শিরোনাম
শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বলিউডের ইতিহাসপুরুষ

আলী আফতাব

বলিউডের ইতিহাসপুরুষ

অমিতাভ বচ্চন। বয়সের হিসাব কষলে ৭৩ বছর। কিন্তু ঝিমিয়েও পড়েননি। বরং তরুণদের মতো দাপুটে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এই চিরতরুণ জীবনে অনেক সংগ্রামের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু ভেঙে যাননি, ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বারবার। আর তাই বলিউডের চলচ্চিত্র ইতিহাসের ভিতর-বাহির অমিতাভকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। তাকে নিয়ে লিখেছেন আলী আফতাব

 

 

পর্দায় সানি শেখ রূপী আমজাদ খানকে ঘুষি মারছেন তিনি। আর একটা দশক তার সব রাগ-ঘেন্না-হতাশা নিয়ে শক্তি জোগাচ্ছে তার বাহুতে। আসলে তিনি তো নিজের জন্য মারছেন না, মারছেন চুরি যাওয়া ‘মাসুম’ বাচ্চাটির জন্য। মারছেন অন্ধকার দুনিয়ার ছোঁয়ায় তার শেষ হয়ে যাওয়া ‘ইনসানিয়াত’র বদলা নিতে। হ্যাঁ পর্দায় এ চরিত্রের নাম ‘কালিয়া’ হতে পারে, কিন্তু ভারতীয় সিনেমা ইতিহাস জানে, তিনি অমিতাভ বচ্চন ছাড়া আর কেউ নন।

জাঞ্জির, শোলে এবং দিওয়ার ছবিতে অভিনয় করা অমিতাভ বচ্চন ছিলেন মারকুটে যুবকের ইমেজে। কিন্তু ১৯৮২ সালে ‘কুলি’ ছবির শুটিংয়ে দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ওঠার পর থেকে তার শরীর ভাঙতে শুরু করে। কিন্তু তিনি আÍবিশ্বাস হারাননি।

এখনো অভিনয় করে যাচ্ছেন একের পর এক চলচ্চিত্রে। ছবির মূল চরিত্র হয়ে পাল্লা দিচ্ছেন শাহরুখ-আমির-সালমান খানদের মতো তাগড়া নায়কদের সঙ্গে। এ জন্যই তিনি বলিউডের অঘোষিত শাসক, শাহেনশাহ।

‘ভিম’ ছিল বিগ-বি’র শততম ছবি। আর ‘ভুতনাথ রিটার্নস’ ছিল তার ২০০তম ছবি। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি অভিনয় করেছেন প্রায় ২০৬টি ছবিতে।

পরিবারের সঙ্গে অমিতাভ। এটি একটি সুখী পরিবারের আদর্শ উদাহরণ

 

১৯৪২ সালের ১১ অক্টোবর উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে জন্ম অমিতাভ বচ্চনের। পিতা হরিভাঁশ রায় বচ্চন ছিলেন একজন সুপরিচিত সাহিত্যিক। মা তেজি বচ্চন গৃহিণী। তিনি দীর্ঘদিন রেখার সঙ্গে প্রেম করে ১৯৭৩ সালে বিয়ে করেন জয়া ভাদুড়িকে। তাদের ঘরে আছে দুটি সন্তান। বড় মেয়ে শ্বেতা নন্দা এবং ছোট ছেলে অভিষেক বচ্চন।

ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম সেরা রোমান্টিক জুটি ছিলেন অমিতাভ-রেখা। তাদের অসামান্য পর্দা-রসায়ন তাদের বাস্তবের প্রেমের সম্পর্কের প্রতিফলন ছিল বলেই মনে করা হয়। তাদের জন্মদিনও পাশাপাশি। অমিতাভ বচ্চন জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৪২ সালের ১১ অক্টোবর আর রেখার জন্মদিন ১৯৫৪ সালের ১০ অক্টোবর। বেশকিছু বাণিজ্যসফল হিন্দি সিনেমায় এই জুটি অভিনয় করেছেন।

অমিতাভ-রেখা অভিনীত ছবির কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে পড়বে ‘সিলসিলা’র নাম। ১৯৮১ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটিতে শেষবারের মতো একসঙ্গে অভিনয় করেন এই জুটি। এতে প্রধান ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন, রেখা, জয়া বচ্চন ও সঞ্জীব কুমার। পরকীয়া প্রেমভিত্তিক ছবিটিতে অমিতাভ-রেখার বাস্তব জীবনের ছায়া পড়েছিল বলে রটনা রয়েছে।

অমিতাভের পুত্রবধূ বলিউডের আরেক ‘বিগ’ সেলিব্রেটি ঐশ্বরিয়া রাই। মায়ানগরী মুম্বাইয়ে বিখ্যাত বাসভবন ‘প্রতীক্ষা’তে পরিবার নিয়ে তার সুখের বসবাস।

পর্দায় অমিতাভের প্রথম কাজ ১৯৬৯ সালে মৃণাল সেনের জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ছবি ‘ভুবন সোম’ ছবিতে ভাষ্যকারের ভুমিকায়। এরপরই ‘সাত হিন্দুস্তানি’ ছবিতে প্রথম স্ক্রিনে আসার সুযোগ। ১৯৭১ সালে মুক্তি পায় বিখ্যাত ছবি ‘আনন্দ’। সে সময় বলিউডের সুপারস্টার রাজেশ খান্নার সঙ্গে প্রথম স্ক্রিন শেয়ার করা। এ ছবির পরে আর পেছনে তাকাতে হয়নি তার। ‘আনন্দ’ ছবিতে এক চিকিৎসকের ভুমিকায় অভিনয় করে ছিনিয়ে নেন ফিল্মফেয়ার সেরা সাপোর্টিং অভিনেতার অ্যাওয়ার্ড।

অনেকে বলেন ‘আনন্দ’ ছবি থেকেই ধ্বংসের মুখে পড়েন রাজেশ খান্না আর তার একমাত্র কারণ নাকি ছয় ফুট লম্বা, রোগা এই মানুষটি! কেননা, সেই ছবি থেকেই রাজেশের পতন শুরু আর অমিতাভের উত্থান।

১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘জাঞ্জির’ ছবিতে এক কড়া পুলিশ অফিসারের ভুমিকায় দেখা যায় তাকে। এই ছবির পরেই তাকে বলিউডের ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যানে’র তকমা দেন অনেকে। সে বছরই জয়া ভাদুড়িকে বিয়ে করেন অমিতাভ। বিয়ের এক মাস পরেই এই নবদম্পতির ছবি ‘অভিমান’ আবার সুপারহিট। ‘নমক হারাম’ ছবিতে ফের রাজেশ খান্নার সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেন অমিতাভ। ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘দিওয়ার’-এ অভিনয় করে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান। এ ছবির সেই বিখ্যাত সংলাপ ‘মেরে পাস মা হ্যায়’ আজও সবার মুখে মুখে। একই সালে মুক্তি পায় ‘শোলে’। এই ছবিটি সে সময়ের ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে বড় ছবি হয়ে দাঁড়ায়। তারপর কেবল ইতিহাসই রচনা করে চলেছেন অমিতাভ।

২০১৩ সালে হলিউডের ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবাই’ ছবিতে একটি ছোট্ট ভুমিকায় অভিনেতা লিওনার্দো দ্য কাপ্রিওর সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেন বিগ-বি। শুধু ফিল্ম নয় টেলিভিশনের জগতেও অমিতাভের আসা-যাওয়া রয়েছে। ২০০০ সাল থেকে টেলিভিশনের সবচেয়ে সফল টেলিশো ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’। মাঝে একটি সিজনে শাহরুখ খানকে নিয়ে আসা হলেও ফের অমিতাভকেই হাল ধরতে হয় এই শোটির। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে এই শোয়ের একমাত্র ইউএসপি অমিতাভ বচ্চন। সম্প্রতি তিনি শুরু করেছেন ‘আজ কি রাত হ্যায় জিন্দেগি’ নামের আরেকটি টিভি অনুষ্ঠান। যার প্রিমিয়ার চমক হয়ে এসেছিল ৭৩তম জন্মদিনে। এরই মধ্যে অনুষ্ঠান দিয়ে ব্যাপক আলোচনায় অমিতাভ।

নিজের কর্মজীবনে তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বারোটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কারসহ অজস্র গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ফিল্মফেয়ারের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কারের বিভাগে তিনি সর্বাধিক মনোনয়ন পাওয়ার রেকর্ড করেছেন।

অভিনয় ছাড়াও তাকে নেপথ্য গায়ক, চলচ্চিত্র প্রযোজক, টেলিভিশন সঞ্চালক এবং ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত ভারতীয় সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবেও দেখা গেছে।

সব মিলিয়ে তিনি এখন হয়ে উঠেছেন ইতিহাসপুরুষ। ‘কুলি’র দুর্ঘটনা তো বটেই, এই সে দিনও তার অসুস্থতার খবর পেয়ে কালীঘাটে যে যজ্ঞ হলো, সে কি শুধু একজন অভিনেতার জন্য? তার বাড়ির সামনে সপ্তাহের একটা দিন যে গুণগ্রাহীর ভিড় এই এতগুলো বছরেও বিন্দুমাত্র ফিকে হলো না, সে শুধু ওই অভিনেতার জন্য হতে পারেন। এই এতখানি আবেগ তুলে রাখা সময়ের ভরকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুরুষের জন্য, যাকে দেখে বিশ্বাস করা যায় যে সময়ের চাকাটি তিনি নিজের হাতে বদলে দিতে পারেন। অভিনেতা তো অনেকে হন, নায়ক সবাই নন। আবার নায়ক যারা হন, তাদের সবাই অমিতাভ বচ্চন হতে পারেন না।

ইতিহাসের কৃপা যিনি পান, তিনি যদি পরিশ্রমী হন, তিনি যদি সাধনার মর্ম বোঝেন, তবে সেই ফলাফলের নাম নিশ্চিতই অমিতাভ বচ্চন। ‘জাঞ্জির’ থেকে ‘পিকু’ তিনি এমন এক চলমান প্রকল্প সিনে ইতিহাস আজও যার ওপর চোখ বুজে ভরসা করতে পারে। কারণ এই ভরসা শুধু তার ওপরই রাখা যায়। তিনি যে ৭৩-এ দাঁড়িয়েও যুবকের মতো দাপুটে।

সর্বশেষ খবর