এদেশের তরুণ প্রজন্মকে বাংলার মাটি, মানুষ আর সুরের টানে বিমোহিত করতে প্রতি বছরের মতো এবারও আর্মি স্টেডিয়াম সেজেছে একটু ভিন্নরূপে। পর পর তিন রাতব্যাপী বাংলাদেশের সংগীত অনুরাগীরা উপভোগ করছে লোকসংগীতের সুরের ধারা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল থেকেই ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে সান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে শুরু হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় লোকসংগীতের উৎসব ‘আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসব-২০১৮’। প্রথমদিনের আসরে গতকাল মঞ্চ মাতান ভাবনা নৃত্যদল, পোল্যান্ডের দিকান্দা, ভারতের ওয়াদালি ব্রাদার্স, বাংলাদেশের বাউল আবদুল হাই দেওয়ান ও ভারতের সাত্যকি ব্যানার্জি।
প্রচার-প্রচারণা আর মিডিয়ার কৌতূহলী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য এই ‘ফোক ফেস্টিভ্যাল’কে ঘিরে সেদিন শহুরে মানুষের আগ্রহ ছিল দেখার মতো। এই আয়োজনটি উপভোগ করতে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে গতকাল হাজারো মানুষের ঢল নামে। বিকাল ৩টা থেকেই আর্মি স্টেডিয়ামের বাইরে সংগীতপিপাসুরা জড়ো হতে থাকেন। যদিও স্টেডিয়ামের গেট খুলে দেওয়া হয় বিকাল ৬টায়! সবার মতোই শহুরে মানুষের বিশাল স্রোত ঠেলে সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ আকাঙ্ক্ষিত স্থানে উপস্থিত হতে পারলেও অন্তত ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় চলে যায় স্টেডিয়ামের মূল ফটকের সামনে যেতে। স্টেডিয়ামে দেখা গেল বাহারি খাবারের ছোট ছোট স্টোর রুমের মতো খাবারের রেস্টুরেন্ট। পাশেই বসে খাবারের জন্য সুব্যবস্থাও আছে। এখানে বিশাল বিশাল স্ক্রিনে অনুষ্ঠান লাইভ দেখারও সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। রয়েছে মিডিয়া রুম, তথ্যকেন্দ্রসহ কিছু প্রদর্শনী দোকানও। এই উৎসবে সিনেমা, নাটক, মঞ্চে কাজ করা সবারই খুব পরিচিত মানুষগুলোও সাধারণ মানুষের মতোই উপভোগ করতে এসেছেন ফোক ফেস্ট। ফোক ফেস্ট উদ্বোধন হয় বাংলাদেশের স্বনামধন্য ভাবনা নৃত্যদলের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। সামিনা হোসেন প্রেমা ও তার নৃত্যদল পরিবেশন করে মনোমুগ্ধকর দলীয় নৃত্য। তারা ক্লাসিক্যাল, লোকনৃত্য, শাস্ত্রীয়নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। তারপর মঞ্চে আসে বাউল আবদুল হাই দেওয়ান। তারা পরিচিতি মূলত আড়বাঁশি বাজানোর মাধ্যমে। কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া এই শিল্পী শেকড় সন্ধানী কিছু বাউল গান পরিবেশন করতে মঞ্চে আসেন। এই বাউল সাধক তার নিজস্ব ঢঙে কিছু গান পরিবেশন করেন।
কিছুক্ষণ পর মঞ্চ আলো করে নিজের দল নিয়ে পারফর্ম করতে আসে ইউরোপীয় বলকান ও জিপসি প্রভাবিত পোল্যান্ডের ব্যান্ড দল ‘দিকান্দা’। তারা নৃত্যরত অবস্থায় বেশকিছু লোকজ গান পরিবেশন করে। তাদের সঙ্গে গলা মেলাতে শুরু করলেন উপস্থিত হাজারো শ্রোতা। ‘দিকান্দা’র পরিবেশনা শেষ হতে না হতে দর্শক মাতাতে মঞ্চে আসেন ভারতীয় শিল্পী সাত্যকি ব্যানার্জি। উচ্চাঙ্গসংগীত ও লোকসংগীত দুই ক্ষেত্রেই তার রয়েছে সমান দক্ষতা। তিনি একে একে পরিবেশন করতে থাকেন তার জনপ্রিয় গানগুলো। তারপর মঞ্চে আসেন ভারতের সুপরিচিত সুফি ঘরানার ‘ওয়াদালি ব্রাদার্স’। মূলত দুই ভাই পদ্মশ্রী ওস্তাদ পূরণচন্দ্র ও পেয়ারেলাল ওয়াদালিকে নিয়ে গঠিত হলেও ছোট ভাই পেয়ারেলাল ওয়াদালি চলতি বছরের মার্চ মাসে মারা যান। তাই এবার ওস্তাদ পূরণচন্দ্রের সঙ্গে গান করেন তার ছেলে লখিন্দর ওয়াদালি। গুরুবাণী, কাফি, গজল, ভজন গান গেয়ে তারা মুগ্ধ করেন উপস্থিত শ্রোতাকে। মুগ্ধ হয় স্টেডিয়ামে আগত বাঙালিরা। তিন দিনব্যাপী এই লোক উৎসবে অন্যরকম এক ঘোরে থাকে দর্শক-শ্রোতা। তিন দিনের রেশ কাটার পর এই উৎসব পুনরায় উপভোগ করতে ভবসুরের ভক্তদের অপেক্ষা করতে হবে সামনের বছর পর্যন্ত।
ছবি : রাফিয়া আহমেদ
আজ যারা মঞ্চ মাতাবেন
মমতাজ বেগম [বাংলাদেশ]
এদেশের শেকড় সন্ধানী মানুষের কাছে জনপ্রিয় লোকসংগীতশিল্পী মমতাজ বেগম। দুই দশকের বেশি সময়ের সংগীতজীবনে ৭০০টির বেশি একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে তার। তিনি রাজনীতিতেও বর্তমানে সক্রিয়।
দ্য রঘু দীক্ষিত প্রজেক্ট [ভারত]
রঙিন ফতুয়া আর লুঙ্গি পরে অভিনব সব পরিবেশনা করে থাকে ভারতের লোকসংগীত ঘরানার জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘দ্য রঘু দীক্ষিত প্রজেক্ট’। আধুনিক সংগীতের সঙ্গে ভারতের লোকজ সুরের মিশেল তাদের গানকে দেয় ভিন্নমাত্রা। বিশেষ করে ভারতের কান্নাড়া কবিতার রেশ থাকে তাদের গানে।
লস টেক্সম্যানিয়াকস [যুক্তরাষ্ট্র]
টেক্সাসভিত্তিক দল ‘লস টেক্সম্যানিয়াকস ব্যান্ড’। দলটির প্রতিষ্ঠাতা ম্যাক্স বাকা। বাকা বিশ্বের অন্যতম সেক্সতো বাদক হিসেবে পরিচিত। ১৯৯৭ সালে এর যাত্রা শুরু। তাদের মূল প্রেরণা কনজুন্তো তেহানো সংগীত হলেও তাদের সংগীতে আছে রক অ্যান্ড রোল ও জ্যাজের প্রভাব। ২০১০ সালে তারা সংগীতে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পায়।
স্বরব্যাঞ্জো [বাংলাদেশ]
বাংলাদেশের একটি ফোক-ফিউশন ব্যান্ড ‘স্বরব্যাঞ্জো’। ২০১৪ সালে রাজশাহীতে এই দলের যাত্রা শুরু। তারা ‘গান-বাজনা’ এবং ‘হাওয়ার চিঠি’ নামে দুটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছে।
মাজাজ [বাহরাইন]
বাহরাইনের প্রুগ্রেসিভ ফিউশন ব্যান্ড ‘মাজাজ’। প্রথমদিকে লাইভ পারফরম্যান্সে দর্শকের মন জয় করে। ২০১৬ সালে মুক্তি পায় তাদের প্রথম সিঙ্গেল। স্টুডিও রেকর্ড ‘রিহলা’ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়। বিভিন্ন যন্ত্রের মিশেলে ফোক প্রুগ্রেসিভ সংগীত তাদের দিয়েছে ভিন্নতা।