বুধবার, ৬ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় অনলাইন শিক্ষা

প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো কভিড-১৯ এর ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে অচলাবস্থা শুরু হয়েছে তা থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করার জন্য অনলাইনে একাডেমিক কার্যক্রম চালু করা যায় কি না?

ড. প্রণব কুমার পন্ডে

করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় অনলাইন শিক্ষা

বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ মহামারী আকার ধারণ করায় পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ গত ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে। কভিড-১৯ সংক্রমণের ক্রমবর্ধমান অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রতিষ্ঠানসূহ কত দিন বন্ধ থাকবে তা ভবিষ্যদ্বাণী করা এই মুহূর্তে খুবই কঠিন। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিন আগে রাজশাহী বিভাগের জেলাসমূহের প্রশাসনের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের সময় ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, অবস্থার উন্নতি না হলে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ থাকবে। ফলে, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ কবে তাদের পাঠদান কার্যক্রম আবার শুরু করবে তা অনুমান করা কঠিন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ই-লার্নিং চালু করা হয়েছে যদিও এটি কতটুকু কার্যকর হবে তা বলা কঠিন কারণ দেশে হাজার হাজার শিক্ষার্থী আছে যাদের বাসায় টেলিভিশনের নেই। ফলে সরকারের সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয় হলেও আমাদের দেশের বাস্তবতায়  ভার্চুয়াল লানিং এর  কার্যকারিতা প্রশ্নাতীত নয়। এর মূল কারণ হলো আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা ই-লার্নিং বা ভার্চুয়াল ই-লার্নিং এর উদ্যোগগুলোর সঙ্গে তেমন পরিচিত নয়। অধিকন্তু, ভার্চুয়াল ক্লাসের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া গ্রামের শিক্ষার্থীদের পক্ষে কঠিন হতে পারে। অন্যদিকে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বন্ধ হওয়ায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী উদ্বিগ্ন রয়েছে শুধু পড়াশোনার ছন্দে ফেরার চিন্তায় নয় বরং তারা যথাসময়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে পারবে কি না সে চিন্তায়। ইতিমধ্যেই উন্নত দেশগুলোর বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। সুতরাং, একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো : কভিড-১৯ এর ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে অঢ়লাবস্থা শুরু হয়েছে তা থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করার জন্য দেশে অনলাইনে একাডেমিক কার্যক্রম চালু করা যায় কি না? দেশের কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে তাদের অন-লাইন ভিত্তিক একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করেছে। ইতিমধ্যে, একটি নামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পূর্ববর্তী একাডেমিক সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে গ্রেড প্রদান করার সিদ্ধান্ত নিয়েও পরে তা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে নিজেদের শিক্ষকদের সমালোচনার করণে। পরে, ইউজিসি সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ববর্তী সাফল্যের ভিত্তিতে গ্রেড প্রদান না করা এবং অনলাইনে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা না করার একাধিক নির্দেশনা জারি করেছে। ইউজিসির এই ধরনের নির্দেশনা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের মধ্যে মারাত্মক অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। ইউজিসির নির্দেশনা সত্ত্বেও অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে তাদের একাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের সেশন জট থেকে রক্ষা করার জন্য এটি একটি দুর্দান্ত উদ্যোগ। তবে, একই সঙ্গে এটিও সত্য যে গোটা দেশের বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষে ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতো অনলাইনে সংযুক্ত থেকে একাডেমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা কঠিন। 

ঢাকা-ভিত্তিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ, অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় শিক্ষার সরঞ্জাম থাকলেও, প্রত্যন্ত জেলার শিক্ষার্থীদের এগুলোতে অ্যাক্সেস নাও থাকতে পারে।  সুতরাং, কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ভিত্তিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেশজুড়ে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে নাও পারে। কিছু সমালোচনা সত্ত্বেও, এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি প্রশংসনীয়। এটি কেবল শিক্ষার্থীদের সেশন জট থেকে বাঁচাবে না বরং অভিভাবকদের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের বোঝা থেকে মুক্তি দিবে। 

এখন একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো : দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য কী হবে? গত ১০-১২ বছর ধরে চলমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সেশন জট সম্পর্কিত সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করেছে। কয়েকটি বিশ^বিদ্যালয় বাদে বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের একাডেমিক কার্যক্রমগুলো সুচারুভাবে পরিচালনা করে চলেছে। ফলে, শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ডিগ্রি সম্পন্ন করতে পারছে। কভিড-১৯ এর ফলে অব্যাহত অচলাবস্থা অবশ্যই এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কারণ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ কবে পুনরায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করবে তা বলা খুবই কঠিন। এ অচলাবস্থায় পাঠদানের বার্ষিক ব্যবস্থা অনুসরণকারী শিক্ষার্থীদের চেয়ে ছয় মাস অন্তর সেমিস্টারভিত্তিক একাডেমিক কার্যক্রম অনুসরণকারী শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, যারা ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রথম সেমিস্টার শুরু করেছে তাদের জুনে সেমিস্টার শেষ করার কথা রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাদের পক্ষে জুনে সেমিস্টার শেষ করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, যে সব শিক্ষার্থী তিন/চার মাস অন্তর সেমিস্টার পদ্ধতি অনুসরণ করছে পরিস্থিতি তাদের জন্য আরও ভয়াবহ। বরং, বার্ষিক পদ্ধতি অনুসরণকারী শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে কিছুটা হলেও সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে আছে কারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে তাদের সহায়তা করতে পারে। ইতিমধ্যে, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সরকার ঘোষিত ছুটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে। এখন সবার মনে একটি প্রশ্ন, এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক পরিবেশ পুনরায় চালু করার বিকল্প কী হতে পারে। আমাদের মধ্যে অনেকেই অনলাইন ভিত্তিক একাডেমিক কার্যক্রম চালু করার পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন এবং শিক্ষকরা এই মুহূর্তে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার জন্য প্রস্তুত কি না- তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। অনলাইন শিক্ষার প্রস্তুতি সম্পর্কে কথা বলার আগে আমাদের অবশ্যই প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের পক্ষে এটি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব কিনা তা খতিয়ে দেখা উচিত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষকমন্ডলী আধুনিক অনলাইন শিক্ষার কৌশলগুলোর সঙ্গে পরিচিত থাকলেও প্রায় প্রত্যেক পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে এক দল শিক্ষক আছেন যারা এই পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত নন। তাদের ক্ষেত্রে কী হবে? আমরা তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেয় যে, তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই পদ্ধতি রপ্ত করে ফেলতে পারবেন কিন্তু, সরকার যখন নাগরিকদের ঘরে থাকার জন্য উৎসাহিত করছেন তখনো মহামারী চলাকালীন এই জাতীয় সিদ্ধান্তগুলো প্রশাসনিকভাবে কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে সেটি আলোচনার দাবি রাখে। অনেকেই যুক্তি প্রদর্শন করতে পারেন যে গুগল ক্লাসরুম বা জুম বা অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যে ঘরে বসে এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এটি বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন হবে।

আসল চ্যালেঞ্জ হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্তি নিশ্চিত করা। অনেক শিক্ষার্থীর ল্যাপটপ, অ্যানরয়েড ফোন এবং ইন্টারনেটসহ আধুনিক প্রযুক্তিগুলোতে অ্যাক্সেস নেই। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীর এই প্রযুক্তিগুলোতে অ্যাক্সেস থাকলেও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর এই প্রযুক্তগুলোতে অ্যাক্সেস নাও থাকতে পারে। আবার অনেক শিক্ষার্থী যারা প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করে তারা এই কৌশলগুলোর সঙ্গে পরিচিত নাও হতে পারে। আবার হয়ে থাকলেও সেখানে ইন্টারনেটের গতি কম থাকতে পারে। আবার অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে হলে প্রত্যেকটি কিশ^বিদ্যালয়ের পর্যাপ্ত সময় প্রয়োজন। অতএব, বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা কাম্য হলেও সম্ভব নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করা কষ্টসাধ্য হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের প্রশাসনসহ দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে গুরুত্বসহকারে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। এটি সত্য যে, কয়েক মাস আগেও কেই কল্পনাও করতে পারেননি যে কভিড-১৯ এর প্রভাবে বিশ^ব্যাপী এ ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে। একই সঙ্গে কেউ গ্যারান্টি দিয়ে বলতেও পারবে না যে,  কভিড-১৯ এর ট্রমা থেকে বের হয়ে আসার পরে ভবিষ্যতে এই জাতীয় দুর্যোগ আর আসবে না। যেহেতু, আমাদের প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন যে পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি না হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে, ফলে শ্রেণিকক্ষ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনলাইন শিক্ষায় রূপান্তর করার কাজ শুরু করা আবশ্যক।

আবার এটিও ঠিক অধিক চিন্তাভাবনা না করে তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য দেখা দিতে পারে। সুতরাং, ব্যাকআপ পরিকল্পনা হিসেবে অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালুর বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা দরকার।

লেখক : অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর