মঙ্গলবার, ১০ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

মান হারাচ্ছে গানের কথা

কথা, সুর, তাল, লয় মিলে গান। গান হচ্ছে প্রাণের খোরাক। সফল গানের পূর্বশর্ত হলো কথার কাব্যময়তা। যা এখন নেই। এখনকার গানে প্রাণের অভাব। গীতিকবিতা আর হূদয়ে ছবি আঁকছে না। এর নেপথ্য কারণ সম্পর্কে বলেছেন কয়েকজন সংগীতকার।তাদের বলা কথা তুলে ধরেছেন— আলাউদ্দীন মাজিদ

 

আমজাদ হোসেন

এখন গানের মৌলিকত্ব দুঃখজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এখনকার গান আর শ্রোতাদের মনে স্থায়ী হতে পারছে না। এর অনেক কারণ রয়েছে। অন্যতম হচ্ছে যোগ্য গীতিকার ও সুরকারের অভাব। গানের কথা ও সুরে এখন মেলোডি এবং জীবনবোধের অভাব, গভীরতা নেই। শ্রোতারা এসব গান গ্রহণ করবে কেন? এখন তো কোনো অ্যাকোয়িস্টিক ব্যবহার করা হয় না। এখন সবই কি বোর্ড নির্ভর হয়ে পড়েছে। এখন যে কেউ ইচ্ছা করলেই গান লিখে ফেলতে পারছে। ভেবে দেখে না তাতে ব্যাকরণের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কি না। মানে গান লেখা, সুর করা এবং কণ্ঠ দেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। চাইলেই যে কেউ তা করতে পারছে। তাই গান এখন প্রাণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, কোনো কিছু সহজলভ্য হয়ে গেলে তার মান আর থাকে না।

 

কে জি মোস্তফা

গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কাব্যময়তা ও মেলোডি। আগে গান লিখতে অনেক পড়ালেখা করতে হতো। যারা সাহিত্যচর্চা করত তারাই গান, গল্প লিখত। এখন ইচ্ছা করলেই কিছু না জেনেই যে কেউ গীতিকার-গল্পকার হয়ে যাচ্ছে।  সাহিত্য নির্ভরতা বাদ দিয়ে বাণিজ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। আগে গানের কথায় জীবনের ছায়া খুঁজে পাওয়া যেত। এখন তো গান মানে ফান। শুধুই মজা করার জন্য গান তৈরি হয়। তাই শুরুতেই শেষ হয়ে যায় এসব গান। এখন গানের ক্ষেত্রে যন্ত্রই প্রধান যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে গানের কথা থেকে শিক্ষা নেওয়া হতো। এখনকার গানে মেলোডি, কাব্যময়তা, জীবনবোধ, শিক্ষা এবং গভীরতা বলতে কিছুই নেই। গান লেখা এবং করা বর্তমানে এতটাই সহজ হয়ে গেছে যে, সহজে তা হারিয়েও যাচ্ছে।

 

গাজী মাজহারুল আনোয়ার

গানের সুদিন অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। এখন গানের কথায় প্রাণ নেই। কবিতা একটি শিল্প। এতে সুর আর কণ্ঠ দিলে গান হয়। গীতিকবিতা হচ্ছে গানের আত্মা। বর্তমানে তথাকথিত আধুনিকতার জোয়ারে গানের কথা বা কবিতা চাপা পড়ে যাচ্ছে। এখন আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে।

এটি খারাপ নয়। কিন্তু যন্ত্রের মতো গানকে যান্ত্রিক করা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সুরকে ছাপিয়ে যন্ত্র যদি মুখ্য হয়ে উঠে তা হলে গানের অপমৃত্যু ঘটে। সীমা অতিক্রম করতে গিয়ে গানে আর প্রাণের ছোঁয়া খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের সমৃদ্ধ সংগীতশিল্প এখন তথাকথিত আধুনিকতার ছোঁয়ায় ক্রমেই বিবর্ণ হচ্ছে। এখন লেখা, সুর দেওয়া

আর গাওয়া যার যার মতো করে চলছে। চাইলেই সব সম্ভব হচ্ছে। গানের স্থায়িত্ব বা মান বলে কিছুই থাকছে না।

 

শহীদুল্লাহ ফরায়েজী

পরিবর্তনশীল রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার কারণে সংগীতের পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু ঐতিহ্য হারাতে পারে না। এই ঐতিহ্য নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। কারণ, সংগীতেই সংগীতের প্রাণ আর ঐতিহ্য নিহিত। স্টাইলে পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু নিত্যনতুন হূদয় অনুসন্ধান করে অনাবিষ্কৃত সৌন্দর্য আবিষ্কার করাই মানুষের ধর্ম। এই পরিবর্তনে হতাশার কিছু নেই। তবে পরিবর্তনে মৌলিকত্ব হারালেই অপমৃত্যু ঘটে। জীবনবোধকে ভিতরে লালন করতে হয়। জীবনের প্রাচুর্য এবং মহামহিমান্বিত দিককে অনুসন্ধান করতে হয়। সত্যের কাছে অবস্থান করলে গানের মাঝে প্রাণের ছোঁয়া আসবে। যে গানে জীবনের নৈতিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে না, পরম সুন্দরের দিকে ধাবিত হওয়ার শক্তি দেয় না, আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার ক্ষমতা দেয় না সেই গান অবশ্যই হারিয়ে যাবে।

 

খুরশীদ আলম

গান হচ্ছে গুরুমুখী বিদ্যা। সাধনার বিষয়। এখন গুরুর কাছেও কেউ দীক্ষা নেয় না। সাধনাও করে না। গান প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। আগে একটি গান তুলতে কয়েক মাস সময় লেগে যেত। কথা, সুর, গায়কী নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতো। এখন মুহূর্তে লেখা থেকে শুরু করে এক বসাতেই গেয়ে ফেলা হচ্ছে। এসব গান আর প্রাণ ছুঁতে পারছে না। মানে আঁতুড়ঘরেই মৃত্যু হচ্ছে। এখন যে ভালো গান একেবারেই হচ্ছে না তা কিন্তু নয়, তবে পরিমাণ নিতান্তই স্বল্প। এই স্বল্পতা দিয়ে এ দেশের ঐতিহ্য হিসেবে সংগীতকে ধরে রাখা যাবে না। গীতিকবিতার দুর্দিন চলছে। এতে গানের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হচ্ছে। একসময় চলচ্চিত্রে গল্পের প্রয়োজনে গান হতো। আর এখন গানের প্রয়োজনে চলচ্চিত্র হয়। এ অবস্থার জন্যই চলচ্চিত্রের গানের অবস্থা নাকাল হয়ে পড়েছে। উত্তরণে গুরুর দীক্ষা আর সাধনা জরুরি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর