রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

‘ডুব’ নিয়ে হৈচৈ

রণক ইকরাম

‘ডুব’ নিয়ে হৈচৈ

যৌথ প্রযোজনার ব্যয়বহুল চলচ্চিত্র ‘ডুব’। নির্মাণ শেষে মুক্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ছবির পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় ও প্রযোজনায় অভিষেক ঘটার কথা ভারতীয় তারকা ইরফান খানের। কিন্তু বৃহস্পতিবার তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে থমকে গেছে চলচ্চিত্রটির যাত্রা। এর আগে অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন হুমায়ূন আহমেদের জীবনের কিছু ঘটনাকে ভুলভাবে উপস্থাপনের আশঙ্কা জানিয়ে সেন্সর বোর্ডকে চিঠি দিয়েছিলেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের এই স্থগিতাদেশ মানে পরবর্তী আদেশ পাওয়ার আগে এখন আর ছবিটি সেন্সর বোর্ডেও জমা দেওয়া যাবে না। এমনটি জানানোর পর পরিচালকের আশাবাদ সরকার দ্রুতই এটি প্রত্যাহার করবে।

 

‘এই নিষেধাজ্ঞা স্থায়ী কিছু নয়’

------মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

‘ডুব’ আটকে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছে ভারতসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। বিষয়টি আমাদের চলচ্চিত্রে কীভাবে প্রভাব রাখবে?

গত পাঁচ বছর ধরে বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে বারবার পজিটিভ খবর বেরিয়েছে। এবারই প্রথম নেগ্যাটিভলি কোনো খবর বের হলো। এটা অবশ্যই আমাদের দেশ ও চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির জন্য ঋণাত্মক ইমেজ তৈরি করবে। তার চেয়ে বড় কথা, ছবিটি আন্তর্জাতিক প্রোডাকশন, কেবলই দেশি কিছু নয়।

একবার এনওসি দিয়ে আবার সেটা রহিত করা হলো। এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?

আমাকে কোনো কারণ দর্শানো হয়নি। এরপরও আমি যেটা মনে করি, যে বা যারা এটি করিয়েছে তারা সরকারের ভিতরের কোনো একটি নির্দিষ্ট অংশকে ভুল বুঝিয়েছে। ব্যাপারটা পরিকল্পিত। কারণ প্রথমে এনওসি দেওয়া হলো। পরে আবার তথ্য মন্ত্রণালয় সেটা স্থগিত করল। এর অর্থ হলো এখন আর সেন্সরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আবার সেন্সর বোর্ডেরও করার কিছু নেই। সেন্সরে ছবি আটকাতে চাইলে সেটাকে ব্যান করতে হতো। তাই এমন নিষেধাজ্ঞা। অনেক ক্ষেত্রেই এরকম স্থগিতাদেশে দিনের পর দিন কেটে গেছে।

আপনি কি মনে করেন ছবিটির আটকে যাওয়ার পেছনে অভিনেত্রী ও নির্মাতা মেহের আফরোজ শাওনের চিঠির কোনো ভূমিকা আছে?

আমি ঠিক জানি না তার চিঠির কোনো ভূমিকা আছে কিনা। তবে আমি বলব, এই সিনেমার স্থগিতাদেশ প্রক্রিয়াটি মোটেও স্বাভাবিক নয়। স্বাভাবিকভাবে কিন্তু এনওসি দেওয়া হয়েছিল। পরে সেটা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্থগিত করা অস্বাভাবিক নয় কি?

এই খবরে ছবির সহ-প্রযোজক এবং অভিনেতা ইরফান খানের  প্রতিক্রিয়া কী?

তিনি হতবাক এবং মর্মাহত হয়েছেন। তার ভাষ্য হচ্ছে, এমন একটি নির্দোষ চিত্রনাট্য যেখানে কেবল নর-নারীর মানবিক সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে সেটা কেন আটকে যাবে?

একই প্রশ্ন আবার। ছবির গল্প কি আসলেই হুমায়ূন আহমেদের জীবনীভিত্তিক?

আমি বারবার বলেছি আমি কোনো বায়োপিক বানাচ্ছি না। আমার গল্পটা জাভেদ হাসানের। প্রতিটা গল্পই কোনো না কোনো জীবনের গল্প থেকে ইন্সপায়ার্ড। হয়তো এই গল্পটাও অসংখ্য মানুষের সঙ্গে মিলে যাবে এটাই স্বাভাবিক। এর বাইরে আমি কেবল মানুষের গল্পই বলতে চেয়েছি।

আইনি জটিলতা এবং সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রত্যাশা...

আমরা যদি একটি গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করতে চাই তাহলে ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনের কোনো বিকল্প নেই। আমার ছবিতে অশালীন-অশ্লীল কোনো কিছু কিংবা কপিরাইটবিরোধী কিছু নেই। আমি মানুষের জীবনের গল্প বলতে চেয়েছি। তাহলে কী মৌলিক গল্পের চর্চা না করে তামিল সিনেমার কপি বানানোই ভালো? আমি মনে করি, এই নিষেধাজ্ঞা স্থায়ী কিছু নয়। আমার আশা সব প্রতিকূলতা জয় করে শিগগিরই আলোর মুখ দেখবে ডুব।

 

 

আমিও চাই ছবি মুক্তি পাক, কিন্তু...

মেহের আফরোজ শাওন

আমি নিজেও চলচ্চিত্রের মানুষ। আমি কখনোই চাইব না একটি ছবি আটকে যাক। আবার আমি আমার স্বামীর জীবনের কোনো কিছু ভুলভাবে উপস্থাপিত হোক সেটাও চাইতে পারি না। সে কারণেই আমি সেন্সর বোর্ডকে আমার নিজের আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলাম। অনেকে বলছে, এ কারণে ডুব আটকে গেছে। আমি আসলে জানি না এ কারণেই ‘ডুব’ আটকে গেছে কি-না। কারণ আমাকে কেউ কিছু জানায়নি। আমিও সবার মতো ভারতীয় মিডিয়ার নিউজ থেকেই জেনেছি। এখানে একটি ব্যাপার স্পষ্ট যদি ছবিতে হুমায়ূন আহমেদ সংক্রান্ত আপত্তিকর কোনো বিষয় থাকে তাহলে তাদের উচিত সেই অংশটুকু পরিবর্তন পরিমার্জন করে ছবিটি মুক্তি দেওয়া। আর যদি পুরোটাই মিলে যায় তাহলে সে সিদ্ধান্ত সেন্সর বোর্ড নেবে।

 

 

‘ডুব’ নিয়ে হুলস্থূল

আব্দুন নূর তুষার

এটা যদি হুমায়ূন স্যারের জীবনভিত্তিক ছবি হতো তবে আমার ধারণা ফারুকী সেটা দাবি করত। সে যেহেতু বলেনি এবং ছবির কোথাও এরকম কোনো উল্লেখ নেই, তাহলে ধরে নিতে হবে যে এটা ভাবা হচ্ছে যে, এই ছবির কাহিনীর সঙ্গে হুমায়ূন স্যারের জীবনের মিল আছে এটা কিছু মানুষের আবেগজনিত ধারণা। ফারুকী ছবি বানালে তার ভাষা, কাহিনী, গল্প বলার ঢং, লিটনের ফ্ল্যাট বা পিঁপড়াবিদ্যায় মোবাইলে তারকার আপত্তিকর প্রেম দৃশ্য নিয়ে অনেকেই তাকে গালাগাল দেয়। আমি নিজেও ভাষা নিয়ে তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তর্ক করেছি। কিন্তু যৌক্তিকভাবে আমি বিষয়টা মেলাতে পারছি না। প্রথমত, এটা যদি হুমায়ূন স্যারের জীবন হয় তবে ইরফান খান মিসকাস্ট। স্যার ইরফানের মতো সুদর্শন বা ছয় ফিট লম্বা, ফর্সা কোনোটাই ছিলেন না। দ্বিতীয়ত. পার্নো মিত্রও মিসকাস্ট একই কারণে। সেও লম্বা ও রীতিমতো আবেদনময়ী। তৃতীয়ত. প্রাচীও মিসকাস্ট। একই কারণে। এবার আসি কাহিনীতে। কাহিনী আমি জানি না। তবে ধারণা করছি যে ইরফান একজন লেখক এবং সে একজন অপেক্ষাকৃত কমবয়সী মেয়েকে ভালোবাসে ও তার স্বাভাবিক ঘটনা প্রবাহে বিবাহও থাকতে পারে। এরকম প্রেম ও বিবাহ বিখ্যাত লেখক, কবি, অভিনেতা, গানের শিল্পী এমনকি রাজনীতিবিদদের জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা। যেমন বিলি জোয়েল [৬৬]—অ্যালেক্সিজ [৩৩], প্যাট্রিক স্টুয়ার্ট [৭৫]—সানি ওজেল [৩৭], জনি ডেপ [৫২] —অ্যাম্বার হার্ড [২৯], স্টিভ মার্টিন [৭০]—অ্যান স্ট্রিংফিল্ড [৪৩].. এরকম বহু আছে। একটা সিনেমাকে এভাবে গুরুত্ব দেওয়ার ফলে এই সিনেমাটাকে সত্যি সত্যি লোকে ভাবতে শুরু করবে যে এটা হুমায়ূন স্যারের গল্প। যারা এই ছবিটা বন্ধ করার জন্য এভাবে চেষ্টা করছেন তারা ফারুকীর একটা ফিকশনকে বায়োগ্রাফি বানিয়ে দিয়ে স্যারের প্রতি সুবিচার করছেন না। তারা করছেন আবেগ-ভালোবাসা থেকে। কিন্তু যে কোনো লোককে ইরফান খান আর পার্নো মিত্রের ছবি দেখালে তারা বলবে যে তাদের গেটআপ, মেকআপ কোথাও স্যারের সঙ্গে কোনো মিল নেই। যেন কাহিনীতে লেখক আর তার অসমবয়সী প্রেম থাকলেই সেটা হুমায়ূন স্যারের কাহিনী। হুমায়ূন স্যারের জীবন নিয়ে ছবি বানানো অত সোজা নয়। ভারতের কিছু পত্রিকাতে এরকম উটকো সংবাদ ছেপে বিষয়টা জটিল করা হয়েছে। আর একটা বিষয় আছে। ছবিটা না হয় বাংলাদেশে চলল না। ভারতে তো চলবে। আর আজকের যুগে ডিজিটাল দুনিয়ায় কোনো কিছু কি আটকে রাখা যায়। আর এটাকে অনুমতি দিয়ে আবার অনুমতি বাতিল করার অর্থ হলো, যারা অনুমতি দিয়েছিলেন তারা প্রথমে অনুমতি দিয়ে ভুল করেছিলেন অথবা দ্বিতীয়বার সেটা বাতিল করে ভুল করেছেন। যারা কোনো ছবি অনুমতি দিয়ে সেটা ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে বদলে ফেলেন, তাদের ব্যাখ্যাটা জানা দরকার। কে তাদের বোঝাল যে, এক দিন আগে তারা ভুল করে অনুমতি দিয়ে ফেলেছিলেন? এতগুলো লোক ছবি দেখার সময় টেরই পেল না যে এটা এমন বিখ্যাত মানুষের বায়োপিক?

[ঈষৎ সংক্ষেপিত, লেখকের ফেসবুক থেকে]

 

‘ডুব’ নিয়ে কিছু কথা

 তসলিমা নাসরিন

বাংলাদেশে ‘ডুব’ নামের এক চলচ্চিত্রকে সেন্সর বোর্ড নিষিদ্ধ করেছে। নিষিদ্ধ হওয়ার পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা সমালোচনা বিতর্ক হচ্ছে। এ নিশ্চয়ই ভালো লক্ষণ। বিতর্ক হলে মানুষ ভাবার সুযোগ পায়। মত প্রকাশের অধিকার সম্পর্কে নিজে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ঠিক করতে পারে সে কোন দিকে যাবে, বাক-স্বাধীনতার পক্ষে নাকি বিপক্ষে।

 

আমার বই যখন একের পর এক নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ সরকার, তখন কেউ টুঁ শব্দটি করেনি। দেখে এরকমই মনে হয়েছে, আমার মত প্রকাশের অধিকারে কেউ বিশ্বাস করে না। যারা মানুষের মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করে, তারা কিন্তু সবার, শত্রু-মিত্র সবারই মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করে।

 

কী আছে ডুবের গল্পে?

সিনেমা মুক্তির আগে এর গল্প নিয়ে আলোচনা করা কঠিন কাজ। কিন্তু ডুব-এর পাত্র- পাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ সাক্ষাৎকারে গল্প সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। সেই সূত্র ধরে যে গল্প পাওয়া যায় অনেকটা এরকম—

জাভেদ নামকরা একজন লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। দেশে এক নামে তাকে সবাই চেনে এবং তার অগণিত ভক্ত। নিজের চেয়ে বয়সে কম মায়া নামে এক তরুণীকে ভালোবেসে বিয়ে করেন জাভেদ। মায়া পালিয়ে জাভেদকে বিয়ে করায় মায়ার পরিবারে অশান্তি দেখা দেয়। ঘটনা থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। জাভেদ আর মায়ার সুখের সংসার। একসময় তাদের সংসার আলো করে আসে এক মেয়ে ও ছেলে। কলেজে পড়ার সময় মেয়ের এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী প্রায় তাদের বাসায় আসত। একসময় মেয়ের বান্ধবীর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন জাভেদ। ধীরে ধীরে তারা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। এ নিয়ে জাভেদ-মায়ার সংসারে ঝড় ওঠে। ঘটনা প্রথমে টের পায় মেয়ে। সে মাঝে মধ্যে এ নিয়ে রিঅ্যাক্ট করত। বাবার সঙ্গে তুমুল ঝগড়াও হতো তার।

পত্র-পত্রিকা আর প্রচার মাধ্যমে জাভেদকে নিয়ে নানা মুখরোচক লেখালেখি শুরু হয়। মায়া এ নিয়ে জাভেদের কাছে নানা প্রশ্ন তোলেন। ‘মেয়ের বান্ধবীর সঙ্গে তুমি যে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছ এটি কী ঠিক হচ্ছে?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জাভেদ মাঝে মধ্যে মায়াকে নানাভাবে বুঝাতে চায়। বেড়াতে নিয়ে যেতে চায়। শেষ পর্যন্ত মায়া আর জাভেদের সংসারে ভাঙন দেখা দেয়। বিচ্ছেদ হয় দুজনের। মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করেন জাভেদ। মায়া ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার থেকে বেরিয়ে যান। ডিভোর্সের পর মায়া একটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন। নিজেকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার সংগ্রাম শুরু করেন তিনি। জাভেদের নতুন সংসারে একটি ছেলের জন্ম হয়। গল্পের শেষে জাভেদ মারা যান। ধারণা অনুসারে জাভেদ হাসান অর্থাৎ ইরফান খান অভিনয় করেছেন হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রে। এ ছাড়াও মেহের আফরোজ শাওন চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভারতের পার্নো মিত্র, গুলতেকিন খান চরিত্রে রোকেয়া প্রাচী এবং শীলা আহমেদের চরিত্রে তিশা। ছবিটি প্রযোজনা করেছে বাংলাদেশের জাজ মাল্টিমিডিয়া ও কলকাতার এসকে মুভিজ। সহ-প্রযোজক হিসেবে আছেন ইরফান খান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর