বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা
লালন উৎসব

‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’

জহুরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া

‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’

উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন লালন একাডেমির প্রবীণ শিল্পী বাউল মোহাম্মদ আলী সাঁই ও সহশিল্পীরা

দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেছে। গত শুক্রবার থেকে আখড়াবাড়িতে শুরু হয়েছে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের ১২৫তম মৃত্যুবার্ষিকীর ৫ দিনের উৎসব মেলা।

স্মরণোৎসবে প্রতিবছরের মতো এবারও সাধক লালনের আধ্যাত্মিক দর্শন লাভের আশায় দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ প্রাণের টানে ছুটে আসেন। একতারা, দোতারা, ঢোল ও বাঁশির সুরে মুখরিত হয়ে উঠেছে লালনভূমি ছেঁউড়িয়া। দূরদূরান্ত থেকে আসা বাউলেরা দরদভরা কণ্ঠে গাইছেন ‘বাড়ির পাশে আরশী নগর, সত্য বল সুপথে চল, এলাহি আলামিন গো আলা বাদশা আলমপনা তুমি’-এ রকম অসংখ্য গান। লালন মাজারের আশপাশে ও মরা কালী নদীর তীর ধরে বাউলেরা ছোট ছোট আস্তানা গেড়ে সাঁইজিকে স্মরণ করেছেন তার গাওয়া গান গেয়ে। ভক্ত-অনুসারীরা এসেই প্রথমে মূল মাজারের ভেতরে চিরনিদ্রায় শায়িত তাদের ধর্মগুরুর প্রতি বিশেষ ভঙ্গিতে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। তারা জাত, কুল, ধর্ম, গোত্র ভুলে একে অপরের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করেছেন। দূর-দূরান্ত থেকে সাদা বসনে বাউল সাধকরা এসেছেন দলে দলে একতারা-দোতারা, ঢোল-খোল, বাঁশি, প্রেমজুড়ি, চাকতি, খমক হাতে। ক্ষণে ক্ষণেই খণ্ড খণ্ড মজমা থেকে নৃত্যসংগীতের তালে তালে ছলকে উঠছে যেন উত্তাল ভাববাদী ঢেউ। কেউ শুধু লুঙ্গি পরে নাচছেন, গাইছেন। কারও উদোম গা। গলায় বিচিত্র বর্ণ ও আকারের পাথরের মালা। হাতে বিশেষ ধরনের লাঠি ও বাদ্যযন্ত্র। লালন ধামের ভিতর ও বাইরে নিজেদের পছন্দমতো জায়গা করে নিয়ে গান-বাজনা করছেন তারা। বিচিত্র সব বাদ্যযন্ত্রে তুলছেন হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া লালনগীতি। আখড়ার একটি দল থামছে তো অন্যটি জমিয়ে রাখছে চারপাশ।

লালন ধামের ভিতর পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী বাউল কামিরন তার সহযোগীদের নিয়ে একতারা হাতে নেচে-গেয়ে সাঁইজির বন্দনা করছিলেন। কথার পিঠে কথা আর মনের ভিতর আধ্যাÍবাদ নিয়ে গাইছিলেন তিনি। কামিরন বলেন, লালন নিজেও এভাবে গান করতেন। তার কাছে ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাতের বিচার ছিল না। পুরুষের পাশাপাশি আশ্রয়হীন নারীদের তিনি বাঁচার সুযোগ করে দিতেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে গাইতেন। নাচতেন। কোনো এক অচিন গাঁয়ের অচেনা মানুষ ফকির লালন এখানে বসেই জীবনভর সন্ধান করেছেন, অচিন পাখির সহজ কথায় বেঁধেছেন জীবনের গভীরতম গান। আধ্যাত্মিক দর্শন লাভের আশায় দূর-দূরান্ত থেকে ভক্ত-অনুসারীরা এখন এখানে আরও বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। নিরাপদ আশ্রয়সহ কোনো সমস্যা হয় কি-না দেখার জন্য লালন একাডেমির সদস্যরা সদা সতর্ক। তবে লালন একাডেমির পক্ষ থেকে বাউলদের অধিবাস সেবা, বাল্যসেবা বা বালক সেবা ও পূর্ণসেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাউলরা একসঙ্গে বসে গ্রহণ করেন সেবা। সমাধিতে গাঁদা ফুল, আতর, গোলাপ ছড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন হাজারো শিষ্য-ভক্ত।

উৎসবে শামিল হতে মাগুরা থেকে ছুটে এসেছেন একদল তরুণ। তারা সবাই লালনের ভক্ত। প্রতি বছর আসেন। তাদের একজন খায়রুল বাশার বলেন, ‘লালনের গানে মানবতা বোধ, অহিংস ভাব ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণে দিন দিন তার গানের ভক্ত ও অনুসারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

লালনের গান কবিতা আকারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত    করা হোক।’ বাংলা ১২৯৭ সালের পয়লা কার্তিক   লালন শাহ দেহত্যাগ করার পর থেকে তার মাজার চত্বরে মহা ধুমধামের সঙ্গে এই স্মরণ উৎসব পালিত হয়ে আসছে।

১৭ তারিখ শুরু হওয়া উৎসবটি গতকাল শেষ হয়েছে।

সর্বশেষ খবর