মঙ্গলবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

‘অভিনয় না করতে তিন হাজার টাকা চেয়েছিলাম’

আলাউদ্দিন মাজিদ

‘অভিনয় না করতে তিন হাজার টাকা চেয়েছিলাম’

প্রখ্যাত অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানের বয়স এখন পঁচাত্তরের ঘরে। বয়স তাকে ছুঁতে পারেনি। এখনো সদ্য যুবকের মতো ক্লান্তিহীনভাবে দাঁড়িয়ে যান তিনি ক্যামেরার সামনে। নিরলসভাবে অভিনয় করে চলেন সকাল-সন্ধ্যা। চলচ্চিত্র নির্মাণ কমে গেছে। তাই বড় পর্দার চেয়ে ছোট পর্দাতেই এখন বেশি খুঁজে পাওয়া যায় তাকে। থাকেন পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের দেবেন্দ্রদাশ লেনে। বই পড়া, লেখালেখি আর টিভি দেখে কাটে অবসর সময়।

সত্তর থেকে বর্তমান পর্যন্ত টানা পাঁচ দশকে তার বিপুল জনপ্রিয়তায় একটুও ভাটা পড়েনি। দর্শক বড় কিংবা ছোট পর্দায় তার সাবলীল অভিনয় দেখতে এখনো আগ্রহ নিয়ে মুখিয়ে থাকে। চলচ্চিত্রে খল ভূমিকায় অভিনয় করেই আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পান তিনি।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ ছবিতে মোড়ল চরিত্রে তার দুর্ধর্ষ অভিনয় এখনো দর্শক ভুলতে পারেনি। এই ছবিতে তার দুর্দান্ত অভিনয় এখনো সবার মনে জ্বলজ্বলে হয়ে আছে। ছবিটিতে অভিনয়ের স্মৃতি কথা জানাতে গিয়ে এই শক্তিমান অভিনেতা মজা করে বলেন, এই মন্দ মানুষ চরিত্রটি আমাকে এতটা জনপ্রিয় করে দেবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। স্মৃতির ঝুলি হাতড়ে তিনি অবতারণা করেন সেই মজার স্মৃতিকথার।

এটিএম শামসুজ্জামান বলেন, ১৯৭৬ সাল। আমি তখন টুকটাক অভিনয় করলেও পুরোদমে সহকারী পরিচালক। একদিন চলচ্চিত্র প্রযোজক আহসানউল্লাহ মনির অফিসে বসে আড্ডা দিচ্ছি। তিনি ‘সিনেমা’ নামে একটি চলচ্চিত্র পত্রিকা বের করতেন। তাতে দেখি আমজাদ হোসেনের একটি উপন্যাস ছাপা হয়েছে। নাম ‘নিরক্ষর স্বর্গে’। পড়লাম, খুব ভালো লাগল। মনে হলো এই উপন্যাস দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করলে ভালো হবে। দর্শক দেখবে। আহসানউল্লাহ মনিকে বললাম ‘উপন্যাসটিতে ফিল্মি ফ্লেভার আছে। আপনি এটি প্রযোজনা করলে ছবিটি নির্মাণ করতে পারি।’ তিনি এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। সেখানে চলচ্চিত্র পরিচালক নূরুল হক বাচ্চুও উপস্থিত ছিলেন। ঠিক করলাম আমরা দুজন মিলে ছবিটি নির্মাণ করব। পরে সেখানে আমজাদ হোসেন এলেন। তিনি জানান, তিনিই ছবিটি পরিচালনা করবেন।

একদিন ওই ছবির ক্যামেরাম্যান রফিকুল বারী চৌধুরী এসে আমাকে বললেন, আমজাদ হোসেন আপনাকে ডেকেছেন। আমি বুঝলাম ছবিটিতে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমজাদ হোসেন বললেন, সহকারী নয়, তোমাকে এতে অভিনয় করতে হবে। আর এই গল্পের মূল চরিত্র ‘মোড়ল’ তোমার জন্য। শুনে তো আমার আক্কেল গুড়ুম। বলে কী, আমাকে কেউ চিনে না। আমি ছবির অ্যাসিস্ট করি আর আমাকে বলছে এমন প্রধান গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয় করতে। আমি আমজাদ ভাইকে বললাম—‘না ভাই আমি অভিনয় করতে পারব না। এই চরিত্রে যদি কাজ করি তাহলে ছবিটি কেউ দেখবে না। কারণ আমাকে কেউ চিনে না।’ আমজাদ ভাই আমার কোনো কথা শুনলেন না। নাছোড় বান্দার মতো তার এক কথা। এই চরিত্রে তোমাকেই অভিনয় করতে হবে। মহা বিপদে পড়লাম। ভাবছি কী করে উদ্ধার পাওয়া যায়। মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। তখন অভিনেতা আনোয়ার হোসেন অভিনয়ের জন্য ছবি প্রতি তিন হাজার টাকা করে পারিশ্রমিক নিতেন। নয়নমণি ছবিতেও তাই। আমি জানি এই অঙ্কের পারিশ্রমিক চাইলে আমজাদ ভাই আমাকে আর ছবিতে নেবেন না। তাই বললাম, ‘হ্যাঁ, নয়নমণিতে কাজ করতে রাজি আছি, তবে পারিশ্রমিক তিন হাজার টাকাই দিতে হবে।’ আমজাদ ভাই কিছুক্ষণ বিষণ্ন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন—‘তাই হবে’। মানে বিপদ থেকে আর উদ্ধার পাওয়া হলো না আমার।

মানিকগঞ্জে ছবির শুটিং শুরু হলো।  মেকাপম্যান আমার মুখে দাড়ি আর একটা আঁচিল লাগিয়ে দিয়ে বললেন, মুখের আঁচিলটা যত্ন করে রেখ পুরো ছবিতে ব্যবহার করতে হবে। দাড়ি টুপি আর আঁচিল লাগিয়ে মন্দ মানুষ মোড়ল হয়ে গেলাম। আমজাদ ভাই ক্যামেরার সামনে যা করতে বললেন তাই করে গেলাম। কী করছি না করছি কিছুই বুঝতে পারলাম না। সুযোগ পেলে তাকে বলি, ভাই কী যে করলেন, ছবিটিও ডুববে আমিও শেষ হব।

আমজাদ ভাই শুধু মুচকি হাসতেন। ছবিটি রিলিজ হলে ভয়টা আরও বেড়ে গেল। রিলিজের দুই তিন দিনের মাথায় ভয়ে ভয়ে আমজাদ ভাইয়ের কাছে গেলাম। তিনি তো চেচিয়ে বলে উঠলেন— ‘আরে ছবিতো সুপারহিট। সেই সঙ্গে তোমাকেও দর্শক বিপুলভাবে গ্রহণ করেছে। পরে দেখলাম চরিত্রটা দর্শক এতটাই গ্রহণ করেছে যে নির্মাতারা আমাকে এমন চরিত্রেই কাস্ট করা শুরু করলেন। এই ছবির জনপ্রিয়তায় আমি রীতিমতো দর্শকপ্রিয় খলনায়ক এটিএম শামসুজ্জামান হয়ে গেলাম।’

সর্বশেষ খবর