শুক্রবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
সিলেটের সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতি

সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই, চলছে বিকৃতি

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই, চলছে বিকৃতি

বাঁ থেকে— রাধারমণ, শাহ আবদুল করিম, হাসন রাজা ও দুর্বিন শাহ

সংস্কৃতির এক উর্বর ভূমি বৃহত্তর সিলেট। এ এলাকায় জন্ম নিয়েছেন অসংখ্য গুণী বাউল সাধক। সিলেটের লোকভাণ্ডারের বিশাল অংশজুড়ে অবস্থান এসব গানের। কিন্তু ইতিহাসের এই অমূল্য সম্পদগুলো সংরক্ষণে নেই সঠিক কোনো প্রয়াস। চুরি, বিকৃতিসহ নানাভাবে কলুষিত করা হচ্ছে বাউল গান, মরমি গানের।

ইতিহাসের তথ্যানুসারে, মধ্যযুগের শুরু থেকে সিলেট অঞ্চলে জন্ম নিয়েছেন অনেক সুফি-সাধক। ‘বাংলাদেশের লোকসাহিত্য ও লোক-ঐতিহ্য’ বইয়ে ড. আশরাফ সিদ্দিকী উল্লেখ করেন, ‘সিলেট লোকসংস্কৃতির চারণভূমি এবং লোকসংস্কৃতির অফুরন্ত ভাণ্ডার—যার বুকে ধারণ করে এ ভূখণ্ড মননশীল সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতর অবদান রেখে চলেছে যুগ যুগ ধরে।’ ‘শুয়া উড়িল, উড়িল, উড়িল রে’ গানের গীতিকার শীতালং শাহ, ‘নিশিতে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা’ গানের গীতিকার শেখ ভানু, ‘বাউলা কে বানাইল রে’, ‘মাটিরো পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা শাহ আবদুল করিম, ‘নামাজ আমার হইল না আদায়’, ‘নির্জন যমুনার কূলে বসিয়া কদম্ব তলে’, ‘জন্মে জন্মে অপরাধী তোমারই চরণে রে’সহ জনপ্রিয় গানের গীতিকার দুর্বিন শাহ, ‘কারে দেখাব মনের দুঃখ গো আমি বুক চিরিয়া অন্তরে তুসের অনল জ্বলে গইয়া গইয়া’, ‘আমি রব না রব না গৃহে বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না’, ‘পালিতে পালিছিলাম পাখি দুধ-কলা দিয়া, এগো যাইবার কালে বেইমানে পাইখ্যে না চাইলো ফিরিয়া’সহ অনেক জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা রাধারমণ—তারা সবাই সিলেট অঞ্চলেরই সাধক-পুরুষ। সিলেট অঞ্চলের মরমি কবি গিয়াস উদ্দিন আহমদ, সিদ্দিকুর রহমান, সৈয়দ মুফাজ্জিল আলী, বিদিত লাল দাশ এই চার গীতিকারকে একসময় বলা হতো ‘চার রত্ন’। শুধু তারাই নন, রোহী ঠাকুর, অন্নদা রঞ্জন দাশ, ফকির সমছুল, মকদ্দস আলম উদাসী, আবদুর রহমান, রামকানাই দাশ, সুষমা দাশ, চন্দ্রাবতী রায়বর্মণসহ মরমি ও বাউল ভাবধারার অসংখ্য গীতিকার, সুরকার, শিল্পী সিলেট অঞ্চলে জন্ম নিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন দেশীয় লোকসংস্কৃতিকে।

এসব প্রখ্যাত বাউল-সাধক, মরমি-সাধকদের সাধনার সম্পদ সংরক্ষণে সঠিক কোনো প্রয়াস নেই। তাদের গান, সুর সংরক্ষণের অভাবে ক্রমেই হারিয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। এমনকি বর্তমান সময় এসব সাধক-পুরুষের গানের কথা ও সুর বিকৃতি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠছে। এ ছাড়া অনেকেই তাদের গানের কথাকে একটু এদিক-সেদিক করে নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন। লোকসংস্কৃতিতে সিলেট অঞ্চল সমৃদ্ধ হলেও এখানে নেই কোনো লোক জাদুঘর কিংবা সংরক্ষণাগার। এ অঞ্চলের লোক-সাধকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান প্রদর্শনের কোনো তৎপরতাও লক্ষ্য করা যায় না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৃহত্তর সিলেটজুড়ে যে অগুনতি বাউল-সাধক, মরমি-সাধক জন্ম নিয়েছেন, তাদের অমূল্য কীর্তি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই সরকারি পর্যায়ে। এমনকি বাংলা একাডেমিও এ বিষয়ে তেমন তৎপর নয়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু সংকলন আছে, তবে তা কিছুতেই যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন লোকসংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, অনেক প্রবীণ ব্যক্তি আছেন, যাদের কাছ থেকে বাংলার লোকসংস্কৃতির অনেক অজানাকে জানা যাবে। কিন্তু এসব প্রবীণ ব্যক্তির প্রয়াণ হলে সে সুযোগও থাকবে না। সংশ্লিষ্টদের দাবি, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাউল গান, মরমি গান তথা সিলেটের লোকসংস্কৃতিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে লোকসংস্কৃতির গবেষক সুমন কুমার দাশ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পুরো বাংলাদেশের কথা বলার দরকার নেই, শুধু সিলেট অঞ্চলের কথাই যদি বলি, এ অঞ্চল লোকসংস্কৃতির চারণভূমি। এখানে জন্ম নিয়েছেন অসংখ্য সাধক-পুরুষ। কিন্তু তাদের কর্ম সংরক্ষণের সঠিক কোনো উদ্যোগ নেই। এ কাজটি বাংলা একাডেমির করা উচিত। তিনি বলেন, সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় বর্তমানে লোকসংস্কৃতির অনেক গানের কথাই বিকৃত করা হচ্ছে, বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। এখনো সময় আছে, এগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহ-সভাপতি শামসুল আলম সেলিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সংরক্ষণের অভাবে একদিকে লোকসংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ গানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে প্রকৃত কথা ও সুরের বিকৃতি ঘটছে। সিলেটে এখনো অনেক প্রবীণ গুণী শিল্পী আছেন, তাদের দিয়ে জনপ্রিয় গানগুলো রেকর্ড করে আর্কাইভ করা হলে এগুলো রক্ষা পাবে। এক্ষেত্রে সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

সর্বশেষ খবর