শিরোনাম
শুক্রবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
ট্যুরিস্ট ভিসায় চলছে কাজ \ সরকারি রাজস্ব ফাঁকির মহোৎসব

ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই আসছেন বিদেশি শিল্পী

আলাউদ্দীন মাজিদ

ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই আসছেন বিদেশি শিল্পী

ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া বিদেশি শিল্পীদের ঢাকার ছবিতে কাজ করা এখন যেন নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। কয়েক বছর ধরে বিদেশি শিল্পীদের এখানে এভাবে কাজ করার দৌরাত্ম্য উদ্বেগ জনক হারে বেড়েছে। শুধু শিল্পী নয়, টেকনিশিয়ান আর কলা কুশলীরাও ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে এখানে কাজ করে রাজস্ব বঞ্চিত করছে সরকারকে। বিশেষ করে ভারতীয় শিল্পীদের এভাবে বেশি আনা হচ্ছে। ঢাকাই ছবিতে এই অনিয়মে এসেছেন জিৎ, দেব, পাওলি দাম, শুভশ্রী, প্রিয়াঙ্কা, ওম, অঙ্কুশ, ঋত্বিকা, সোহম, শ্রাবন্তী, ইন্দ্রনীলসহ আরও অনেকে। এসেছেন আকাশ সেন, স্যাভি, প্রীতমসহ অনেক গায়ক-গায়িকাও।

সম্প্রতি শামীম আহমেদ রনি পরিচালিত ‘রংবাজ’ ছবির শুটিংয়ে অংশ নিতে ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশে আসেন কলকাতার অভিনেতা রজতাভ দত্ত। ২৫ এপ্রিল পাবনায় তিনি শুটিং করতে গেলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তার কাছে ওয়ার্ক পারমিট না থাকায় নির্মাতাকে নির্দেশ দেন এই অবস্থায় তিনি যেন কাজ না করেন। অভিযোগ পাওয়া গেছে পুলিশের নির্দেশ অমান্য করেই গতকাল ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া আবার কাজ করতে যান রজতাভ দত্ত। এ ব্যাপারে পাবনার এসপির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা ওই ছবির নির্মাতাকে ইতিমধ্যে নিষেধ করেছি যাতে ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কোনো বিদেশি শিল্পী এখানে কাজ না করে। বিষয়টি আবার খতিয়ে দেখছি।

নির্মাতা রনির কথা হলো আমরা ওয়ার্ক পারমিটের জন্য আবেদন করা হয়েছে। শিগগিরই হাতে পেয়ে যাব।

এদিকে বিষয়টি নিয়ে এফডিসির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, নিয়ম হচ্ছে কেউ বিদেশি শিল্পী নিয়ে কাজ করতে চাইলে নির্মাতাকে এফডিসির কাছে ওয়ার্ক পারমিটের জন্য আবেদন করতে হবে। আমরা সেই আবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেই। আবেদন পূরণে সময় লাগে বলে শিডিউল বাঁচাতে নির্মাতারা আগেই কাজ শুরু করে দেন। আর কাজ করতে করতে একসময় ওয়ার্ক পারমিট পেয়ে যান। বলতে গেলে এটিই এখন নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে।

চলতি বছরের শুরুর দিকে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সমিতি ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া বিদেশি শিল্পীদের এখানে কাজের প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে। গতকাল এ বিষয়ে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বেআইনি কাজ কোনোভাবে সহ্য করা হবে না। বিদেশি শিল্পীরা এখানে এসে কাজ করতেই পারে। আর তা হতে হবে সরকারি নিয়মনীতি মেনে। সরকারি ট্যাক্স ফাঁকি দিতে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে কোনো বিদেশি শিল্পীকে এখানে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হবে না। এ ব্যাপারে সব নির্মাতাকে সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। আর এ ক্ষেত্রে সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও সস্তার আশায় টুরিস্ট সাজিয়ে বিদেশিদের এনে দেশের টাকা বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে দেশীয় শিল্পী ও কলাকুশলীদের বেকার করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে মেতেছে অনেকে। এটা আর বরদাস্ত করা হবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এফডিসির আরেক কর্মকর্তা জানান, চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সমিতিগুলোর এ সিদ্ধান্তকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাবে সরকার। এটি আরও আগে হলে ভালো হতো। এতদিন ধরে অবৈধভাবে বিদেশি শিল্পী ও কলাকুশলীদের আনাগোনা সম্পর্কে জেনেও এফডিসি কর্তৃপক্ষ কেন এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ওই কর্মকর্তা।

সম্প্রতি ঢাকার মাহি ও কলকাতার বনিকে নিয়ে ওয়াজেদ আলী সুমন শুরু করেন ‘মনে রেখো’ নামে একটি ছবির কাজ। এ ছবিতে বাংলাদেশি দু-একজন অভিনয়শিল্পী ছাড়া বেশির ভাগ শিল্পী আর কলাকুশলী নেওয়া হয় কলকাতা থেকে। আর তাদের কাছে ওয়ার্ক পারমিট ছিল না। তাই ছবিটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট নানা পেশাজীবী সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘চলচ্চিত্র ঐক্যজোটের’ ক্ষোভ ছিল। তারা বারবার পরিচালক সুমনকে চিঠি দিয়েছেন ও মৌখিকভাবে বলেছেন, দেশি টেকনিশিয়ানকে নিয়ে কাজ করতে এবং বিদেশিদের ক্ষেত্রে ওয়ার্ক পারমিট ব্যবহার করতে। কিন্তু কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করেননি সুমন। শেষ পর্যন্ত ২৯ মার্চ গাজীপুরে গ্রিনটেক রিসোর্টে ‘মনে রেখো’ ছবির শুটিং চলাকালে চলচ্চিত্র ঐক্যজোটের নেতারা উপস্থিত হন। সেখানে পরিচালককে না পেয়ে দায়িত্বে থাকা লোকদের বিদেশিদের ওয়ার্ক পারমিট না দেখানো পর্যন্ত শুটিং বন্ধ রাখতে বলেন এবং পরিচালককে এফডিসিতে উপস্থিত থাকতে বলেন। কিন্তু সুমন হাজির হননি এবং চলচ্চিত্র ঐক্যজোটকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শুটিং চালিয়ে গেছেন।

চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির কর্মকর্তা শাহীন বলেন, এখন থেকে আর কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। দেশীয় চলচ্চিত্রের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের ট্যাক্স রক্ষায় ঢাকাই চলচ্চিত্রের সবাই এক হয়ে কাজ করব। আন্দোলন চলবে এর প্রতিরোধে। তার কথায়—অবৈধভাবে বিদেশি শিল্পী ও কলাকুশলীদের আনাগোনা ঠেকাতে সক্রিয়ভাবে মাঠে থাকবে ঢাকাই ছবির মানুষ। বৈধভাবে যে কোনো দেশের শিল্পীই আসুক সমস্যা নেই। কিন্তু ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। যেখানেই ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া বিদেশি শিল্পীদের শুটিং হবে সেখানেই পুলিশ পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন থেকে কোনো প্রযোজক ও পরিচালক বিদেশি শিল্পীকে নিয়ে কাজ করলে সংশ্লিষ্ট সমিতিতে ওয়ার্ক পারমিট জমা দিয়ে ছাড়পত্র নিতে হবে। এ বিষয়ে সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন সমিতি শিগগিরই বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ ব্যাপারে রাজস্ব বোর্ডের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, আমরা নিয়ম করেছিলাম বিদেশি শিল্পীদের এ দেশে কাজ করাতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও রাজস্ব বোর্ডের অনুমতি নিতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই নিয়ম মানা হচ্ছে না। বিদেশি শিল্পীরা ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে কাজ করে চলে যাচ্ছেন। এটি আইনের লঙ্ঘন। এভাবে চলতে থাকলে বিদেশি শিল্পী চলে গেলেও যে বা যারা তাদের এনেছেন তাদের ওপর ট্যাক্স ও ভ্যাট আরোপ করা হবে এবং টাস্ক ফোর্সের মাধ্যমে তাদের ধরা হবে।

সর্বশেষ খবর