শনিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

পথ ও মঞ্চ নাটকে মুক্তিযুদ্ধ

মোস্তফা মতিহার

পথ ও মঞ্চ নাটকে মুক্তিযুদ্ধ

বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে পথনাটক ও মঞ্চনাটকের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। মঞ্চে নাটকের পাশাপাশি পথে পথে নাটক প্রদর্শন করে নাট্যকর্মীরা মুক্তিকামী জনতার চেতনাকে উজ্জীবিত ও উদ্দীপ্ত করেছিলেন দারুণভাবে। ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকেই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নাটকের মাধ্যমে মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে পড়েন নাট্যকর্মীরা। ১৯৭১-এর আগেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তির আন্দোলনে এগিয়ে যান নাট্যকর্মীরা। স্বাধীনতা অর্জনের পরও মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে এগিয়ে যায় নাটক। আর সেই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে এখন পর্যন্ত  অর্ধশতাধিক নাটক রচিত হয়েছে। যুদ্ধকালীন এসব নাটক মুক্তির স্বপ্নে বিভোর বাঙালিদের  উজ্জীবিত করেছে। সৈয়দ শামসুল হক, সাঈদ আহমেদ, আল মনসুর, রণেশ দাসগুপ্ত, পংকজ বিভাস, এস এম সোলায়মান, জিয়া হায়দার, আলাউদ্দিন আল আজাদ, নিলীমা ইব্রাহীম, নুরুল আম্বিয়া, কল্যাণ মিত্র, সেলিম আল দীন, আবদুল্লাহ আল মামুন, মান্নান হীরা, মামুনুর রশীদ, ড. ইনামুল হক, নাসির উদ্দীন ইউসুফ প্রমুখরা মুক্তিযুদ্ধকে নাটকে তুলে ধরেছেন শৈল্পিক সুষমায়। সৈয়দ শামসুল হকের কাব্য নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’ ও ‘এখানে এখন’ এদেশের মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে এক প্রামাণ্য দলিল। মঞ্চনাটকের পাশাপাশি পথনাটকেও মুক্তিযুদ্ধকে তুলে এনেছিলেন নাট্যকর্মীরা। মুক্তিযুদ্ধ ও প্রতিবাদী নাটকের ক্ষেত্রে মান্নান হীরা রচিত ‘লালজমিন’, মামুনুর রশিদের ‘টার্গেট প্লাটুন’ ও ‘ভঙ্গবঙ্গ’, বাবুল বিশ্বাসের ‘পোড়ামাটি’ নাটকটি দেশপ্রেমে উজ্জীবিত নাটকের দর্শকদের চেতনাকে নতুন করে শাণিত করেছে।

মুক্তিযুদ্ধে নাটকের ভূমিকা নিয়ে বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘তখন মঞ্চে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন হতো না। পথনাটকের মধ্য দিয়েই নাট্যকর্মীরা মুক্তিকামীদের উজ্জীবিত করেছিলেন। এ ছাড়া শরণার্থী শিবিরের জন্য তহবিল গঠনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ক্যাম্পে নাটক মঞ্চায়ন হতো। ১৯৫৩ সালে মুনীর চৌধুরী ‘কবর’ নাটকটি লিখেছিলেন। ওই নাটকটি তো এদেশের মুক্তিকামীদের পক্ষেই কথা বলেছিল। পথে পথে, ট্রাকে করে নাটক করে নাট্যকর্মীরা এদেশের মানুষের মনে মুক্তির চেতনার বীজ বপন করেছিলেন।’

নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নাটক হতো বেশি। মঞ্চে তখন নাটক করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তবে পথনাটক হতো। এসব নাটক অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।’

একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্যজন কেরামত মওলা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় মঞ্চে কোনো নাটক করতে পারতাম না। তবে মুক্তিযুদ্ধের আগের সময়টাতে নাটকের মাধ্যমে আমরা জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করেছিলাম। তত্কালীন পাকিস্তান টেলিভিশন অর্থাৎ বর্তমানের বিটিভিতে নাটক করেছি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে। মুস্তাফা মনোয়ার, আবদুল্লাহ আল মামুনসহ আমরা তখন টেলিভিশন নাটকের মাধ্যমে মানুষের চেতনা জাগিয়েছিলাম। আর মুক্তিযুদ্ধের পরের সময়টাতে মঞ্চনাটকের মাধ্যমে আমরা মুুক্তির খণ্ডচিত্র তুলে ধরেছি’।

আতাউর রহমান বলেন, ‘স্বাধীনতার বহু আগ থেকেই নাটকের মাধ্যমে আমরা জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করতাম। সরাসরি স্বাধীনতার কথা না বলে আমরা স্বাধিকারের কথাটা সরাসরি বলতাম। তখন সারা দেশের কলেজগুলোতে নাটক হতো। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক করতাম। মুক্তিযুদ্ধকালীন কলকাতার শরণার্থী শিবিরে মামুনুর রশীদ ‘পশ্চিমের সিঁড়ি’ নাটকটি করেছিলেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে যখন পাকিস্তানিরা রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করে তখন থেকেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে ঝলসে উঠি। মূলত ‘কবর’ নাটকটিই স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল কাঠামো দাঁড় করিয়ে দেয়।’

পথনাটক পরিষদের সভাপতি মান্নান হীরা বলেন, ‘নাট্যকর্মীরা অনেক আগ থেকেই একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন করে আসছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে সেই আন্দোলনটা আরও বেশি জোরদার হয়। শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশেই পথনাটক হতো ওই সময়ে। পথনাটকে আমরা সরাসরি স্বাধীনতার কথা না বলে মুক্তির কথাটা সরাসরি বলতাম। ওই সময়ে বিভিন্ন সভা, সমাবেশে ছোট ছোট নাটিকাও করতাম আমরা।  সৈয়দ হাসান ইমাম, কামাল লোহানী, মামুনুর রশীদ, মমতাজউদ্দিন আহমদসহ পথনাটকের মাধ্যমে তখন মানুষের মনে চেতনা জাগিয়ে তুলতেন। মমতাজউদ্দিন আহমদের ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ পথনাটকটির মধ্য দিয়ে তখন মুক্তিকামীদের মনে আলোড়ন তুলেছিলেন।’

সর্বশেষ খবর