত্রশিল্পীরা শিশু চিত্রকলা ও অন্যান্য সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে বাংলাদেশের অধিকার আদায় এবং নিজেদের শিল্প, সাহিত্য ও ঐতিহ্য বিষয়ে আগ্রহী করে তুলেছিলেন।

 

৩. আমাদের সংস্কৃতির গৌরবময় দিকগুলো সম্পর্কে তোমার মতামত ব্যক্ত করো।

উত্তর : আমাদের সংস্কৃতির গৌরবময় দিকগুলো আবহমান কাল ধরে এ দেশের মানুষের ন্ডেন্ডেন প্রেরণা জুগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতিচর্চায় ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠিত চারুকলা প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ছবি আঁকা, ভাস্কর্য ও অন্যান্য শিল্পকর্মের মাধ্যমে নানা রকম সংস্কৃতি বিকশিত হয়, বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত শহীদ মিনার এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে জনগণকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশু সংগঠন খেলাঘর ও কচি-কাঁচার মেলার মাধ্যমে চিত্রশিল্পীরা শিশু চিত্রকলা ও অন্যান্য সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে শিশুদের ন্ডেন্ডেধ্য বাংলাদেশের অধিকার আদায় এবং নিজেদের শিল্প, সাহিত্য ও ঐতিহ্য বিষয়ে আগ্রহী করে তোলে। বর্তমানে আলপনার ব্যবহার বাঙালি সংস্কৃতির একটি অত্যাবশকীয় অনুষঙ্গ। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে বা যেকোনো শুভ কাজে আলপনার ব্যবহার এখন স্বাভাবিক সংস্কৃতি। তা ছাড়া নবান্ন উৎসব ও বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশের মানুষকে নিজের দেশ, নিজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহী করতে, গর্ববোধ করতে উদ্বুদ্ধ করছে।

 

৪. বাংলাদেশের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বিভিন্ন সংগঠন ও শিল্পীদের ভূমিকা সংক্ষেপে লেখো।

উত্তর : ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৩ বছর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে বারবার আন্দোলন করেছে, সংগ্রাম করেছে। এর মধ্যে ভাষা আন্দোলন, আইউব খানের মার্শাল লবিরোধী আন্দোলন, হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে বিশাল গণ-আন্দোলনসহ নানা আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠনের সঙ্গে চিত্রশিল্পীরাও জড়িত ছিলেন। সব রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক দল, সংগঠনের আন্দোলনকে আরো বেগবান করতে চিত্রশিল্পীরা তাঁদের প্রচারে পোস্টার আঁকা, কার্টুন আঁকা, ফেস্টুন, ব্যানার, মঞ্চসজ্জা-সব কিছুতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকতেন।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে পটুয়া কামরুল হাসানসহ সেই সময়ের অনেক চারুশিল্পীর ছাত্ররা ভাষা আন্দোলন ও শাসকদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ড্রইং ও কাঠ খোদাই, লিনোকাট মাধ্যমে বেশ কিছু ছবি তৈরি করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। স্বশিক্ষিত চিত্রশিল্পী কাজী আবুল কাশেম দোপেঁয়াজা ছদ্ম নামে ভাষা আন্দোলনবিষয়ক কার্টুন আঁকেন। এসব ছবি অধিকার আদায়ে জনগণকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ইতিহাসের অংশ। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে চিত্রশিল্পীরা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নানা নির্যাতনের ছবি এঁকে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। ১৯৭১ সালে বিদ্রোহী স্বরবর্ণ নামের একটি প্রদর্শনী জনগণের মধ্যে বিপুল সাড়া তুলেছিল, যা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে এ ধরনের প্রদর্শনী ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল।

 

৫. অসহযোগ আন্দোলনে চিত্রশিল্পীরা যেসব ছবি এঁকেছিলেন, সেগুলোর বিষয়বস্তু উল্লেখ করো।

উত্তর : ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করার পরও তাকে সরকার গঠনের অধিকার দেওয়া হয়নি। তাই ১৯৭১ সালের ২ মার্চ বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের চিত্রশিল্পীরা একজোট হয়ে আলোচনায় বসলেন। ছবি এঁকে, পোস্টার ও বড় বড় ব্যানার লিখে বাঙালির এই অসহযোগ আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ও র্তেুজা বশীরকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে একটি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। ১০ দিন ধরে কয়েক শ ছবি ও পোস্টার এঁকে চিত্রশিল্পীরা ১৭ ান্ডের্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে শহীদ মিনার থেকে বিপ্লবী চিত্রের মিছিল বের করেন। এসব চিত্রের বিষয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের তথা বাঙালিদের বঞ্চনার ছবি, নির্যাতনের ছবি, বাঙালিদের সম্পদ লুট করে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের প্রতিবাদ ও ছবি, বাংলার ভাষা, সংস্কৃতির প্রতি আক্রমণ ও অবহেলার ছবি, সেই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতিবাদ ও সংগ্রামের ছবি।

সর্বশেষ খবর