রবিবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভালো খবর নেই চলচ্চিত্রের জন্য

আলাউদ্দীন মাজিদ

ভালো খবর নেই চলচ্চিত্রের জন্য

নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকেই ঢাকাই চলচ্চিত্রে খরা চলছে। এই খরা এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। চলচ্চিত্রকারদের কথায়, মাঝে-মধ্যে দু-একটি ছবি ব্যবসা সফল হলেও এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকে না। পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাবে নব্বই দশকের শেষ ভাগে দেশে থাকা প্রায় ১৩০০ সিনেমা হল থেকে কমে এখন ২৫০-এর ঘরে এসে ঠেকেছে। চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির তথ্যমতে, চলতি বছরে গত ২ নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে ৪৫টি ছবি। চলচ্চিত্র প্রদর্শকদের কথায়, এসব ছবির মধ্যে মাত্র অর্ধডজন ছবি ব্যবসা করেছে। এগুলো হলো— চালবাজ, জান্নাত, দেবী, পোড়ামন টু, সুপার হিরো ও ভাইজান এলো রে। ৬টি ছবি ব্যবসা করলেও প্রযোজকের তেমন কোনো লাভ হয়নি জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রযোজক বলেন, ২৫০ টাকার টিকিটে একজন প্রযোজক পান মাত্র ৭৫ টাকা। তাও সিনেমা হল মালিকরা নিয়মিত দেন না। ফলে চরম লোকসানে পড়তে হয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের। এই অবস্থায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করে লাভ কী? সিনেমা হল মালিকরা বলছেন, বছরে হুট করে দু-একটি ছবি ব্যবসা করলে তা দিয়ে তো একটি সিনেমা হল চালানোর মতো সারা বছরের খরচ ওঠে আসে না। ছবি আমদানিও নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। এদিকে চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় সংগঠন প্রযোজক সমিতির নির্বাচন বন্ধ প্রায় এক দশক ধরে। ফলে স্থানীয় ও যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ, চলচ্চিত্র আমদানিসহ চলচ্চিত্রকারদের স্বার্থ সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এতে এই শিল্পে চলছে চরম অনিশ্চয়তা। শতকরা ৯৫ জন প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পী ও কলাকুশলী এখন বেকার। তারা কাজের অভাবে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। অনেকে ভিক্ষাবৃত্তির মতো পেশা বেছে নিয়েছে। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ৬৪ জেলায় সরকারি উদ্যোগে সিনেমা হল নির্মাণ ও আধুনিকায়নের কথা শোনা গেলেও চলচ্চিত্রকারদের কথায় তা আজও বাস্তবায়ন না হওয়ায় এই ব্যবসা নিয়ে গভীর সংকটে পড়েছি। সরকারি অনুদানের অর্থ নিয়ে সব সময়ই নয়-ছয় চলে। এতে একদিকে সরকারি অর্থের অপচয় অন্যদিকে ছবি নির্মাণে সরকারের লক্ষ্য বাস্তবায়ন হয় না। ছবির অভাবে চলতি বছর এ পর্যন্ত বন্ধ হয়েছে রাজশাহীর ‘উপহার’, গাজীপুরের চান্দিনাসহ প্রায় ৬টি সিনেমা হল। এদিকে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের মতে, যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা সংশোধন করে শিথিল করা না হলে যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণে কেউ এগিয়ে আসবেন না। বড় বাজেটের ভালো ছবি তৈরি সম্ভব হবে না। তাই চলচ্চিত্র নিয়ে তেমন কোনো আশার বাণী নেই। কারণ দেশে সিনেমা হল কম থাকায় কোটি টাকা ব্যয় করে সেই অর্থ তুলে আনা কঠিন বলে প্রযোজকরা আর নির্মাণে আসছেন না। চলচ্চিত্র এডিটরস গিল্ডের সভাপতি আবু মুসা দেবু বলেন, এমনিতে প্রযোজক সমিতি অকার্যকর। তার ওপর সমিতির গঠনতন্ত্র মতে সিনিয়র প্রযোজকদের সদস্য পদ বাতিল করা হয়। এতে উৎসাহ হারিয়ে মানসম্মান বাঁচিয়ে এই অঙ্গন থেকে দূরে সরেছেন সিনিয়র খ্যাতিমান প্রযোজকরা। ফলে ভালো ছবি নির্মাণ এখন কেবলই স্বপ্ন। নতুনরা নির্মাণ করছেন। কিন্তু দর্শক কী ধরনের ছবি চায় তা তারা আশ্বস্ত করতে না পারায় সবাই সফল হচ্ছেন না। নতুন নির্মাণে আসা চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহ আলম মণ্ডল বলেন, এ দেশের দর্শকের সিংহভাগ হচ্ছে মফস্বল কেন্দ্রিক। তারা চায় মৌলিক ও পারিবারিক গল্পের ছবি। যা এখনকার নির্মাতারা দিতে পারছেন না। ছবি মানে শুধু অ্যাকশন নয়, ছবি মানে জীবনের ছায়া। ছবির গল্পে এই জীবনবোধের অভাব থাকছে বলেই দর্শক ছবি দেখতে আর সিনেমা হলে আসে না। আমাদের দেশে এখনো ভালো গল্পকার আছেন। তাদের গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করলে সিনেমা শিল্পের সুদিন অবশ্যই ফিরবে। মুভি মুঘল খ্যাত প্রযোজক এ কে এম জাহাঙ্গীর খান বলেন, বর্তমানে চলচ্চিত্রের ব্যবসা খুবই মন্দা। এখন টিমওয়ার্ক নেই, কেউ গল্পের গভীরে যেতে চান না। আশির দশক পর্যন্ত গল্পপ্রধান ছবি নির্মাণ হতো বলে দর্শক বার বার তা দেখত। চলচ্চিত্র নির্মাণে নির্মাতার দক্ষতা অবশ্যই দরকার, যা এখন তেমন নেই। দক্ষ শিল্পীও নেই।  এখন গল্প ও নির্মাণে মৌলিকত্ব আর ঐতিহ্যের অভাব।

এসব নানা কারণে চলচ্চিত্র ব্যবসা চরমভাবে মার খাচ্ছে। তাই কেউই আর প্রযোজনা বা চলচ্চিত্রে বিনিয়োগে আসতে চান না। বলতে পারেন চলচ্চিত্র ব্যবসার আগ্রহ হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার নওশাদ বলেন, সিনেমা হলে দর্শক টানার মতো চলচ্চিত্র এখন আর নির্মাণ করা সম্ভব হয় না। কীভাবে হবে?  দক্ষ নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্পী কোথায়? গল্পের দুর্দিন চলছে। তামিল, হিন্দি আর বিদেশি ছবির গল্পের নকলে সবাই ব্যস্ত। ডিজিটালের নামে যেসব ছবি নির্মাণ হচ্ছে তা টেলিফিল্মও হচ্ছে না। শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ নির্মাতার অভাবেই এ দুরবস্থা চলছে। একজন শাকিব খান দিয়ে আর কত দিন চলবে। নতুন শিল্পী শুধু এলে চলবে না, তাদের অভিনয় দক্ষতাও দরকার, যা নেই বলে আর কেউ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন না। পাইরেসির আগ্রাসন তো আছেই। মূলকথা গল্প, নির্মাতা, শিল্পীর অভাব এবং পাইরেসির আগ্রাসনে বড়মাপের প্রযোজনা সংস্থাগুলো আর নির্মাণে আসতে পারছে না। একটি ছবি নির্মাণ করে যদি তা ব্যবসা সফল হয় তবেই প্রযোজক নতুন ছবি নির্মাণের ধারা বজায় রাখতে পারেন। লোকসান গুনে কীভাবে নির্মাণ অব্যাহত রাখা সম্ভব। সরকারকে এক্ষেত্রে ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং পাইরেসি রোধে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। চলচ্চিত্র প্রযোজক  খোরশেদ আলম খসরু বলেন, প্রযোজক যদি মূলধনই ফেরত না পান তাহলে চলচ্চিত্র ব্যবসায় বিনিয়োগ করবেন কেন? আগে হিট আর ফ্লপ বলে দুটি শব্দ ছিল। এখন কোনোটিই নেই। মানে ছবি চলেই না। নির্মাতা, গল্প ও শিল্পী নেই। নকলের নৈরাজ্য আর পুরনো ফর্মুলা তত্ত্ব থেকে এখনকার নির্মাতারা বেরিয়ে আসতে পারছেন না। আমরা গল্পের জন্য সৈয়দ শামসুল হকের মতো গল্পকারদের কাছে যাই না। সিনেমা হলের পরিবেশ নেই। ডিজিটালের নামে চলছে প্রতারণা। ইলেকট্রনিক প্রজেক্টর বসিয়ে প্রযোজকের কাছ থেকে নানাভাবে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। যদি পুরোমাত্রায় ডিজিটাল ও সেন্ট্রাল ব্যবস্থা চালু করা যায় তাহলে একদিকে দর্শক স্বাচ্ছন্দ্যে ছবি দেখতে পারবে, অন্যদিকে পাইরেসি ও প্রতিনিধির দ্বারা চুরি বন্ধ হবে। রেন্টাল কমাতে হবে। সরকার, চলচ্চিত্রের ও সাধারণ মানুষ মিলে টার্গেট করতে হবে ২০ টাকা হারে প্রতি টিকিটি ১ কোটি মানুষ ছবি দেখবে। না হলে চলচ্চিত্র ব্যবসায় কেউ আর বিনিয়োগ করবেন না। চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির কর্মকর্তা সৌমেন্দ্র বাবু বলেন, ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তির জন্য ছবি বুকিং দেওয়া আছে। এখন দেখার বিষয় এসব ছবির মধ্যে কয়টি মুক্তি পাবে এবং ব্যবসা সফল হবে। মানে ঢাকাই ছবির জন্য কোনো ভালো খবর নেই।

সর্বশেষ খবর