মঙ্গলবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
ইন্টারভিউ : মিনা বড়ুয়া

আমাদের এখন আর কেউ ডাকে না

বাংলা গানের এক কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী মিনা বড়ুয়া। গাজীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা এই শিল্পী বাংলা গানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। সিনেমা ও অডিও গান মিলিয়ে তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন আটশরও বেশি গান। গান ও সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে এই গুণী শিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছেন—আলী আফতাব

আমাদের এখন আর কেউ ডাকে না

►   কেমন আছেন?

ভালো আছি। পরিবার ও আমার গান নিয়ে ভালোই আছি।

 

►   এই প্রজন্ম আপনার সম্পর্কে জানে না। গানের শুরুটা কী করে?

আমার মা গান খুব পছন্দ করতেন। আর মামা ছিলেন যাত্রাপালার সঙ্গে যুক্ত। গোপাল সরকার নামের একজন গানের ওস্তাদ ছিলেন যিনি আমার মামার সঙ্গে যাত্রায় সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করতেন। একদিন তিনি আমার গান শুনে অনেক পছন্দ করেন এবং পরিবারের অনুমতিক্রমে তিনি আমাকে গান শিখাতে শুরু করেন।

আমি পরবর্তী সময়ে গাজীপুরের কে এম মুনেম নামের আরও একজন ওস্তাদের কাছে গান শেখা শুরু করি। তিনিই আমাকে রেডিওতে অডিশন দিতে নিয়ে যান। ২০০ প্রতিযোগীর মধ্যে নির্বাচিত হয় দুজন। এর মধ্যে আমি একজন। সংগীতগুরু আবদুল লতিফ স্যারের পরিচালনায় ‘সংগীত শিক্ষার আসর’ শিরোনামের একটি অনুষ্ঠানে আমি গান শেখা শুরু করি।

 

►   শুনেছি এই অনুষ্ঠানে গান শিখতে আপনাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে?

আমাকে প্রতি শুক্রবার গাজীপুর থেকে গিয়ে রেডিও অনুষ্ঠানে যোগদান করতে হতো। একদিন এক শুক্রবার রাত থেকে অনেক বৃষ্টি হয়। রাস্তায় পানি জমে একাকার। আমাদের বাসার সামনে ছিল চিলাই নদী। আমি বাবাকে সঙ্গে নিয়ে মাথার ওপর ডায়েরি নিয়ে নদী পার হই।

প্রতি শুক্রবার নদীর ওপারে আমার জন্য একজন রিকশাওয়ালা দাঁড় করানো থাকত। এই প্রতিকূল আবহাওয়ায় তিনি আমাদের দেখে অবাক হয়ে যান। তারপর তিনি কিছু লতাপাতায় আগুন ধরিয়ে দেন। তাতে আমরা কাপড় শুকিয়ে আমি রেডিওতে যাই। আমরা অনেক কষ্ট করে আজ এখানে এসেছি।

 

►   ওই সময় মেয়েদের লেখাপড়া ও গান শেখাটা তো অনেক কষ্টের ছিল?

হ্যাঁ, ওই সময় পড়াশোনা কিংবা গান করাটা অনেক কষ্টের ছিল। কিন্তু আমার পরিবার থেকে আমি সব সময় এ দুটি বিষয়ে সাহায্য পেয়েছি।  কাপাসিয়ায় আমার স্কুলজীবন শেষ করি। কলেজ ছিল কুমিল্লায়। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে বিএ ও এমএ পাস করি। ১৯৯৮ সালে ইন্ডিয়ার চন্ডিগড় থেকে সংগীতের ওপর চার বছরের একটি ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করি। আমি ‘সংগীত বিশারদ’ হিসেবে স্বীকৃতি পাই।

 

►   আপনি সিনেমায় অনেক গান করেছেন? সিনেমায় আপনার গানের শুরুটা কীভাবে ছিল?

এটা সত্তরের দিকের কথা। খ্যাতিমান সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ রেডিওতে আমার গান শুনে আমার পরিচয় জানতে চান। তখন তিনি আমাকে দিয়ে প্রথম ‘সুয়োরানী দুয়োরানী’ ছবিতে গান করান। তারপর একে একে ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘বাহরাম বাদশা’, ‘নাগ পঞ্চমী’, ‘রঙিন রাখাল বন্ধু’, ‘নরম গরম’, ‘উজান ভাটি’সহ প্রায় ২০টি ছবিতে আমি গান করি।

 

►   অডিও গানের জগতেও আপনার জনপ্রিয়তা ছিল বেশ।

এ নিয়ে কিছু বলুন—

আমি সব সময় মঞ্চে গান করতে পছন্দ করতাম। প্রথমে আমি সব ধরনের গানই গাইতাম। অডিওতে আমার প্রায় ছয়শ’র বেশি গান আছে। তার মধ্যে ‘যা রে যা চিঠি লেইখা দিলাম’, ‘আইলাম আর গেলাম’, ‘বিধি এক পলকের আয়ু’, ‘বুবুর জন্য দুলাভাই’, ‘আমার মন চোরারে কোথা পাই’, ‘আমার হাজার টাকার বাগান খাইল’, ‘অবুঝ কালে যে অন্তরে’ ইত্যাদি।

 

►   আমরা জানি আপনার দুই ছেলেমেয়েও ভালো গান গায়।

আমার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে গৌতম আর মেয়ে গৌরী। আমার দুই ছেলেমেয়ে অনেক ভালো গান করে। কিন্তু তাদের আমি এখনো কোনো প্রতিযোগিতায় পাঠাতে পারিনি। তারা মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে গান করে।

►   এখন আর গান করছে না কেন?

আমার ক্যারিয়ারের শুরু থেকে আমি যেখানে যেখানে গান করেছি, সবাই আমার গান শুনে আমাকে কাজ দিয়েছে। এখন আমাকে কেউ আর ডাকে না, আমিও গান গাই না। মিডিয়াতে লিঙ্ক করে গান আমি কখনো করিনি, এখনো করব না। অনেকে মাঝে মধ্যে ফোন দিয়ে বলে আমি নাকি ঢাকা থাকি না। এসব মিথ্যা সংবাদে আমি কষ্ট পাই।

 

►   নতুনদের গান শোনা হয়। তারা কেমন করছে?

নতুনদের মধ্যে এখন অনেকেই ভালো করছে। আমি শুরুতেই বলেছিলাম আমি মঞ্চে গান করতে ভালোবাসি। কিন্তু এখনকার তরুণ শিল্পীরা মঞ্চে গান থেকে নাচা-নাচি বেশি করে। এখন আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের প্রভাবে মাঝে মধ্যে শিল্পীর কণ্ঠই হারিয়ে যায়। আবার অনেকে পুরনো গানগুলোকে নতুন করতে গিয়ে কথাগুলোকে নষ্ট করে ফেলছে। এটা খুবই কষ্টকর।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর