সোমবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধের দলিল ‘স্টপ জেনোসাইড’

আলাউদ্দীন মাজিদ

মুক্তিযুদ্ধের দলিল ‘স্টপ জেনোসাইড’

জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’-এর একটি দৃশ্য

বাঙালির গণহত্যা কেমন হতে পারত, কেমন হতে পারে আর কেমনইবা হয়েছিল তার সচিত্র প্রাতিবেদন জহির রায়হানের তথ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সূচনা এসে পরিণতি পায় ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধে সংগ্রামী মানুষের প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের আগেই এই নির্মাতা নির্মাণ করেন ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রটি। এর মাধ্যমে তিনি দেশ প্রেমের বীজ বুনে দেন। জহির রায়হানের হাতের নির্মল ছোঁয়ায় যুদ্ধের বাস্তব চিত্রায়ণ দেখতে বাঙালি জাতির বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ‘জীবন থেকে নেয়া’র রেশ না কাটতেই যুদ্ধ, গণহত্যা, বীভত্সতা নিয়ে তিনি নির্মাণ করেন ‘স্টপ জেনোসাইড’।

মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্মিত সবচেয়ে আলোচিত এবং প্রশংসিত তথ্যচিত্র হচ্ছে ‘স্টপ জেনোসাইড’। ১৯ মিনিটের এই তথ্যচিত্রটি পাকবাহিনীর গণহত্যার তাত্ক্ষণিক ফুটেজ। স্বল্প পরিসরে নির্মিত অপূর্ব এক তীব্র প্রতিবাদ। চিত্রনাট্যে জহির রায়হানের সঙ্গী ছিলেন আরেক অসাধারণ নির্মাতা আলমগীর কবির (সূর্য্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে, ধীরে বহে মেঘনা ইত্যাদির নির্মাতা)। আলমগীর কবির ইংরেজি ধারাবিবরণী লিখেছেন এবং কণ্ঠ দিয়েছেন এতে। আর ক্যামেরায় ছিলেন অরুণ রায়।

শুরুতে দেখা যায় গ্রামের এক হাসিখুশি চপল কিশোরী ঢেঁকিতে ধান ভানছে। তার আগে লেনিনের কিছু উদ্ধৃতি শোনা যায় নেপথ্যে। দৃশ্য বদলে যায় গুলির শব্দ আর গগনবিদারী আর্ত চিত্কারে। চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। এরপর এক নারকীয় দৃশ্য। শুধু লাশ আর লাশ। চোখ উপড়ানো, মাথার খুলি উড়ে যাওয়া, মগজ বেরিয়ে আসা গুলিবিদ্ধ সারিসারি লাশ। সাউন্ডট্র্যাকে ব্রাশফায়ারের শব্দ। এরপর একটি প্রাচীর ধসে পড়ে আর পর্দায় ভেসে ওঠে ‘স্টপ জেনোসাইড’ লেখাটি।

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘৃণিত চিত্র তুলে ধরেছেন জহির রায়হান তার স্টপ জেনোসাইডে। মাত্র তিনটি দৃশ্য দিয়ে সাজানো এই তথ্যচিত্রটি। প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় জাতিসংঘের সদর দফতর। সুশীল আলোচনা হচ্ছে সেখানে, গত্বাঁধা ভালো কথা। পরের দৃশ্য ভিয়েতনামে মার্কিন বি-৫২ বোমারু বিমানের গোলাবর্ষণ। নারী-পুরুষ-শিশুদের গণহত্যা। যুদ্ধাপরাধে বিচারাধীন এক মার্কিন লেফটেন্যান্টের পক্ষে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাফাই। পরের দৃশ্যে সেই বাংলাদেশ। লাশের স্তূপ আর হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য। নেপথ্যে শোনা যায় জাতিসংঘের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘোষণা— তবে কি কেবল পরিহাস? মুক্তিযুদ্ধের এই ক্লাসিক ডকুমেন্টারিটি একাধিক পুরস্কার জিতেছে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উত্সবে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেওয়া ছিল জহির রায়হানের এই অনবদ্য সৃষ্টি।

ইয়াহিয়া সরকার যুদ্ধের সময় একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল আওয়ামী লীগ বাঙালিদের কনভিন্স করে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালাচ্ছে। তাদের

শিকার বিহারি এবং অন্যান্য উর্দুভাষী সম্প্রদায়। তাদের নির্বিচার গণহত্যা ঠেকাতেই সেনাবাহিনী নাক গলাতে বাধ্য হয়েছে। প্রতিবাদে এক সাক্ষাত্কারে জহির রায়হান প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় জানিয়েছেন কীভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মুভি ক্যামেরা দিয়ে নিজেদের হত্যাকাণ্ডের ছবি তুলে, বিহারিদের দিয়ে লুটপাট করিয়ে তা এডিট করে বাঙালিদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সফল তথ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাঙালির সবচেয়ে গৌরব আর বেদনাগাথা ইতিহাস হয়ে থাকবে চিরদিন চিরকাল।

সর্বশেষ খবর